কাস্টমসে সিন্ডিকেটের বৃত্তে নিলামের গাড়ি!

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৯ জুন, ২০২১ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম কাস্টমসে বিভিন্ন ধরনের গাড়ির নিলামকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ, কাস্টমসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশ করে কোটি টাকার গাড়ি মাত্র কয়েক লাখ টাকায় কিনে নিয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। এই চক্রটির কারণে ২০১৬ সাল থেকে টানা চার বছর নিলামে তুলে বিক্রি করতে পারেনি কার্নেট ডি প্যাসেজ বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আসা বিলাসবহুল শতাধিক গাড়ি।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, যে চারবার বিলাসবহুল গাড়ি নিলামে তোলা হয়েছে, প্রত্যেকবার দাম উঠেছে গাড়ির সংরক্ষিত মূল্যের চার ভাগের এক ভাগ। অথচ বেশিরভাগ গাড়ির দাম কোটি টাকার উপরে। শুধু তাই নয়, নিলামে লেক্সাস গাড়ির মতো বিলাসবহুল গাড়ির সর্বোচ্চ দর উঠেছে মাত্র দুই লাখ টাকা, যা একেবারে অস্বাভাবিক।
কাস্টমসের নিলাম শাখা সূত্রে জানা গেছে, কার্নেট গাড়ির পরে বড় লটে আর গাড়ির নিলাম হয়নি। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন পণ্যের সাথে ৯টির মতো গাড়ি নিলামে তোলা হয়। এর মধ্যে ছয়টি জাপানি গাড়ি গত বছর মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় শেষ মুহূর্তে প্রত্যাহার করা হয়। যার টেন্ডার সেল নম্বর-৯/২০। প্রত্যাহার করা ছয়টি গাড়ি আজ বুধবার পুনরায় নিলামে তোলা হচ্ছে। গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে চারটি জাপানি টয়োটা এক্সিও। এর মধ্যে দুটি সিলভার রঙের ও দুটি সাদা, একটি টয়োটা প্রভোক্স ও একটি মিনি অ্যাম্বুলেন্স। এবারের নিলামে টয়োটা করোলা এক্সিও সাদা ও সিলভার রঙের প্রতিটি গাড়ির সংরক্ষিত মূল্য ধরা হয়েছে ১৯ লাখ ৬৬ হাজার ২৬০ টাকা। গাড়ি চারটি ২০১৪ সালে তৈরি। অন্যদিকে টয়োটা প্রভোক্সের সংরক্ষিত মূল্য ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৯ টাকা। টয়োটা মিনি অ্যাম্বুলেন্সের মূল্য ধরা হয়েছে ১১ লাখ ২৪ হাজার ৩১৫ টাকা। এছাড়া ৭৬ লট পণ্যও নিলামে তোলা হবে।
নিলামে গাড়ি সিন্ডিকেটের বিষয়ে নিলাম শাখার দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, আমদানিকারকের রিট মামলার কারণে গাড়ি খুব কমই নিলামে তোলা হয়। যেসব গাড়ি নিলামে তোলা হয়, সেগুলো ঘুরে ফিরে একই ব্যক্তিরা বিড করেন। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নিলামের স্থায়ী আদেশ অনুসারে, ৬০ শতাংশ দর না পড়লে বিক্রয় অনুমোদন দেয় না। ঠিক এই কারণে কোটি কোটি টাকার কার্নেট সুবিধায় আসা বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি করা যায়নি। বিডাররা লেঙাস গাড়ি কেনার জন্য সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন মাত্র ২ লাখ টাকা। যা হাস্যকরও বটে। ২ লাখ টাকায় একটা সিএনজি টেঙিও পাওয়া যায় না।
নিলাম শাখা সূত্রে জানা গেছে, কার্নেট সুবিধার বিলাসবহুল শতাধিক গাড়ি গত ২০১০-২০১১ সাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে। এসব গাড়ি ইনভেন্ট্রি করে প্রথম দফায় ২০১৬ সালের আগস্টে ৮৫টি গাড়ি নিলামে তোলা হয়। দ্বিতীয়বার ২০১৭ সালের মে মাসে ১১৩টি, তৃতীয়বার ২০১৮ সালের মে মাসে ১১১টি গাড়ি এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল চতুর্থবারের মতো ২২টি গাড়ি তোলা হয়। কিন্তু প্রতিবারই দামে অসামঞ্জস্য থাকায় গাড়ি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। শেষবারের নিলামে মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্র্যান্ডের মতো হাইপ্রোফাইল গাড়ির দাম উঠে মাত্র সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা। লেঙাস জিপের দর উঠেছিল ২ লাখ ৮ হাজার টাকা। এসব গাড়ি কম দামে কেনার জন্য নিলাম শাখার একটি সিন্ডিকেট কম মূল্য হাঁকান বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে কাস্টমসের নিয়মিত বিডার ও আরঅ্যান্ডএইচ সিন্ডিকেটের স্বত্বাধিকারী মো. ইকবাল হোসেন আজাদীকে বলেন, নিলামে সিন্ডিকেট হচ্ছে, এ তথ্যটি মোটেও সঠিক নয়। এখন ঢাকায় দরপত্রের বাঙ বসানো হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে একযোগে নিলাম হচ্ছে। তাই এখানে সিন্ডিকেট করার কোনো সুযোগ নেই। অনেক বিডারের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। তবে বিডের সময় আমরা কেউ কাউকে চিনি না। সিন্ডিকেট হয়েছে আজ থেকে ৪০ বছর আগে, এরশাদ সরকারের আমলে। তখন মৌখিক নিলাম হতো।
লেঙাস গাড়ির সর্বোচ্চ দর ২ লাখ টাকা ওঠা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনো বিডার ২ লাখ বিড করলে কাস্টমস তাকে গাড়ি দিয়ে দিচ্ছে না। প্রথমবার দর না পেলে পরেরবার নিলামে তোলার নিয়ম রয়েছে। নিলামের স্থায়ী আদেশে বলা আছে, প্রথমবার নিলামে তোলার পর যদি সংরক্ষিত মূল্যের ৬০ শতাংশ না ওঠে, তবে দ্বিতীয়বার নিলামে সেটি ৪৫ শতাংশ উঠলে দেওয়া যাবে। এখন কেউ প্রথমবার ২ লাখ টাকা বিড করলে পরেরবার সেটি বেশি বিড করতেও তো পারে। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃৃপক্ষ প্রত্যাশিত দর পাওয়া যায়নি বলে পরপর চারবার নিলাম বাতিল করে।
আর রেজার মালিক জহিরুল ইসলাম নাইম বলেন, কাস্টমসে নিয়মিত গাড়ির নিলাম হয় না। হাতে গোনা কিছু নিলাম হয়। অনেক গাড়ি আবার রিট মামলা থাকে। এখন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাস্টমসের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় বিডারদের। সিন্ডিকেটের বিষয়টি বারবার উঠে আসছে, সেটি অবান্তর ও অযৌক্তিক। প্রত্যেক বিডার স্বাধীনভাবে ব্যবসা করছেন।
অপর বিডার মোহাম্মদ ইয়াকুব চৌধুরী বলেন, নিলামে সিন্ডিকেটের কথা শুনে আসছি অনেক দিন ধরে। এটি পাবলিকের ভ্রান্ত ধারণা। এখন অনেক জায়গায় দরপত্রের বাঙ বসানো হয়। যার যেখানে ইচ্ছা সেখানে দরপত্র ফেলছেন। ৬০ শতাংশ মূল্য কাভার হলে কাস্টমস থেকে বিক্রি অনুমোদন পাচ্ছেন, না উঠলে পাচ্ছেন না। এখানে সংঘবদ্ধভাবে কিছু করার সুযোগ কম।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলাম শাখার উপ-কমিশনার মো. আল আমিন বলেন, নিলামের স্থায়ী আদেশ মেনে আমরা নিলাম কার্যক্রম চালাচ্ছি। আমি শাখায় নতুন যোগ দিয়েছি। কোনো সিন্ডিকেটের বিষয় আমার জানা নেই।
উল্লেখ্য, কাস্টমসে আজ দুপুর আড়াইটায় ছয়টি জাপানি গাড়িসহ ৭৬ লট পণ্য নিলামে তোলা হচ্ছে। গাড়ি ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিট ও ওভেন ফেব্রিঙ, হাইড্রোলিক অ্যাসিড, গৃহস্থালীর সরঞ্জাম, ফিনিশিং এজেন্ট, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, কার্টন অ্যাকসেসরিজ, টেঙটাইল কেমিক্যাল, যন্ত্রাংশ, ওয়াশিং কেমিক্যাল, পেঁয়াজ, ড্রাগন ফ্রুট, ফুটওয়্যার ও ব্যাটারি লিড।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিদিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার খবর জানবে নগরবাসী
পরবর্তী নিবন্ধঋণ নিতে গিয়ে জানলেন তিনি মৃত