কিছুটা গতানুগতিক, আছে সাহসী পদক্ষেপও

বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে ভালো করছি বলব না এবারের বাজেট ব্যবসা ও জনবান্ধব, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা সহজ না

| বুধবার , ৪ জুন, ২০২৫ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বৈষম্যবিরোধী চেতনার বাজেটেও অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ রাখা যে ভালো কিছু হয়নি তা কবুল করলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল মঙ্গলবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, আমরা বলছি না যে খুব ভালো জিনিস করে ফেলছি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে। গত সোমবার ২০২৫২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ। সেখানে অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে সেজন্য পাঁচ গুণ বেশি কর দিতে হবে। রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন অর্থ উপদেষ্টা।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অনেকের একটা প্রশ্ন যেকালো টাকা সাদা করতে দেওয়া হল কেন। কালো টাকা কিন্তু ঠিক কালো টাকা না। আমরা যেটা বলেছি যেঅপ্রদর্শিত টাকা, কোনো কারণে যদি আপনার কাছে থাকে, শুধু ফ্ল্যাটের ব্যাপারে একটা বিধান দেওয়া হয়েছে। দুটো দিক আছে। একটা নৈতিক দিককালো টাকা সাদা করা, আরেকটা হল প্র্যাক্টিক্যাল দিকটাকাপয়সা আমরা ট্যাক্স পাব কিনা। দুই দিকেই কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে অবশ্যই কিছু সেটা আমরা বিবেচনা করব। পাচার হওয়া কালো টাকা ফিরিয়ে আনতে পারলে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে হত না বলে মন্তব্য করেন অর্থ উপদেষ্টা। খবর বিডিনিউজের।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা খুব সহজ কিন্তু না। কারণ, যারা পাচার করে, তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। লেয়ারিং করে টাকা পাঠায়। এগুলো শনাক্ত করা হচ্ছে। ১২টা উল্লেখযোগ্য কেইস নেওয়া হয়েছে, সময় লাগবে তবু কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে লম্বা সময় লেগেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বলছি যে একআধ বছর লাগতে পারে। প্রসেস শুরু হয়েছে। কালো টাকা পেলে বাজেট সাপোর্টটা হয়ত কম লাগত। আইএমএফের কাছে যেতে হত না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেটা পারিনি।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ, অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।

সংবাদ সম্মেলনে বাজেটের প্রসঙ্গ নিয়েও কথা বলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা যেসময় দায়িত্ব নিয়েছি, ক্ষমতা নিইনি। এবং দায়িত্বটা একটা কঠিন সময়ে, একটা চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়েছি, দেশের একটা ক্রান্তিলগ্নে। অনেকেই বলছে, আইসিউতে ছিল দেশটা। একটা খাদের কিনারে চলে আসছিল। সার্বিকভাবে আমি মনে করি, ভালোমন্দ আছে; আমি মনে করি আমরা একটা জনবান্ধব, ব্যবসায়বান্ধব বাজেট দিয়েছি। বাস্তবতা দেখতে হবে আপনাদেরকে। অনেক চাহিদা থাকে, কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাজেটটা যেন বাস্তবমুখী হয়, বাস্তবায়নযোগ্য হয়।

হঠাৎ করে অনেক সাহসী বাজেট দেওয়া সম্ভব ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, অনেকে বলে তোমরা তো আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছ। আগের ম্যাক্রো ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কআমরা ডিপার্চার করে নিয়ে গিয়ে দারুণ বিপ্লবী একটা বাজেট দিয়ে দেব, দারুণ রেভিনিউ আনব, এটা সম্ভব না। কিছুটা গতানুগতিক আছে, কিন্তু, একেবারে যে ইনোভেশন নেই তা না। কিছু সাহসী পদক্ষেপও আছে ট্যাঙের ব্যাপারে। আবার কিছুকিছু আর্থিক শৃঙ্খলাও আনতে চেষ্টা করেছি।

বাজেটে আরও সংযোজনবিয়োজনের সুযোগ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা তো বাজেট দিয়েছি গতকাল, এটা ওপেন থাকবে কিছুদিন। কিছুকিছু জিনিস আছে, সাজেশন আসবে বিভিন্ন জায়গা থেকে। আমরা চেষ্টা করব সেগুলো আমলে নিতে। তিনি বলেন, বাজেটের প্রতিপাদ্য বিষয় হল দেশে সবার জীবনযাপনকে আরও স্বচ্ছ করা মানুষের জীবনযাত্রার মানোয়ন্নন করা। সেজন্য আমরা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ওপরও নজর দিয়েছি।

বাজেট বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, বাইরের প্রত্যেকটা দেশ, প্রত্যেকটা এজেন্সি বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত ইতিবাচক ধারণা তাদের। প্রত্যেকের ইতিবাচক মনোভাব। এই মনোভাবকে আরেকটু সুসংহত করার জন্য আমাদের ভেতরে যারা আছেন তারা যেন একটু সহযোগিতা করেন। কিন্তু, আমরা যদি নিজেদের বলি, খারাপ হচ্ছে, কিছুই হচ্ছে না। যাচ্ছেতাই হচ্ছে দেশ, বাইরে গিয়ে তখন আমাদের আগে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে হয়। হ্যাঁ, ভিন্নমত থাকবে, কিন্তু দেশপ্রেম এবং দেশের মানুষের জন্য দরদ থাকলে কিছুটা সরকারকে সহযোগিতে করবেন, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

জিনিসপত্রের দাম মোটামুটি সহনীয় : দেশে বর্তমানে খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, আপনারা দেখবেন খাদ্যদ্রব্য ও বিভিন্ন জিনিসের মূল্য কিন্তু মোটামুটি সহনীয়। একেবারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছি না; নেমে গেছে, মোটামুটি সহনীয়। তিনি বলেন, ধরেন এক হাজার টাকা নিয়ে গেলেন, সেখানে সব জিনিসের দাম কমে গেছে এটা হয় না কোনোদিন। একটা বাড়বে, একটা কমবে…, আমার বাজেটের মধ্যে আছে কিনা সেটা। হ্যাঁ ডেফিনেটলি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকে, তখন বলবেন যে এমন বিপদে পড়লাম যেটা নিয়ে গেলাম সেটা দিয়ে কোনো কিছুই কিনতে পারলাম না। একটা একটা করে যদি দেখেন, পৃথিবীর কোনো দেশে হয় না প্রত্যেক জিনিসের দাম কমে গেছে বা প্রত্যেক জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। আমি বলছি না যে, বাজারটা ভালো। তবে জিনিসপত্রের দাম সহনীয়, বলেন তিনি।

বাজেট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খারাপ দিক’ বলে তো আমি বলব না। আমি বলি যে আরেকটু ভালো হত যদি সম্পদ আমরা বেশি পেতাম, আমাদের দেশীয় সম্পদ যদি বেশি, ট্যাঙ যদি আরও বেশি আদায় করতে পারতাম, ট্যাঙ যদি ফাঁকি না দেওয়া হত, ভ্যাট যদি ফাঁকি না দেওয়া হত, করাপশন যদি না থাকত দেশে, টাকাগুলো (পাচার হওয়া) যদি ফেরত আনতে পারতাম, তখন আমার এই বাজেট সাপোর্টও লাগত না আইএমএফ কিংবা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের। ওই টাকা দিয়ে কিন্তু আমরা পুরো বাজেটটাই করতে পারতাম। সেই দিক থেকে আমি মনে করি যে এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, খারাপ বলা ঠিক না, ‘লুক এট দ্য ফিলড সাইড অব এ গ্লাস’। গ্লাসের তো কিছু পানি আছে, তৃষ্ণার্তদের জন্য এই পানিটুকু থাক। খালি থাকলে তো মনে হবে কিছুই নাই। কিছু আছে, সেটার মধ্যে আমরা চেষ্টা করি যতটুকু।

সালেহ উদ্দিন বলেন, সময়ে কিন্তু দ্রুত যাচ্ছে। অনেকে কোরিয়ার উদাহরণ দেয় ২০ বছর আগে কোরিয়া কী ছিল, ২০ বছর পর কোরিয়ায় অলিম্পিক কোথায় গেল। আমরা কোরিয়া হতে বাধা কোথায়? সেজন্য আমরা সবার সহযোগিতা পেলে ডেফিনেটলি আমরা এগোব। আমরা তো সবসময় থাকব না। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। গ্রামের মেঠো রাস্তা আস্তে আস্তে কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে হাইওয়ে হয়। আমরা মেঠো রাস্তার পার হচ্ছি সরু হাইওয়ের দিকে যাচ্ছি। আস্তে আস্তে এটা প্রশস্ত হবে আগামী দিনে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংস্কার প্রত্যাশার সঙ্গে বাজেটের সাজুয্য দেখছে না সিপিডি
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলীতে জাহাজের রশি ছিঁড়ে দুই শ্রমিকের মৃত্যু