কাল থেকে লকডাউন

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

মহামারী সামাল দিতে আবার ‘লকডাউনের’ ঘোষণা আসছে। আগামীকাল সোমবার ভোর ৬টা থেকে ৭ দিনের জন্য লকডাউন থাকবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সোমবার থেকে সারা দেশে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল শনিবার ঢাকায় নিজের সরকারি বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন সেতুমন্ত্রী কাদের। তবে সেই লকডাউনের ব্যাপ্তি কী হবে, কী কী খোলা থাকবে আর কী কী বন্ধ, তা সরকারের ঘোষণায় বিস্তারিত জানা যাবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এক ভিডিও বার্তায় লকডাউন পরিকল্পনা নিয়ে কিছুটা আভাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ায়, সংক্রমণ রোধ করার স্বার্থে সরকার দু-তিন দিনের মধ্যে সারা দেশে এক সপ্তাহের লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে লকডাউন চলাকালে শুধু জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আর শিল্প কলকারখানা খোলা থাকবে, যাতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন শিফটে কাজ করতে পারে। খবর বিডিনিউজ ও বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার।
এদিকে লকডাউন ঘোষণার প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। শনিবার রাতে বা আজ রোববার সকালের দিকে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। গতকাল লকডাউনের রূপরেখা তৈরিতে জরুরি বৈঠক শেষে এসব তথ্য জানা গেছে। আগামীকাল সোমবার ভোর ৬টা থেকে পরবর্তী ৭ দিনের জন্য লকডাউনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্পকারখানা পরিচালনারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
বৈঠকে লকডাউনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। চূড়ান্ত করা হয়েছে লকডাউন বাস্তবায়নের কৌশল। এছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হলে সেখানে শ্রমিকরা কীভাবে কারখানায় আসবে এবং কীভাবে কাজ করবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষ করে কৌশলও চূড়ান্ত হয়েছে।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত বছর ২৩ মার্চ প্রথমবার ‘সাধারণ ছুটির’ ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। শুরুতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ছুটি’ ঘোষণা হলেও পরে তার মেয়াদ বাড়ে কয়েক দফা। সে সময় সব অফিস আদালত, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছুটির মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকার সেই পরিস্থিতি ‘লকডাউন’ হিসেবে পরিচিত পায়।
কিন্তু তাতে নিম্নবিত্তের জীবন-জীবিকা আর দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়লে বিভিন্ন মহলের দাবিতে সরকার ৩১ মের পর থেকে ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ শিথিল করতে থাকে। বছরের শেষে এসে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা ছাড়া আর সব কড়াকড়িই উঠে যায়।
ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রেখেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার ভাবনা থেকে মাঝে পুরো দেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপের পরিকল্পনা হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি এলাকায় সেই ব্যবস্থা চালানোও হয়েছিল। কিন্তু পরে আর তা এগোয়নি।
এদিকে নতুন বছরের শুরুরে দেশে সংক্রমণ হার অনেকটা কমে আসে। সারা দেশে শুরু হয় করোনাভাইরাসের গণ টিকাদান। কিন্তু মার্চের শুরু থেকে দেশে আবার নতুন রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৬ হাজার ৮৩০ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে, যা মহামারী শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ।
দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪ জনে। তাদের মধ্যে মোট ৯ হাজার ১৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংক্রমণে লাগাম দিতে ২৯ মার্চ সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ সকল ক্ষেত্রে সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করাসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি হয়। এরপর সেগুলো বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ির ঘোষণা আসতে থাকে।
সেদিন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, গতবারের মতো ‘সাধারণ ছুটি’ দেওয়ার কোনো আলোচনা হয়নি। তবে তার এক সপ্তাহের মাথায় নতুন করে লকডাউনের সিদ্ধান্তের খবর দিলেন তিনি।
কেমন হবে এবারের লকডাউন : দ্রুত বাড়তে থাকা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সামাল দিতে এক সপ্তাহের ‘লকডাউনের’ খবর এলেও তার ধরন কেমন হবে তা স্পষ্ট হয়নি এখনও। এবার কী কী খোলা থাকবে, কতটা কড়াকড়ি হবে সেসব প্রশ্ন ঘুরছে সব মহলে।
এই লকডাউন গত বছরের সাধারণ ছুটির মতো হবে নাকি মিরপুরের টোলারবাগ বা অন্য এলাকায় যেভাবে সবকিছু বন্ধ ছিল এবং চলাচল নিয়ন্ত্রিত ছিল তেমন হবে তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
লকডাউন কেমন হতে পারে সেই প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে মানুষ মনে করে ছুটি হয়েছে, ঘুরতে চলে যায়। এ কারণে এবার লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সবাইকে ঘরে থাকতে হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সংক্রমণ বাড়তে থাকায় জাতীয় কমিটির পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আংশিক লকডাউনের পাশাপাশি পুরো লকডাউনের সুপারিশও ছিল।
সংক্রমণ পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে গেলে লকডাউন দেওয়ার চিন্তা সরকারের আগেই ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে ১৮ দফা যে প্রস্তাব করা হয়েছিল তা অনেক ভেবেচিন্তে, অনেকের পরামর্শ নিয়ে করা হয়েছে। সরকার শুরুতে সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি। এখন আস্তে আস্তে কঠোর হচ্ছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, অতিরিক্ত ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় লকডাউনের ব্যাপারে তারাও সুপারিশ করেছিলেন। তবে তা দেশজুড়ে করার প্রস্তাব ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৮ দফা প্রস্তাবের একটা ছিল কিছু এলাকায় আংশিক লকডাউন। আমরা বলেছিলাম হয় আংশিক, নয় মোডিফাইড লকডাউন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যদি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে ওই ব্যক্তির পুরো বাড়ি বা ফ্ল্যাটকে দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউন করে ফেলা। এই সময় বাইরের সঙ্গে মেলামেশা পুরো বন্ধ রাখতে হবে। তাদের দৈনিক প্রয়োজন বাইরে থেকে মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটাকে তারা মোডিফায়েড লকডাউন বলছেন।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, লকডাউনের যে ঘোষণা এসেছে, সেটি ‘টার্গেটেড’ না ‘ব্ল্যাংকেট’ তা এখনও স্পষ্ট নয়। যেখানে অনেক মানুষের ভিড় হয়, সেখানে সংক্রমণ বেশি ছড়ায়। সেখানে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা এবং কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধির আওতায় নিয়ে আসা হলো টার্গেটেড পদ্ধতি। সারা দেশে যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ঘরে রাখা হলো ব্ল্যাংকেট অ্যাপ্রোচ। শেষ উপায় হিসেবে সরকার এ পন্থায় যেতে পারে।
ক্যামব্রিজের পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই বিশেষজ্ঞ বলেন, নিয়ন্ত্রণ করতে যদি নাই পারি, সেখানে ব্ল্যাংকেট দিতে হবে। কিন্তু এটাই একমাত্র সমাধান না। কারণ এটা এক সময় তুলে নিতে হবে। এ কারণে টার্গেটেড পন্থা অনুসরণ করে তা অনেকদিন ধরে চালাতে হবে। এ ধরনের লকডাউন দিলে নিম্নআয়ের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। না হলে তারা খাদ্যের জন্য বাইরে বেরিয়ে যাবে। তখন আমরা কেউ নিরাপদ থাকতে পারব না। এটা সফল হবে না, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।
লেনদেনে সমস্যা হবে না : বিএসইসি
মহামারী সামাল দিতে লকডাউনের ঘোষণা এলেও দেশের বিনিয়োগকারীদের লেনদেনে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ব্যাংক চললে পুঁজিবাজারও চলবে বলে গতকাল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ঢাকা স্টক এঙচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এঙচেঞ্জের (সিএসই) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও ৪৬৭ জন শনাক্ত
পরবর্তী নিবন্ধঅনুমোদনহীন ডে-কেয়ার সেন্টার চলবে না