কিয়েভে শুরু চূড়ান্ত লড়াই

চলছে দাবি আর পাল্টা দাবি

| রবিবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

কিয়েভের রাস্তায় মুখোমুখি রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। শহরের বহুতল ভবন লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু চলছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। সাদা বরফের চাদর সরিয়ে তার জায়গা নিচ্ছে অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ। চলছে চূড়ান্ত লড়াই। আচমকা টেলিভিশন বার্তায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করার ঘোষণার পর কেটে গিয়েছে ৭২ ঘণ্টারও বেশি সময়। এই সময়ের মধ্যে এক বারও থামেনি হামলা। গতকাল কিয়েভে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয় রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীর বড় একটি অংশ। ফলে সেই সময় থেকেই রাজধানীর বুকে বাড়ে যুদ্ধের তীব্রতা। রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণের তৃতীয় দিনে ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকায় দেশটির সামরিক বাহিনী এগোতে থাকা রুশ বাহিনীকে বাধা দিয়ে লড়াই চালিয়ে যায়। ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলার্বষণের মুখে দেশটির বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাঙ্কার, ভূগর্ভস্থ মেট্রো স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের দাবি আর পাল্টা দাবি ঘিরে সরগরম বিশ্ব রাজনীতি। সর্বশেষ কিয়েভের কাছে রুশ সেনাবাহী একটি উড়োজাহাজ গুলি করে ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইউক্রেইন। তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ফেসবুকে এক পোস্টে এ দাবি করে জানিয়েছে, ওই উড়োজাহাজটিতে রাশিয়ার ছত্রী সেনারা ছিল। যাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন। ইউক্রেইনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। উড়োজাহাজটির উৎপাদনকারীদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ওই উড়োজাহাজে ১৬৭ জনের বেশি সেনা এবং ছয় থেকে সাতজন ক্রু থাকেন। সেনাবাহী উড়োজাহাজ ভূপাতিত করা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা না হলেও রুশ সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আইগর কোনাশেঙ্কোভ দাবি করেন, ইউক্রেইনে আগ্রাসনে শনিবার রুশ বাহিনীর কেউ হতাহত হননি।
ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার আগ্রাসনে তিনটি শিশু-সহ ১৯৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। আহত হয়েছেন হাজারেরও বেশি। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট নয়, তিনি শুধু সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কথা বলছেন, না কি তাতে ইউক্রেনের সেনাও রয়েছে। এ দিকে কিয়েভের শহরতলি থেকে যুদ্ধে নিহত রুশ সৈনিকদের দেহ তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক রেড ক্রশকে আবেদন করেছে ইউক্রেন। তাদের দাবি, প্রায় সাড়ে তিন হাজার রুশ সেনার মৃত্যু হয়েছে। অন্তত ২০০ জনকে বন্দি করা হয়েছে।
আগেই খবর পাওয়া গিয়েছিল, রাজধানীতে ঢোকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ভাসিলকিভে ইউক্রেনের জাতীয় পুলিশের ছদ্মবেশে পৌঁছে গিয়েছিল রাশিয়ার সেনা। সেখানে কর্তব্যরত ইউক্রেন সেনাদের সঙ্গে তাদের গুলি বিনিময় হয়। রাশিয়ার সেনার হাতে প্রাণ হারান নাকার দায়িত্বে থাকা ইউক্রেনের সৈনিকরা। এখন জানা যাচ্ছে, সেই পথ দিয়েই বন্যার জলের মতো ঢুকতে শুরু করে রাশিয়ার সৈনিকরা। পাল্টা প্রতিরোধ চালাচ্ছে ইউক্রেনের সেনাও। শুধু ইউক্রেনের নিয়মিত সেনাবাহিনীই নয়, অস্ত্র হাতে দেশকে বাঁচাতে ময়দানে নেমে পড়েছেন বহু অবসরপ্রাপ্ত সেনানী এবং সাধারণ নাগরিক।, কিয়েভের রাস্তায় রাস্তায় ইউক্রেনের সেনার সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই চলছে। রাজপথে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি।
এদিকে আলোচনার টেবিলে না বসার জন্যই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে মন্তব্য করছে রাশিয়া। ফের এক বার আলোচনা টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছে ক্রেমলিন। পুতিনের পক্ষে মুখ খুলেছেন রাশিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ। তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনেক দেশই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু এর কোনও প্রভাব পড়বে না।’ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ডেপুটি হাই কমিশনার আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ১ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি ইউক্রেনের বাসিন্দা দেশ ছেড়েছেন। প্রায় সাড়ে আট লক্ষ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পরিস্থিতির যদি আরও অবনতি হতে থাকে তবে আরও ৪০ লাখ ইউক্রেনবাসী দেশ ছাড়বেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে কিয়েভ থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট তা প্রত্যাখান করেছেন। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে বলেন, ‘আমাকে সরিয়ে নিতে হবে না। আমার গোলা-বারুদ দরকার।’ ভিডিওতে একটি প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘সব ইউক্রেনীয়কে শুভ সকাল। অনলাইনে প্রচুর ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে। আমি নাকি আমাদের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র নামিয়ে রেখে চলে যেতে বলেছি। শুনুন, আমি এখানে আছি। আমরা আমাদের অস্ত্র নামিয়ে রাখছি না। আমরা আমাদের দেশকে রক্ষা করবো, কারণ আমাদের অস্ত্রই আমাদের সত্য। আর সত্য হচ্ছে, এটি আমাদের ভূমি, আমাদের দেশ, আমাদের সন্তান। আমরা এর সবই রক্ষা করবো। এটাই আমি আপনাদের বলতে চাই। ইউক্রেইনের জন্য গর্বিত।’
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে তারা দক্ষিণ ইউক্রেনের শহর মেলিতোপোল দখল করেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার চেচনিয়া অঞ্চলের নেতা রমজান কাদিরভ বলেছেন তিনি ইউক্রেনে তার যোদ্ধাদের পাঠিয়েছেন, যারা রুশ সৈন্যদের সাথে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করবে।
এদিকে অপর এক খবরে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধে নামার পর খুব দ্রুতই যুদ্ধের কঠিন অংশটুকু সামনে চলে আসায় তাদের অগ্রগতি শ্লথ হয়ে গেছে। হামলার প্রথম দিন রুশ জেনারেলরা ও সামরিক বাহিনী স্থল আক্রমণের ‘টেঙটবুক কৌশল’ অনুসরণ করেছিল। সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে পড়া বাহিনী অল্প সময়ের মধ্যে কিয়েভের কাছে পৌঁছে যায়, পেয়ে যায় চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রসহ অনেকগুলো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের নিয়ন্ত্রণ; কিন্তু এরপর থেকেই রুশ বাহিনীর এগুনোর গতি ধীর হয়ে আসে বলে এক প্রতিবেদনে বলেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। পেন্টাগন কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, মাথার ওপরে থাকা যুদ্ধবিমানের সুরক্ষা নিয়ে ট্যাংক আর কামান নিয়ে অন্য দেশের সীমান্তে ঢুকে পড়া এক জিনিস আর শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং জীবন দিতে প্রস্তুত লোকজনের সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। ইউক্রেনে ঢোকার একদিনের মধ্যেই ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধের কারণে রুশ বাহিনী কিছু ‘মোমেন্টাম’ হারিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। খবর বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইউক্রেনের চীনা পোড়ামাটি রণনীতি
পরবর্তী নিবন্ধরোয়াংছড়িতে জনসংহতির কর্মীকে গুলি করে হত্যা