দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে কিশোর অপরাধীরা। নানা ধরনের অপরাধে কিশোররা জড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধের পরিধিও বেড়েছে। কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর কারণ বেশ কিছু গবেষণা থাকলেও সেগুলোর প্রতি নজর বা তা থেকে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার আগ্রহ সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর নেই। আইন ও নীতিমালা থাকলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কিশোরদের মধ্যে পড়াশোনার চাপ ও আগ্রহ দুটিই কমে গেছে। এতে পাড়ায়–মহল্লায় চায়ের দোকানে কিশোরদের আড্ডা বেড়ে গেছে। এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে এলাকাভিত্তিক গ্রুপগুলো। তারা নিজেদের দল ভারী করতে এসব কিশোরকে দলে টানছে। এর মধ্য দিয়েই কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে মাদক–ইভটিজিং–ছিনতাইসহ নানা অপরাধে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে জড়িয়ে পড়ছে খুনোখুনিতেও।
গত ১২ জুন দৈনিক আজাদীতে প্রধান শিরোনাম হয় ‘চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধীদের হাতে আট দিনে ৪ খুন’। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে অপরাধের নিয়ন্ত্রণ এখন কিশোর অপরাধীদের হাতে। খুন, জখম থেকে ছিনতাই, চাঁদাবাজি সবকিছুতেই উঠে আসছে কিশোর অথবা সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণদের নাম। অভিযান, গ্রেপ্তার কোনোকিছুই থামাতে পারছে না এ অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। চট্টগ্রামে গত আট দিনে চারটি খুনের ঘটনায় উঠে এসেছে এমন কিশোরদের নাম, যাদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে থানায় কোনো অভিযোগ ছিল না। হিরোইজম, কাঁচা টাকা–পয়সা, মাদকাসক্তি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত বাড়ছে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা। সেই সাথে টিকটক, লাইকিসহ নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, ‘আজকাল প্রায়ই বিভিন্ন গণমাধ্যমে কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধের খবর প্রচারিত হয়। এতে অনেক যুবকের ভবিষ্যৎ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ব্যাপারে যুবসমাজকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। যুবদের উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। শুধু নিজে ভালো থাকলে চলবে না, অন্যরাও যাতে ভালো থাকে সে চেষ্টাও করতে হবে। সন্তান যেন লেখাপড়ার পাশাপাশি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে মা–বাবা এবং অভিভাবকদের পরামর্শ দেন তাঁরা। তাঁরা বলেন, সম্ভাবনার পাশাপাশি যুব সমাজের সামনে চ্যালেঞ্জও অনেক। এ ছাড়া দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কর্মসংস্থানের অভাব, অপরাধ ও সহিংসতা সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার জন্ম দেয়। যাবতীয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, কর্মসম্পাদনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রাপ্ত সরকারি–বেসরকারি সুযোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে যুব উন্নয়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের অমিত সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে অবশ্যই উন্নত মানসিকতাসম্পন্ন বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
অপরাধবিজ্ঞানীরা বলেন, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা ও আইনের দুর্বল শাসন কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়–প্রশ্রয়ে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির তুলনায় কিশোরদের আইন ভাঙার শাস্তি কম হওয়ায় একদল অসাধু ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের আশ্রয়ে গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং এবং তাদের দিয়ে সংঘটিত করাচ্ছে মাদক ব্যবসা, খুন, এমনকি মানব পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধ। সাধারণ মানুষের কাছে এখন আতঙ্কের নাম কিশোর অপরাধ। শহরে বা গ্রামে কিশোররা শিক্ষক কিংবা বয়স্ক কাউকেই তোয়াক্কা করে না। তামাক দ্রব্যের সহজপ্রাপ্যতা কিশোরদের অপরাধ জগতে শুরুটা করে দিচ্ছে। স্থানীয় রাজনীতি, পদ পদবির জন্য কিশোররা রাজনৈতিক নেতাদের অনুসারী হয়ে থাকে। এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে কিশোররাই হবে মানবতার অগ্রদূত, আমাদের দুঃখ, সেখানে তারা হয়ে উঠছে যমদূত। এদের নির্মূলে খুব দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের মনে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যা, ধর্ষণ ভীতি বাড়তেই থাকবে।
আমরা জানি, পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিশোর অপরাধ দমনে তৎপর রয়েছেন। রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি। তবে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা রোধে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি সময়ক্ষেপণ করা হয়, তাহলে এই দেশ অচিরেই অরাজক দেশে পরিণত হবে। তাই দেশকে বাঁচাতে কিশোর অপরাধ কঠোরভাবে দমন করা জরুরি।