রাউজান গহিরা ১৬ ডিসেম্বর মুক্ত হলো। আঠারই ডিসেম্বর গহিরা চৌমুহনীতে আমরা জমায়েত হলাম। চারিদিকে উৎসবমুখর। হইহুল্লোড় স্লোগান। জয় বাংলা। আনন্দমুখর পরিবেশ। আমরা কয়েকজন জড়ো হলাম তাদের মধ্যে যাদের নাম মনে আছে শফিকুল আলম খান, কামাল মিয়া, আরো অনেকে নাম ভুলে গেছি। আমরা সবাই লুঙ্গি পরিহিত। লম্বা করে একজন ছিল তার নাম নুরুল আমিন এখন কোথায় আছে জানিনা সে ছিল শুধু প্যান্ট পরিহিত অবস্থায়। হঠাৎ আমাদের মনে হল আমরা সবাই চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হোটেল পরিদর্শন করবো এবং চা পান করব। এমন সময় আমরা মুন্সী মিয়ার জিপ গাড়ি পেলাম। সে সময় এ ধরনের জিপ গাড়ি গহীরা চৌমুহনী হতে ফটিকছড়ি তকিরহাট যাত্রী আনা নেয়া করতো। সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়াতো। গহিরা মাদ্রাসার পিছনে একটি বাড়ি নাম মনে নেই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সবাই মিলে সে বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম।
এ সমস্ত জিপ গাড়িগুলো সবখানে যাত্রী বসতে পারতো এমনকি ড্রাইভারের সামনে। পিছনে পাদানীতে দাঁড়িয়ে গাড়ির কন্টাকটার দিকনির্দেশনা দিত সে অনুযায়ী গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি চালাত। পুরানো উইলস কোম্পানির জীবগুলো বেশ মজবুত। স্বাধীনতা অর্থাৎ ৭০ দশকে চট্টগ্রাম শহরে আগ্রাবাদ হোটেল একমাত্র পাঁচতারকা হোটেল ছিল। আমরা শুধু তার গল্প শুনতাম, এখন আমাদের আকাঙ্ক্ষা গহিরা থেকে আগ্রাবাদ গিয়ে আমরা সেই হোটেলে দেখব। মুন্সি মিয়া খুব হাসি খুশি লোক ছিল। উনি ছিলেন হারুন পরিবারের ভক্ত। আমরা তাকে ধরলাম আমাদের আগ্রাবাদ হোটেলের নিয়ে যেতে হবে। হাসিমুখে তিনি রাজি হলেন। আমাদের পায়ে স্যান্ডেল ছিল না, লুঙ্গি পরে খালি পায়ে সবাই জিপ গাড়িতে বসলাম। একমাত্র নুরুল আমিন ভদ্র ভালো পোশাক পরা। এ সময় রাস্তাঘাট এত যানজট ছিল না। গহিরা থেকে ৪৫ মিনিটে আমরা বাসে করে শহরে চলে যেতাম ভাড়া ছিল এক টাকা। যাক মুন্সি মিয়ার জিপ গাড়িতে করে আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে আগ্রাবাদ হোটেলে চলে এলাম। বোধয় মোট ১০জন হবে। এই সমস্ত পোশাকে পড়ে আমরা আগ্রাবাদ হোটেলে রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসলাম। আমরা চেয়ারে বসতেই সবাই কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। একজন ওয়াটার এল সুট পরিহিত গলায় টাই পরা। তার দিকে আমরা তাকিয়ে রইলাম, তিনি বললেন আমরা কি খাব। জলের মাছকে ডাঙ্গায় তুললে যে অবস্থা, আমাদেরও সেই অবস্থা। পরস্পর মুখ চাওয়া করে বললাম চা খাব। কিছুক্ষণ পর সুন্দর টি পটে আমাদের চা চলে এলো। চিনিগুলো ছিল আলাদা পটে কিউব আকারে। এ ধরনের চিনি আমরা আগে দেখিনি। নুরুল আমিন বলল এগুলি চিনি চা তে মিশিয়ে দিতে হয়। নতুন উপায়ে আমরা সবাই চা পান করলাম। কেউ কেউ হোটেল দেখতে লাগল। অবশ্য আমাদেরকে কেউ বাধা দিল না। অবশেষে বিল এনে দিল মাত্র ১৫ টাকা। দশজনে খালি চা খেয়েছি। আমরা তো অবাক হয়ে গেলাম তখন চায়ের কাপ বাহিরে এক আনা বা ৬ পয়সা। আমরা একি অপরের মুখ দেখতে লাগলাম, নিজেরা মুক্তিযোদ্ধা, বিনা পয়সা খাব এ মনোবৃত্তি আমাদের ছিল না। সবাই পকেট কিছু কিছু বের হয়ে ১৫ টাকা হয়ে গেল। আমরা চায়ের বিল দিয়ে, জিপি করে আবার গহিরায় ফিরে এলাম। আমাদের ১৫ টাকা চলে গেছে, এ বেদনা আমাদের ছিল না। তবে আগ্রাবাদ হোটেল দেখে এলাম সে এক তৃপ্তি। কী যে আনন্দ। আহা কোথায় হারিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের সে আনন্দময় দিনগুলো।