বাংলাদেশি জাহাজের স্বার্থ রক্ষায় প্রণীত ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে এবার বিশ্বের শিপিং সেক্টর থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলাচলকারী কন্টেনার এবং রো রো ভ্যাসেল অপারেটরদের সংগঠন ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল (ডব্লিউএসসি) থেকে ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্টের কিছু ধারা ও শর্ত সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রীর কাছে জরুরি চিঠি দেয়া হয়েছে। আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য এবং নির্বিঘ্ন জাহাজ চলাচল নিশ্চিত করতে শর্তগুলো সংশোধনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
জানা যায়, দেশের সরকারি–বেসরকারি মালিকানাধীন দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০১৯ নামের একটি আইন রয়েছে। এই আইনের প্রেক্ষিতে বিদেশি জাহাজগুলোকে দেশের বন্দরের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে বাংলাদেশি আমদানি কিংবা রপ্তানি পণ্য পরিবহন করতে আগেভাগে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার (পিও–এমএমডি) থেকে অনুমোদন বা ছাড়পত্র নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) প্রিন্সিপ্যাল অফিসার বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) এবং বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশনগোয়িং শিপ ওনার্স এসোসিয়েশনের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট বন্দরে দেশীয় পতাকাবাহী কোনো জাহাজ নেই বা পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার সিডিউল নেই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই বিদেশি জাহাজকে পণ্য বোঝাইয়ের ছাড়পত্র বা ওয়েভার সার্টিফিকেট প্রদান করার আইন রয়েছে।
বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজ উপস্থিত বা ১৫ দিনের মধ্যে আসার সিডিউল থাকলে ওই পণ্য আর বিদেশি কোনো জাহাজ লোড করতে পারে না। অপরদিকে কোনো বিদেশি জাহাজ পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এলেও প্রচলিত আইনের কড়াকড়িতে ফিরতি পথে কোনো পণ্য না নিয়ে যাত্রা করতে বাধ্য হবে। অনেকগুলো জাহাজকে ইতোমধ্যে এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। একই সাথে ছাড়পত্র ইস্যু নিয়েও দেখা দেয় সমস্যা।
বিদেশি জাহাজগুলোর স্থানীয় এজেন্টদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাহাজে পণ্য বোঝাইয়ের ছাড়পত্র পেতে বেগ পেতে হয়। বিদেশি জাহাজগুলোকে ওয়ানওয়ে ছাড়পত্র দেয়া হয়, যাতে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো থেকে পণ্য বোঝাই করতে পারলেও ফিরতি পথের পণ্য বোঝাই করতে পারছে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ওয়েভার সনদ না পেয়ে একটি শিপিং কোম্পানি চট্টগ্রাম–কলম্বো রুট থেকে তাদের জাহাজ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিল। অপরদিকে ওয়েভার সনদ নিয়ে সৃষ্ট সংকটে বিদেশি একাধিক জাহাজকে জরিমানা গুনতে হয়েছে। সবকিছু মিলে বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে সংকট তীব্র হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল উদ্বেগ প্রকাশ করে জরুরি পত্র দিয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠনটির সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে অফিস রয়েছে। ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিলের সিঙ্গাপুর অফিস থেকে এশিয়া অঞ্চলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কেনেথ চিয়া স্বাক্ষরিত চিঠিতে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রীকে জরুরি ভিত্তিতে আইনটির বেশ কিছু ধারা ও শর্ত শিথিল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৫ দিন আগে সিডিউল দিয়ে ওয়েভার সনদ নেয়ার প্রসঙ্গে পত্রে বলা হয়েছে, যেখানে ৩/৪ দিনের ট্রানজিটে পণ্য পরিবাহিত হয়, সেখানে ১৫ দিন আগে থেকে বলে সনদ যোগাড় করা অসম্ভব।
উল্লেখ্য, দেশীয় মাত্র ৮টি কন্টেনার ভ্যাসেল রয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সাথে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও পোর্ট কেলাং মিলে অন্তত ৮০টির বেশি বিদেশি কন্টেনার জাহাজ চলাচল করে। এসব জাহাজের চলাচল নির্বিঘ্ন না থাকলে আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য দেশীয় ৮টি জাহাজ দিয়ে মোকাবেলা অসম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জরিমানা আরোপের কথা স্বীকার করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট দেশের প্রচলিত আইন। এই আইন মেনে বিদেশিদের শিপিং ব্যবসা করতে হবে। তারা আইন লংঘন করলে জরিমানাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিদেশিরা নানাভাবে হুমকি দিলেও ঠিকই ব্যবসা করতে আসবে। তিনি বলেন, আমাদের জাহাজ কম, এ কথা ঠিক। তবে ধীরে ধীরে জাহাজের সংখ্যা বাড়ছে। বিদেশি জাহাজের পাশাপাশি আমাদের জাহাজ শিল্পের বিকাশে এই আইন জরুরি ভূমিকা রাখবে।
ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিলের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, তারা প্রতিমন্ত্রী মহোদয়কে চিঠি দিয়েছে। নিশ্চয় তিনি চিঠিটির ব্যাপারে কথা বলবেন। দেশের স্বার্থে কী করা উচিত তা সরকার অবশ্যই ভাববে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল অনেক বড় একটি সংগঠন। অলাভজনক এই সংগঠন জাহাজ মালিকদের স্বার্থ দেখে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে পত্র দিয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে দর কষাকষি করবে। তবে দেশীয় জাহাজ শিল্পের স্বার্থে প্রণীত বিদ্যমান আইনের কড়াকড়ি আমাদের সার্বিক সমুদ্র বাণিজ্যকে ব্যাহত করবে। কারণ বিদেশি জাহাজগুলোকে বাদ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের সব পণ্য পরিবহন করতে ৯০টি ফিডার ভ্যাসেল লাগে। সেখানে দেশীয় মাত্র ৮টি জাহাজ দিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে না।