নানা উদ্যোগে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে না আসায় আবারও মাঠে নেমেছে পুলিশ। মাদক, ছিনতাই কিংবা খুন- চট্টগ্রামে এমন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আছে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। কিশোরদের এমন অপরাধের ছবি প্রায়ই আসে গণমাধ্যমে। যাদের পেছনে আছে বড় ভাই নামে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। পুলিশের হিসাবে এর সংখ্যা শতাধিক। নগর পুলিশের কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর গত ১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাতে তার ফেসবুক পেইজে দেওয়া এক পোস্টে সঠিক তথ্য দিয়ে কোমলমতি কিশোরদেরকে সঠিক ও আলোর পথে ফিরিয়ে আনায় সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন নগরবাসীর প্রতি। তাঁর নির্দেশে ১৬ থানার পুলিশের পাশাপাশি নগর গোয়েন্দা পুলিশও কিশোর গ্যাং সদস্যদের তালিকা করার পাশাপাশি মাঠে অভিযান চালাচ্ছে। ধরা পড়ছে যারা, তাদের কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ আবার নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।
সিএমপির তথ্য মতে, গেল এক বছরে কিশোর অপরাধীদের হাতে খুন হয়েছে অন্তত ১০ জন। মামলা হয়েছে শতাধিক ঘটনায়।
কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে গত বছর নগরীর ১৬ থানায় ৫৩৫ জন কিশোর গ্যাং সদস্য এবং শেল্টারদাতা ৪৭ জন কথিত গডফাদার বা বড় ভাইয়ের তালিকা করেছিল পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে সবাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার ফলে পুলিশ আর এগোয়নি। তবে সিএমপি কমিশনারের নির্দেশে গত ৩ অক্টোবর থেকে নগরীর ১৬টি থানার ১৪৫ জন বিট কর্মকর্তা কিশোর গ্যাং ও তাদের মদদদাতাদের (গডফাদার) তালিকা তৈরি করছেন। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে সিএমপির অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-উত্তর) শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফ আজাদীকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত রুখতে নগর জুড়ে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক তালিকা করছে।
নগরীর আকবরশাহ এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা একাধিক মামলার আসামি লাল সাগর গ্রুপের প্রধান শাকিল হাসান সাগর এবং স্থানীয় কিশোর গ্যাং লিডার মহসিনকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের থেকে চাপাতি, চাকু, দেশি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। একই দিন সকালে আকবরশাহ থানা পুলিশ নগরীর বিশ্ব কলোনি এলাকা থেকে কিশোর গ্যাং সদস্য আব্দুল আজিজ সাকিব ওরফে আরিয়ানকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। আকবরশাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জহির হোসেন এ প্রসঙ্গে আজাদীকে বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্য আরিয়ানকে আকবরশাহ থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আকবরশাহ থানায় এর আগেও দুটি মামলা ছিল। আকবরশাহ এলাকায় লাল সাগরের নেতৃত্বে গ্রেপ্তারকৃত আরিয়ান ছিনতাই করতো বলে জানান ওসি আকবরশাহ।
১৫ অক্টোবর লালখানবাজার এলাকার সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং লিডার শরীফ প্রকাশ ডেঙি শরীফকে গ্রেপ্তার করেছে খুলশী থানা পুলিশ। ওসি খুলশী মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান আজাদীকে বলেন, শরীফ প্রকাশ ডেঙি শরীফ লালখানবাজার এলাকার সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং লিডার। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে সাতটি মামলা রয়েছে।
১১ অক্টোববর নগরীর জামালখান এলাকায় স্কুলছাত্র আদনান ইসফার হত্যা মামলার দুই আসামি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য আব্দুল্লাহ আল সাইদ (২০) ও এখলাস উদ্দিন আরমানকে (২০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের গ্রেপ্তারে তাদের গ্রুপটি দুর্বল হয়ে পড়ায় চন্দনপুরার গুড সাহেব রোডের ওয়াহিদুর রহমান তাসিনের গ্রুপটি ওই এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ অপরাধীরা মারামারি, ছিনতাই, স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্যক্ত করা, অলিগলিতে শোডাউনসহ আরও নানা অপরাধে জড়িত। নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ মো. আব্দুর রউফ আজাদীকে বলেন, গ্রেপ্তার দুজনই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোরদের ‘গ্যাং কালচারের’ নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। তারা নিজেরাও কিশোর অবস্থায় হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। খুলশী থানার একটি ছিনতাই মামলার তদন্তে সদ্য কৈশোর পার হওয়া আবদুল্লাহ আল সাইদ ও এখলাস উদ্দিন আরমানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। খুলশী থানার মামলা ছাড়াও আরমানের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় দু’টি এবং সাইদের বিরুদ্ধে তিনটি করে মামলা আছে।
৯ অক্টোবর নগরীতে কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে পরিচিত অন্তু বড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করে চকবাজার থানা পুলিশ। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রুহুল আমীন আজাদীকে বলেন, চকবাজারসহ আশপাশের এলাকায় অন্তু বড়ুয়া কমপক্ষে ৫-৬টি কিশোর অপরাধী গ্রুপের নেতৃত্ব দেয়। তার বিরুদ্ধে চকবাজার ও পাঁচলাইশ থানায় ছয়টি মামলা আছে।
১১ সেপ্টেম্বর কোতোয়ালী থানা পুলিশ পৃথক দুটি অভিযানে নগরীর নিউমার্কেট ও বিআরটিসি ফলমণ্ডি এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। ওসি কোতোয়ালী মোহম্মদ মহসীন আজাদীকে বলেন, পারিবারিক অনুশাসনের অভাবে চট্টগ্রামে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটি, ফেসবুক-মোবাইল, প্রেম, চুরি-ছিনতাইসহ নানা ইস্যুতে সামান্য মতানৈক্য হলেই এদের মাথায় খুনের নেশা চাপে।