কিশোর গ্যাং ও সামাজিক অস্থিরতা প্রসঙ্গে

মো. দিদারুল আলম | সোমবার , ২৩ জুন, ২০২৫ at ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অপরাধ জগতের একটি আলোচিত ও আতংকের নাম কিশোর গ্যাং। গণপরিবহন থেকে টক শো, টক শো থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সব জায়গায় ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচার’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। উঠতি বয়সের কিশোররা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং। তারা হত্যাধর্ষণসহ নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং তথা কিশোর গ্যাং কালচার। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অস্ত্রবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রায় সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কিশোররা। তাদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে কথিত বড় ভাইয়েরা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নগরীর পাড়ামহল্লায় প্রতিনিয়ত আধিপত্য বিস্তার এবং হিরোগিরি দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। প্রতি বছর গ্যাংএ যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সদস্য। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীরা। একের পর এক খুন, মাদক চোরাচালান, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারে জড়িয়ে পড়ছে তারা। তাদের যেন ঠেকানোর কেউ নেই। শুধু চট্টগ্রাম নয়, ঢাকা, গাজীপুর ও খুলনা মহানগরী এলাকায়ও বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে, যারা খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষমারামারিতে জড়াচ্ছে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা। বলতে গেলে দেশের সব জেলা শহরগুলোতেও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে।

ফেব্রুয়ারি ২০২৫ গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ২৩৭টি। তন্মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ১২৭টি দল সক্রিয়। পূর্বে ঢাকায় এসব গ্রুপের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৮২। ২০২২ সালে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ১৭৩টি এবং সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। অর্থাৎ দুই বছরে এর সংখ্যা বেড়েছে ৬৪টি বা ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে এসব দলের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার, যা আগের সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। এখন ঢাকার প্রতিটি থানা এলাকায় ৫০০ থেকে ১ হাজার সদস্য রয়েছে। আর চট্টগ্রামে ৫৭টি কিশোর গ্যাংয়ে সদস্য রয়েছে ৩১৬। কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিয়ে অনেকেই রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। দিন যত যাচ্ছে ততই ভয়ংকর উঠছে কিশোর গ্যাং। দিনদুপুরে তারা ছিনতাই করছে। কথায় কথায় মারামারি ও অস্ত্রবাজি করছে। খুন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত অর্ধশত খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাদের দৌরাত্ম্য কমাতে গত চার বছর আগে তালিকা করা হলেও সেটি আর হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে পাড়ামহল্লার উঠতি বয়সি কিশোররা।কিশোর গ্যাংএর সদস্যরা স্কুলকলেজের ছাত্রী বা তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে। এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছে। শ্লীলতাহানী ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে অনেকে। মেয়েদের বাবামাভাইরা তাদের সন্তান ও বোনদের নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকে। ঘরে না ফেরা পর্যন্ত তারা অস্থির থাকে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক বাবাভাই প্রাণও হারিয়েছেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার জন্য তাদেও কোনো বিচার হয় না। এদের কারণে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন।

আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা করলে এক সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। ঠিকমতো নজরদারি করলে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বন্ধ হবে। তবে অভিভাবকদেরও সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে দরকার সর্বসম্মতিক্রমে সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে বেশি কারণ তাদের ছেলেমেয়ে কার সাথে মিশছে, কিভাবে বড় হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। পরিবারের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে কিশোরদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। শিশু কিশোরদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থাকতে হবে। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পাশাপাশি অভিভাবকশিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ আজকে যে শিশু বা কিশোর সে হবে আগামী দিনের কর্ণধার। যারা কাজ করবে সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, দেশের জন্য। যারা নেতৃত্ব দিবে দেশকে এবং তাদের ভিবিন্ন সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে নিজ দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে অংশীদার হবে। তাদের সফল ও গৌরবময় কাজের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে নিজ দেশকে নতুন করে তুলে ধরবে। বিশ্বদরবারে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, বর্তমানে আমার এই নতুন প্রজন্ম ভয়াবহ হুমকির মুখে। আমাদের সোনালি কিশোররা হারিয়ে যাচ্ছে গহিন অন্ধকারে। জড়িত হচ্ছে মাদক, চাঁদাবাজি, চুরিছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধে এবং প্রকাশ করছে নিজেকে এক একটা কিশোর গ্যাং হিসেবে।

দেশের সকল অভিভাবককে তাদের সন্তানের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। তাদের চলাফেরায় সার্বক্ষণিক নজর রাখা প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি অভিভাবক যদি এখন থেকে তাঁদের সন্তানদের ব্যাপারে নজরদারি না করেন তাহলে হয়তো একসময় এমন অবস্থা তৈরি হবে, তখন হাজার চেষ্টা করেও অবাধ্য সন্তানদের সুপথে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই সকল অভিভাবককে সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। সন্তানের সাথে অভিভাবকদের বন্ধুর মতো আচারআচরণ করতে হবে। যদি সন্তানের সাথে পিতার বন্ধুসুলভ আচরণ করা যায় তাহলে এ সন্তান কিছুটা হলেও বিপথ থেকে দূরে থাকবে বলে আশা করা যায়। পারিবারিক বন্ধন করতে হবে দৃঢ়। কিশোর অপরাধ দমনে শুধু আইন প্রয়োগই নয়, সামাজিক সচেতনতা জরুরি। শিশুর সামাজিকীকরণ বা শিক্ষার প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। তাই এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুররুত্বপূর্ণ।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলেজ শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোথায় সেই বর্ষার আনন্দ, অপরূপ সৌন্দর্য!
পরবর্তী নিবন্ধআদিম এআই (অও)