একটা কিশোরগল্প মানে কি শুধু স্কুল? দস্যিপনা আর একটুখানি স্বপ্ন? নাকি তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে সাহস, সংকট, প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজার ছটফটানি?
একটা সময় ছিল কিশোরগল্প মানেই শুধু দুরন্তপনা, বনজংগল, গ্রাম্যপটভূমি, কিংবা ভুতুড়ে রহস্যে মোড়া ঘটনা। ছিল এডভেঞ্চার, গোয়েন্দাগিরি। ছিল মামা–চাচার লেজুড়গিরি। কিংবা অহেতুক ফ্যান্টাসির কচকচানি। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে বদলে গেছে কিশোরসমাজ। বদলেছে তাদের জগৎ, আগ্রহ, সংগ্রামের ধরন। সাহিত্যের বর্ণনায়, ভাষায় এবং বিষয় নির্বাচনে এসেছে পরিবর্তন। মামার সাথে বসে থাকা ভাগ্নের খামোখা দুষ্টুমি–চালাকিপূর্ণ সেইসব দিনের গল্পের সাথে এখনকার কিশোরদের চরিত্র–আচরণের বিন্দুমাত্র মিল নেই।
এখনকার কিশোরমন কেমন গল্প চায় তাহলে? নিশ্চয়ই তেমন গল্প– যেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে নিজের ছায়া। সে–তো কোনো রাজপুত্র নয়, সাহসী নায়কও হয়ে উঠেনি। আটদশটা কিশোর–কিশোরীর মতো সেও প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যায়, বাসায় ফিরে টিফিনের বাঙ থেকে পচে যাওয়া কলা ফেলে দেয়, কখনো টিফিনে একা বসে থাকে এমন একটা সাধারণ জীবনের মুখোমুখি আমাদের কিশোর বন্ধুরা। কিন্তু ওদের জন্য যখনই গল্প লেখা হচ্ছে তখন সেই অজানা জনপদে থাকা কোনো এক দাদুর গল্প সাজিয়ে বইয়ের পাতা মেলে ধরে বলা হয়– পড়, এই তোমার গল্প।
অথচ, ওই গল্পটি যার জন্য রচিত হলো সে কিন্তু অসাধারণ কেউ নয়। সেও রাতে পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়ে, পরীক্ষার আগের রাতে ভয় পায়, বন্ধুর সাথে ঝগড়া করে মন খারাপ করে, ভালো লাগা কাউকে দেখলে হঠাৎ আনমনা হয়ে ওঠে। সেও তো একজন সাধারণ ছেলে বা মেয়ে, যে ভুল করে আবার সঠিক কাজ করে, কখনো ভয় পায় আবার ঘুরেও দাঁড়ায়।
এখনকার কোনো কিশোর গুপ্তধন খুঁজতে অচেনা পথে পা বাড়ায় না– অথচ দেদারসে লেখা হচ্ছে এই জাতীয় গল্প। সবাই রোবট বানায় না, কিন্তু বানাতে চায় এমন জীবন যেখানে নিরাপদ ভবিষ্যত থাকে। কিশোরগল্পগুলো এসব ভাবনা থেকে দূরে অবস্থান করছে। বারবার শুধু শোনাতে চায়– ভালো হও, অন্যায় করো না। কিন্তু যখন অন্যায় এবং নীতিবর্জিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় তখন উত্তরণের পথ কি? এখন ডালিমকুমার আসে না। রাজার ঘোড়া দৌড়ায় না। এখন অলৌকিক চেরাগ মেলে ধরে না তার দত্যিকে। তাহলে উপায়? এ জন্য নতুন অবলম্বন খুঁজতে হবে। কিশোরগল্পের একজন পাঠক এখনকার গল্প পড়ে ভাবতেই পারে– ‘আমি তো জানি, আমি সবসময় ভালো থাকতে পারি না। আমি জেদ করি, আমি কাঁদি। আবার সব শুধরে নিয়ে ঠিক হয়ে যাই। আমি চাই গল্প হোক প্রতিদিনের ছোট ছোট সমস্যাকে পাশ কাটানোর গল্প।’
স্কুলের সিঁড়িতে বসে একা একা টিফিন খাওয়ার গল্প কখনো কখনো অন্য কারো জীবনের গল্প হয়ে উঠতে পারে। ঘরে–বাইরে আমরা যে কিশোর–কিশোরীদের দেখি, গল্পে কিন্তু এদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বাবা–মা’র বিচ্ছেদ থেকে উঠে আসা কান্নার গল্প আমাদেরই চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে– এসব গল্প আমরা কখনো বলি না। কেউ লিখতেও চাই না। কারণ এগুলো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এই ভয়ে। কিন্তু এটাই বাস্তব সত্য জীবনের ছোট ছোট অনুভবই তো নতুন করে সাহস জাগিয়ে দেয়। নক্ষত্র ভরা আকাশ বানিয়ে দেয় মনের ভেতরে। যেখানে একজন কিশোরের অনুভব, তার লড়াই–সংগ্রাম, তার পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ, দেশ, স্কুল–কলেজ, মহল্লা, বন্ধুস্বজন– সব কিছুতে ছড়িয়ে আছে বাস্তব জীবনের চালচিত্র। সেখান থেকে টুকরো টুকরো ঘটনার বিশ্লেষণ হয়ে উঠতে পারে এক একটি গল্প।
পৃথিবীর বহুদেশে প্রকাশনা সংস্থাগুলো বাজার গবেষণার মধ্য দিয়ে ‘টার্গেট রিডার’ তৈরি করে। একই সাথে একটা গল্প নিয়ে বই প্রকাশিত হচ্ছে। পাশাপাশি সেই গল্প নিয়ে মুভি, মিউজিক, কমিক, গ্রাফিক নভেল তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে একটা গল্পকে যেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে তাতে করে গল্পটি হয়ে ওঠে ‘ব্র্যান্ড’।
কিন্তু বাংলাভাষায় কিশোর সাহিত্যের তেমন বাজারভিত্তিক রূপ নেই। বইমেলাকে ঘিরে স্বপ্লমেয়াদী চাহিদা সৃষ্টি হয় কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী পাঠকভিত্তি গড়ে উঠছে না।
আন্তর্জাতিক কিশোর সাহিত্য তার বিষয়, কলাকৌশল ও কল্পনার বিশালতায় বিস্ময় সৃষ্টি করে। কিন্তু বাংলা ভাষায় রচিত আমাদের কিশোর গল্পগুলো এখনও অগ্রজ লেখকদের দেখানো পথকে অতিক্রম করতে পারছে না। দু’চোখ মেলে সময়কে দেখতে পাচ্ছে না। একটা প্রতিবন্ধকতা, চিন্তার দৈন্যদশা, প্রাপ্তি এবং স্বীকৃতির অনিশ্চিত দোলা লেখকদের মনকে বেঁধে রেখেছে। নতুন নতুন ভাবনা ডানা মেলে উড়তে পারছে না। বাংলা ভাষায় রচিত আশ্চর্যরকম ভালোলাগা গল্প লেখকদের উত্তরাধিকার আমরা– এসময় যারা কিশোরগল্প রচনায় নিবেদিত। আমরা আমাদের অগ্রজ লেখকদের সুবাসিত রচনার স্বাদ নিতে নিতে নতুন গ্রল্প নির্মাণের ভ্রত হয়েছি।
আমাদের গল্পে আমরা নানান বিষয়কে নিয়ে আসতে পারি। যেমন– মানসিক স্বাস্থ্য, জেন্ডার সমতা, জলবায়ু সংকট, অনলাইন হয়রানি, যুদ্ধ, বাস্তুচ্যুতি, অভিবাসন। এমন কি দ্বৈত সংস্কৃতির মাঝে বড় হওয়া একজন কিশোরের মনোসংকটগুলো সাহিত্যের ভাষায় চিহ্নিত হতে পারে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক কিশোর লন্ডনের স্কুলে গিয়ে কীভাবে টিকে থাকে– এমন গল্প শুধু ভাষার ক্ষেত্রে নয় আত্মপরিচয়ের প্রশ্নেও তাকে সমাজ–সংস্কৃতির মুখোমুখি করতে পারে।
মিথ্যা কোনো জাদুকরি স্পর্শে জীবন বদলায় না। জীবন আগের চেয়ে আরও বাস্তববাদী। কিশোর সাহিত্য সৃষ্টি করতে লেখকদের দায়িত্ব হয়ে উঠেছে এখন আর শুধু গল্প বলা নয়, কিশোরদের মনোজগতের সাথী হওয়া। বিশ্বায়নের এই যুগে দাঁড়িয়ে আমাদের দরকার এমন এমন কিশোরগল্প– যা একসাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক, সাহসী ও সংবেদনশীল এবং সময়কে তুলে ধারার কার্যকর প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পারে।
আগের দিনে গল্পের পেছনে পাঠক দৌড়াতো। এখন পাঠকদের পেছনে গল্পকে দৌড়াতে হয়। কারণ পাঠকের পছন্দসই গল্প না হলে পাঠক গল্পটাকে গ্রহণ করতে অপারগ। ঘটনা প্রবাহ সাজাতে সব কিছু দেখতে হবে কিশোরদের ভাষায়। গল্প সাজাতে হবে কিশোরের অভিজ্ঞতা থেকে।
মনে রাখতে হবে, বর্তমান কিশোর–কিশোরীর আগ্রহ ও বাস্তবতা বদলে গেছে। কিশোরদের কল্পনাশক্তি অসীম। আকর্ষণীয় চরিত্র, অদ্ভুত জগৎ এবং মনোমুগ্ধকর প্লট তৈরি করে এমন গল্প রচিত হোক যেখানে পাঠকদের মধ্যে কল্পনার স্ফূলিঙ্গ জাগাতে পারে। শুধু গল্প নয়– একটা গল্পের ভেতরে মহামূল্যবান কিছু থাকতে পারে। যেমন– দয়া, সহানুভূতি, শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্ব, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, পরম্পরা, দেশপ্রেম, জাগরণ, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। একটা ভালো গল্প একই সঙ্গে নতুন সময়কে চেনাতে সাহায্য করে। পাঠের প্রতি ভালোবাসা ও মনোযোগ তৈরি করে দিতে পারে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সংযোগ স্থাপন করে দিতে পারে। কারণ একটা ভালো কিশোর গল্প সকল বয়সের পাঠক উপভোগ করতে পারে। সবার মধ্যে জাগাতে পারে পাঠের আনন্দ।
সাহিত্য মানেই নতুন সৃষ্টি। নতুনের এই ভেলায় চড়ে কিশোরগল্প রচনা করতে লেখকদের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী দরকার। এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন– কিশোরদের মানসিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপট বোঝা লেখকদের দায়িত্ব। গল্পের ভেতরে শুধু অ্যাডভেঞ্চার নয়, ভাবনার বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে। নৈতিকতার ভার না চাপিয়ে, দরকার কিশোরগল্পে মানবিকতার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। আদর্শিক চরিত্র তৈরি করা। বাস্তবতা ও ভারসাম্য ঠিক রেখে সময়োপযোগী ভাষা ও ভাবের প্রয়োগ থাকা প্রয়োজন।
গল্পকাররা এদিকটায় নজরে না এনে পুরনো বিষয়ের মাঝে আটকে থাকলে কিশোরপাঠক নিজেকে খুঁজে পাবে না। এছাড়াও আছে ভাষা ও গল্পের কাঠামোয় জড়তা। এসব কাটিয়ে ওঠা দরকার। গল্প ছড়িয়ে থাকে হাসিতে, কান্নায়, সংগ্রামে–সংকটে, জয়ের মুহূর্তে। প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরা প্রকৃতির শরীরে। জীববৈচিত্র্যের গভীর মায়াধরা বনাঞ্চলেও ছড়িয়ে আছে কত কত গল্প। শুধু দরকার চোখ মেলে দেখা আর সাহস করে লেখার। কিশোরগল্প লেখার অর্থ শুধু গল্প নয় এটি কিশোরমনকে গঠন করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। মূল্যবোধ তৈরি করে। সৃজনশীলতা জাগিয়ে দেয়। ইতিবাচক প্রভাব ফেলে মনের ভেতর। অন্তত আমি তাই মনে করি। দৃঢ়ভাবে আমি এও বিশ্বাস করি যে, আজকের কিশোর পাঠকদের জন্য নতুন গল্প লেখার যথেষ্ট বিষয় পৃথিবীতে রয়েছে। সময় এসেছে, চলুন খুঁজি সেই গল্প– যেটা এখনও লেখা হয়নি।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক; সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি