লোহাগাড়ার আমিরাবাদ ইউনিয়নে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে টিআর (টেস্ট রিলিফ), কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) এবং কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় এমন কিছু প্রকল্প পাওয়া গেছে যেগুলোর কাজ কাগজে–কলমে সমাপ্ত। এসব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের টাকাও তুলে নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, প্রতি অর্থবছরে টিআর–কাবিখা কর্মসূচির অধীন গ্রামীণ পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে নগদ টাকা ও খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয় সরকার। এসব বরাদ্দে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সাথে সমন্বয় করে প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা হয়। এ কাজের তদারকি করেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নে তিন ধাপে টিআর–কাবিখা–কাবিটা দ্বারা উন্নয়নের জন্য ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন হয়। যার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৩টি প্রকল্পে ৪৩ লাখ ৩ হাজার টাকা এবং ৪টি প্রকল্পে ২৩ দশমিক ৭ মেট্রিক টন গম ও চাল। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে ১৮টি প্রকল্প। অন্য প্রকল্পগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর অধীনে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগেই নামমাত্র কাজ হয়েছে। তাছাড়া কিছু কিছু প্রকল্প আছে কেবল কাগজে। বাস্তবে কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। গত জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে।
গত ১৮ অক্টোবর সরেজমিনে দেখা যায়, আমিরাবাদ জালাল আহমদ সওদাগরের বাড়ির পুকুর পাড় সাইড ওয়াল নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ৩ দশমিক ১ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ হয়। ওই সাইড ওয়াল নির্মাণ না হওয়ায় পুকুরের সাথে সড়কটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আমিরাবাদ বাইর খালের বাঁধ নেয়াজ আহমদের বাড়ি অভিমুখে সড়ক সংস্কার প্রকল্পের জন্য ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। খালের বাঁধ আগের মতোই ভাঙা রয়ে গেছে। মাস্টারহাট খুলু হাজির পাড়া আরকান সড়ক উন্নয়নে বরাদ্দ ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। সম্প্রতি এই সড়কে কোনো উন্নয়ন কাজ হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। দক্ষিণ সাতকানিয়া গোলামবারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ সংস্কারের জন্য বরাদ্দ ২ লাখ টাকা। তবে এই প্রকল্পে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার কাজ দেখা যায়নি। আকবর হাট সড়ক সংস্কার ও ইটের রাস্তাকরণ প্রকল্পে ১০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মূলত সেটি এলইজিডির আইডিভুক্ত সড়ক। নিয়ম অনুযায়ী এলইজিডির সড়ক টিআর–কাবিখার বরাদ্দ দেয়া যায় না। উক্ত সড়কের বোয়ালিয়া খালের ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় আনুমানিক ৩০ ফুট সড়ক ইট দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে।
মূলত একাধিক প্রকল্প তালিকায় নাম থাকলেও কাজের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অনেক প্রকল্পে নামমাত্র কাজ দেখানো হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রকল্পে কাজ শুরুর আগে সাইনবোর্ড লাগানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করারও নির্দেশনা আছে। কিন্তু উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে কোনো প্রকল্প তালিকা পাওয়া যায়নি। প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও সাইনবোর্ড নেই।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের অনেক সদস্য মামলার আসামি হয়েছেন। তারা গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন। এই সুযোগ প্যানেল চেয়ারম্যান পরিষদের কাজে একক আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ পেয়েছেন। যার ফলে তালিকাভুক্ত অনেক প্রকল্পের কাজ হয়নি বা অর্ধেক করে পুরো অর্থ উত্তোলন করেছেন। কোথাও কোথাও কাজের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ বিল উত্তোলনের কাগজপত্র সম্পূর্ণ। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির কিছু সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পশ্চিম আমিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন জানান, প্রায় ২ বছর আগে বাহির খালের বাঁধ পানির স্রোতে ভেঙে যায়। স্থানীয়দের চলাচলের জন্য বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দিয়েছিলাম। পরে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকার চুক্তিতে সরু বাঁধ দিয়ে ভাঙা মেরামত করা হয়েছিল। পরে বর্ষায় পানির স্রোতের পুনরায় ভেঙে গেছে। বর্তমানে ওই সড়ক দিয়ে স্থানীয়দের চলাচল বন্ধ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমিরাবাদ ইউনিয়নের একাধিক সদস্য জানান, পরিষদে চলছে সুপরিকল্পিত লুটপাট। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের তালিকা, বাজেট ও হিসাব কাগজে ঠিক থাকলেও বাস্তবে তেমন কোনো কাজ হয়নি। ফলে প্রকল্পের অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের অন্যতম উৎস ট্রেড লাইসেন্স ও বাড়ির ট্যাঙ আদায়েও নৈরাজ্য চলছে। কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব রাখা হয় না বলে অভিযোগ করছেন তারা।
আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সব প্রকল্প নিয়ম মেনে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পে অনিয়মের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
লোহাগাড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোহাম্মদ নাহীদ আহম্মেদ জাকির বলেন, টিআর–কাবিখা প্রকল্পের কাজের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। তবে কোথাও যদি প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম হয়, সেটি খতিয়ে দেখা হবে। নির্দিষ্টভাবে কোন কোন প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে তার তালিকা দেন। এরপর সেসব প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন করব এবং অনিয়ম পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়া হবে। যে–কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।