কিংবদন্তিতুল্য চট্টল অভিভাবক

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শুক্রবার , ৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সংগঠক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইয়ের প্রয়াণবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধ নিবেদিত। যে কোন সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্ম ও নেতৃত্বে দলীয় ক্ষমতায়ন বা সুসময়ের প্রেক্ষিতে নয়, বরং বিভিন্ন নির্যাতন-নিপীড়ন-যন্ত্রণা-বঞ্চনা সহ্য করে শাসক গোষ্ঠেীর সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে দলীয় দুঃসময়ে যিনি নিষ্ঠা-আন্তরিকতা ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন; তিনি যথার্থ অর্থে একজন পরিক্ষীত নেতার মর্যাদায় সমাসীন হন। পরবর্তিতে তাঁকে কেন্দ্র করে দলীয় কর্মীদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ এবং পরিচচ্ছন্ন্‌ রাজনীতির ধারা গতিশীল হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক রাজনীতির এক যুগসন্ধিক্ষণে আখতারুজ্জামান বাবু আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে তাঁর যাত্রার সূচনা করেন।
অভিন্ন জাতির সমাজ ইতিহাস বিশ্লেষণে কিছু প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তাঁদের অসাধারণ বীরত্বগাথার জন্য ইতিহাসে একটি অধ্যায় হয়ে যান। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস-দর্শন ও সামগ্রিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আখতারুজ্জামান বাবু নিজেকে এক অবিচ্ছেদ্য পান্ডুলিপি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বাঙালি জাতি সত্তার ইতিহাসে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিছক কোন ঘটনার ধারাবাহিকতা নয়, হাজার বছরের ইতিহাসে অতুজ্জ্বল এক অভাবনীয় অর্জন। এই অর্জনের নিকটতম পূর্বশর্ত ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু জয়যুক্ত হয়ে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ঐতিহ্যের দিক থেকে অতি প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রামের ইতিহাস নৈপুণ্য, বৈচিত্র ও সংগ্রামী চেতনায় সমৃদ্ধ। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন ্তুঈযরঃঃধমড়হম ঃড় ঃযব ভড়ৎব্থ অর্থাৎ ‘চট্টগ্রাম সর্বাগ্রে’। সমুদ্র বন্দরের কারণে প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকেও বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ছিল সুপ্রসিদ্ধ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীতে সকল আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নে চট্টগ্রামের অবদান স্বকীয় সত্তায় ভাস্বর। স্বর্গীয়/প্রয়াত যাত্রামোহন সেন, শেখ-এ চাটগাম কাজেম আলী, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, মাষ্টারদা সূর্য সেন, লোকনাথ বল, আবদুল হক দোভাষ, রফি উদ্দিন সিদ্দিকী, সিরাজুল হক, ডা. এম.এ. হাশেম, খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী, ব্যারিষ্টার আনোয়ারুল আজিম, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত ও পূর্ণেন্দু দস্তিদার, বাদশা মিয়া চৌধুরী প্রমুখ চট্টগ্রামের আর্থ- সামাজিক- রাজনৈতিক ইতিহাস সৃজনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
উল্লেখিত ধারাবাহিকতায় যাঁদের অবদান অরিস্মরণীয়, তাঁরা হলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম, আবদুস সাত্তার, পূর্ণেন্দু কানুনগো, শহীদ শেখ মোজাফফর আহম্মদ, মাহবুব- উল আলম চৌধুরী, আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, জননেতা এম.এ. আজিজ, আলহাজ্ব জহুর আহম্মদ চৌধুরী, ডা. আবু জাফর, এম আর সিদ্দিকী, এম.এ. হান্নান, এম.এ. মান্নান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আলহাজ্ব এ.বি.এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী, শহীদ মুরিদুল আলম ও মৌলভী সৈয়দসহ আরো অনেকেই চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে সামগ্রিক বিবেচনায় কিংবদন্তীর আসনে সমাসীন। এঁদের মধ্যে থেকে যাঁর অবদানকে স্বাধীনতার সময়কাল থেকে বিশেষ করে ১৯৭৫-এ ১৫ই আগস্টের পরবর্তী সময়ে আওয়ামী রাজনীতির দুঃসময়ে অনিস্বীকার্য, তাঁর নাম প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।
বস্তুতপক্ষে চট্টগ্রামের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর একনিষ্ঠ কর্মকান্ড এবং নির্ভীক অংশগ্রহণ তাকে বহুলাংশে স্বতন্ত্র চরিত্রের রাজনীতিক হিসেবে চিত্রিত করা যায়। মহান স্বাধীনতার মাস অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এম.আর.সিদ্দিক, জহুর আহম্মদ চৌধুরী, এম.এ. হান্নান, এম.এ. মান্নান ও অধ্যাপক মো: খালেদকে নিয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা থেকেই চট্টগ্রামের শীর্ষ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এম.আর. সিদ্দিকীর টাইগার পাসের বাসায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তানিদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা করছিলেন। রাত ১.০০ টার দিকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে জহুর আহম্মদ চৌধুরী বরাবরে একটি ওয়ার্লেস বার্তার মাধ্যমে বহু আকাঙ্খিত স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি পৌঁছুনোর পর পরই ২৬ শে মার্চ চট্টগ্রামকে চারটি সেক্টরে ভাগ করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের শহর এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয় জননেতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী, এম.এ. মান্নান ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা বেতারে প্রচার করার সিদ্ধান্ত হয় বান্ডেল রোডস্থ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বাসগৃহে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এম.আর.সিদ্দিকী, জহুর আহম্মদ চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। যদিও ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি বাংলা ও ইংরেজীতে প্রচার পত্রের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন স্থানে বিলি করা হয়। এই বিবেচনায় আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও তাঁর বান্ডেল রোডস্থ বাসভবন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অবস্থানে পরিণত হয়। পরবর্তীতে তার আবাসিক ভবন জুপিটার হাউজ ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক-গেরিলা কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা ও বৈঠকের কেন্দ্রস্থল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ আখতারুজ্জামান বাবুর ভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরী লাল সবুজের পতাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচিতিতে লাখ শহীদের একজন হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
মাটি ও মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তাদের সুখ-দুঃখের জীবন গাঁথায় আখতারুজ্জামান বাবু এমনভাবে অচ্ছেদ্য হয়ে আছেন, যে কারণে তাঁর জন্মস্থান বা নির্বাচনী এলাকা আনোয়ারা-পটিয়া আসনে সাধারণ জনগণের হৃদয়মাজারে চির নন্দিত হয়ে রয়েছেন। ১৯৭৫ পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে যথাযথ পথে পরিচালনা ও দলকে সুসংগঠিত করার ক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় সাংসদ নির্বাচিত হয়ে জনগণের কল্যাণে এবং এলাকার উন্নয়নে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বদান ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পর্ষদের সদস্য, শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক এবং ২০১১ সালে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের উঁচুমার্গে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৪৫ সালের ৩রা মে আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর গ্রামে জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। ১৯৫৮ সালে পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করে ঢাকার নটরডেম কলেজে ভর্তি এবং ১৯৬৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ (এসোসিয়েট) ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ভাই বশিরুজ্জামানের সাথে ব্যবসায় যোগ দেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামসহ পুরো বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব নেতৃত্বদানের জন্য দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যবসায়ী নেতার আসনে মর্যাদাসীন হন। তিনি দু’বার চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি ও ওআইসিভুক্ত ইসলামী চেম্বারের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী নেতা ও প্রতিনিধি হিসেবে বরেণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন।
চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে শিল্প বাণিজ্যের অগ্রগতিতে প্রয়াত এ.কে. খান, এম.এম. ইস্পাহানী, মির্জা আবু আহমদ, এম আর সিদ্দিকীসহ প্রমুখের ন্যায় আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। উল্লেখযোগ্য যে, বেসরকারী খাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও তার সার্থক পরিচালনায় আখতারুজ্জামান চৌধুরী এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশের বেসরকারী খাতের দ্বিতীয় ব্যাংক তথা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল) প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জনতা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডেরও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। দেশের একজন বরেণ্য ও নন্দিত রাজনীতিক হিসেবে নয়, একজন শিল্প উদ্যোক্তা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান বাবুর অবদান দেশবাসির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রগতিশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রিয় বাবু ভাই স্বাধীনচেতা, নির্ভীক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একজন পরিক্ষীত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দুর্জয় সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। স্বকীয় পটভূমি তৈরি করে গণতন্ত্রের মানসকন্যা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার একজন অতি বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আমি প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধইরান-তুর্কমেনিস্তানের গ্রুপে বাংলাদেশ