কারো প্ররোচনা, কারো উন্মাদনা এবং একজন জোলালির গল্প
লোকটির প্রকৃত নাম কী ছিল তা এখন মনে নেই। গ্রামের সবাই তাকে জোলালি বলে ডাকত। ছোটবেলায় যখন গ্রামে যেতাম, দেখতাম জোলালি বলে ডাকলেই লোকটি খেপে যেত। দুষ্টু ছেলেরা লোকটিকে সারাদিনই খেপাতো। কেউ হয়ত তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে খুব আস্তে করে উচ্চারণ করল জোলালি। ব্যস শুরু হয়ে যেতো অশ্রাব্য, অশ্লীল খিস্তিখেউড়। অনেকে দূর থেকে বলে উঠল জোলালি! অমনি শুরু হতো তার গালাগাল। গ্রামের বড়রা ছোটদের ধমক দিয়ে বারণ করত বটে তবে আড়ালে তারাও এই খ্যাপাটেপনা উপভোগ করতেন বলে আমার মনে হতো। এটি একটি নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। জোলালি বললে তিনি কেন খেপে যেতেন তার ইতিহাস জানা হয়নি কখনো। এই ধরণের লোক শুধু আমাদের গ্রামেই নয়, খেয়াল করলে সারাদেশেই চোখে পড়বে। এটি একটি মানসিক রোগ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এত বছর পর সেই জোলালির কথা কেন মনে পড়ল তা পরে লিখব।
এর মধ্যে এক সংসদ সদস্যের বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে নানাস্থানে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন ২ নভেম্বর একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে হত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ পৌরসভার আমিনপুর মাঠে হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর জীবন ও কর্ম শীর্ষক আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বক্তব্য প্রদানকালে সাংসদ বলেন, ‘ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে কাছে পেলে তাঁকে আমি হত্যা করে ফাঁসির মঞ্চে যেতে চাই’। অনুষ্ঠানের আয়োজকও ছিলেন জাতীয় পার্টির টিকেটে নির্বাচিত এই সাংসদ যিনি পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব। লিয়াকত হোসেন একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে ফ্রান্সের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্জন করারও আহবান জানান।
সংসদ সদস্য মানে আইনসভার সভ্য। অর্থাৎ আইনপ্রণেতা। একজন আইনপ্রণেতা হয়ে প্রকাশ্যে একটি দেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যার হুমকি দেওয়া যায় কি-না সেটি ভেবে দেখার বিষয়। এমন আচরণকে কোনোভাবেই সভ্য আচরণ বলে আমরা ধরে নিতে পারি না। এ বিষয়ে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘একজন সাংসদ কেন, কোনো সাধারণ নাগরিকও এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারে না। এতে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। বিষয়টি তাঁর দল এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেখা উচিত।’
অন্য দেশে সংঘটিত কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় একজন আইন প্রণেতা যখন এমন আচরণ করেন তাহলে সাধারণ নাগরিক কী করতে পারেন তার নজির আমরা দেখলাম কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায়।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, উপজেলার পুরব (পূর্ব) ধইর ইউনিয়নের কোরবানপুর গ্রামের এক ব্যক্তি ফ্রান্সে থাকেন। তিনি ও স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাদের ফেসবুক আইডি থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনকে সমর্থন করে পোস্ট ও কমেন্ট করেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। স্থানীয় বিভিন্নজনের হাতে ফেসবুকের যে স্ক্রিনশটটি ছড়িয়েছে, তাতে দেখা যায় ফ্রান্স প্রবাসী ওই ব্যক্তি একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘ফরাসি প্রেসিডেন্ট যে সব অমানবিক চিন্তাভাবনাকে শায়েস্তা করার উদ্যোগ নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়’। আর তাতে ওই প্রধান শিক্ষক মন্তব্য লিখেছেন, ‘স্বাগতম প্রেসিডেন্টের উদ্যোগকে’। (সূত্র বিডিনিউজ)। তোতা ভুঁইয়া ও আলাদিন মৃধা নামে দুজন বিডিনিউজের জিজ্ঞাসায় বলেন,’ তারা ফেসবুকের স্ট্যাটাসে দেখেননি। তবে অন্যদের কাছে শুনেছেন।’ এরপর সেখানে যা ঘটেছে তা দেশে নতুন নয়। কঙবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং অতি সমপ্রতি লালমনিরহাটে সংঘটিত নৃশংস ঘটনারই ধারাবাহিকতা তা।
গত রোববার ১ নভেম্বর দুপুরের পর চেয়ারম্যান বন কুমার শিবের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বাদ যায়নি তার ভাইয়ের বাড়িও। সে সাথে হিন্দুদের আরও কয়েকটি বাড়িতে তাণ্ডব চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রায় দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এলেও হামলাকারীদের বাধায় ঢুকতে পারেনি আগুন নেভাতে।
লুটপাট-ভাঙচুর শেষে আগুন নিয়ে বসতভিটা পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার পর হামলাকারীরা যখন চলে যায় তখন আসে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। স্থানীয়রা বলছেন, আগের দিন মাইকিং করে আশেপাশের গ্রাম ও ইউনিয়ন থেকে শত শত মানুষ জড়ো করা হয়েছিল। এমন ঘটনা তারা আগে কখনো দেখেননি বলে জানান। পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় বাসিন্দা ও ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছেন, পরিকল্পনা করেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। একই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে পাঁচ বছর আগে। নাসিরনগরের ঘটনার বেলায়ও যেমন পুলিশ তথা প্রশাসনের গাফেলতি ছিল মুরাদনগরের ঘটনায়ও একই অবহেলা পরিলক্ষিত হয়।
রামু থেকে মুরাদনগর পর্যন্ত এ ধরনের যত ঘটনা ঘটেছে তার ধরণ একই হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ঘটনা ঘটানো হচ্ছে একই কায়দায়। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিতও করা যাচ্ছে, এদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছেন কিন্তু সঠিক বিচার হয়নি এখনো। যে কারণে এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটানোর সাহস পাচ্ছে অনেকে। এই ঘটনার মাত্র তিনদিন আগে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে হত্যা এবং পরে তাকে পুড়িয়ে ফেলার মতো মধ্যযুগীয় ঘটনাও ঘটেছে। যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি একজন মুসলিম। নামাজ পড়ার জন্য তিনি মসজিদে গিয়েছিলেন। এটি কিংবা মুরাদনগরের ঘটনা কিন্তু শেষ ঘটনা নয়। যে কোনোদিন, যে কোনো সময় বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেও কেউ যদি কারো বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মতো অভিযোগ আনেন তাহলে সে ব্যক্তির যেকোনো সময় জীবনহানি হতে পারে। অর্থাৎ তাকে হত্যা করতে পারে। আর সে নির্মম কাজটি করার জন্য সমাজে মুখিয়ে আছে বহুলোক।
মুসলমানদের মধ্যে এমন অসহিষ্ণুতা দিনদিন এত বাড়ছে কেন? শুধু বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশেই নয় বিশ্বের দেশে দেশে এক শ্রেণির মুসলিমের অতি অসহিষ্ণুতার লক্ষণ খুব নগ্ন ও নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এ কারণে উদার ও সহনশীল মনোভাবের মুসলিমরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন।
সমপ্রতি ফ্রান্সের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী তোলপাড় চলছে। দু-চারদিন তা মার্কিন নির্বাচনের ডামাডোলে চাপা পড়ে গেলেও অচিরেই তা আবার বেরিয়ে আসবে এবং তার প্রতিক্রিয়া আরও কিছুদিন চলতে থাকবে সন্দেহ নেই। ফ্রান্সে কী ঘটেছিল তার সামান্য তুলে ধরে বিস্তারিত আলোচনায় যাব।
গত মাসের শুরুর দিকে ফ্রান্সের একটি শহরের এক স্কুল শিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করে এক যুবক। পরে জানা যায় সে যুবক ফ্রান্সে আশ্রয় লাভ করা এক চেচেন মুসলিম। এই শিক্ষক কয়েকদিন আগে ক্লাসে বাক স্বাধীনতা বা ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ বিষয়ে পড়াতে গিয়ে বিখ্যাত কয়েক ব্যক্তির ব্যঙ্গ কার্টুন দেখান। সেখানে একটি ছিল ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর। এ ঘটনার পর স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া হয়। তারা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশও করেছিল। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ওই শিক্ষককে গলাকেটে হত্যার পর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ফ্রান্স জুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সের জনগণ প্রচণ্ড ক্ষোভ ও নিন্দায় সরব হয়ে উঠেছেন। ঘটনার পরপরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ঘটনাকে ‘ইসলামী সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এরপর নিস শহরের একটি গির্জায় সন্ত্রাসী হামলায় তিনজনের মৃত্যু হয়। সৌদি আরবে ফরাসি দূতাবাসের এক ব্যক্তির ওপর হামলা চালানো হয়।
অবশ্য হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে ফ্রান্সে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ নতুন ঘটনা নয়। এর আগে রম্য ম্যাগাজিন শার্লি এব্দোতে মহানবীর (সা.) এর ব্যঙ্গচিত্র আঁকায় ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি পত্রিকা অফিসে হামলা চালানো হয়েছিল এবং তাতে কার্টুনিস্টসহ ১২ জন নিহত হয়েছিলেন। স্কুল শিক্ষককে গলা কেটে হত্যার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ সমুন্নত রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ইসলামী উগ্রবাদ নিয়ে বক্তব্য রেখে মুসলিম বিশ্বে দারুণভাবে সমালোচিত হচ্ছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমরান খান ফরাসি প্রেসিডেন্টকে অত্যন্ত কড়া ও কটু ভাষায় আক্রমণ করেছেন। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ এ বিষয়ে নীরব রয়েছে বরং সংযুক্ত আরব আমিরাতের এক মন্ত্রী ফরাসি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সমর্থনই করেছেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে গ্রহণ করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার গারগাস সোমবার এক জার্মান গণমাধ্যমকে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, মুসলিমদের ম্যাক্রোঁর বক্তব্য ভালোভাবে শোনা উচিত। তিনি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দিতে চাননি এবং তিনি ঠিকই বলেছেন।
তবে ফ্রান্সের এই ঘটনা দুটো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমটি হলো, বাকস্বাধীনতার নামে কারো ধর্মীয় অনুভূতি তথা ধর্মবিশ্বাসকে ব্যঙ্গ করা যায় কি না? আর অন্যটি হলো, ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাকে হত্যা করা যায় কি না?
ফরাসি বিপ্লব তথা রেনেসাঁ পরবর্তীকালে ইউরোপের দেশগুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সেখানে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব ছিল ফরাসি বিপ্লবের মূল স্লোগান। শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট তার দেশে বাস করা মুসলিমদের উদ্দেশে সে কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, বিপ্লবের আদর্শ থেকে ফ্রান্স বিচ্যুত হবে না। পরে আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা স্বীকার করে বলেছেন, যেহেতু ফ্রান্স মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে সেহেতু একটি বেসরকারি পত্রিকার বিষয়ে রাষ্ট্রের বেশি কিছু করার নেই। একটি পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বোঝাতে গিয়ে সেদিন ভূগোলের শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ক্লাসের মুসলিম শিক্ষার্থীরা বিব্রত হতে পারে ভেবে তাদের ক্লাস না করারও অনুমতি দিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো স্যামুয়েল যদি ধারণা করেই থাকেন যে, এমন একটি কাজে মুসলিম শিক্ষার্থীরা বিব্রত হতে পারে তাহলে তাঁকে সামান্য সংযত হওয়া উচিত ছিল। কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে একজন ধর্মপ্রচারকের ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা থেকে তিনি কৌশলে বিরত থাকতে পারতেন। কারণ ইসলাম ধর্মের প্রবর্তকের ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল মাত্র ৫ বছর আগে তা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। একজন রাজনীতিক বা সেলিব্রিটিকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা আর একজন ধর্মপ্রচারককে নিয়ে ব্যঙ্গ করার ফল এক নাও হতে পারে। ফ্রান্সে হয়েছেও তাই। কাজেই শুধু ইসলামের নবীই নয় যে কোনো ধর্মের প্রবর্তক বা প্রচারককে নিয়ে ব্যঙ্গ করা থেকে বিরত থাকা শ্রেয়। মনে রাখা দরকার, ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস। সেখানে যুক্তিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। যারা ধর্মে বিশ্বাস করে তারা এসব জেনেশুনে এবং বুঝেই করে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা থাকাটাও দরকার। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেন কোনো জনগোষ্ঠীর মর্যাদাকে খাটো না করে সে বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার।
তবে একটি কথা এ প্রসঙ্গে বলতেই হবে যে, অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের চেয়ে বর্তমান সময়ে ইসলাম ধর্ম অনুসারীরা অধিকতর অসহিষ্ণু এবং প্রতিক্রিয়াশীল। এরা অন্য ধর্মের প্রতি তো অসহিষ্ণুই এমনকি নিজ ধর্মের ভিন্নমত বা ভিন্ন তরিকার লোকদের প্রতিও অসহিষ্ণু এবং নিষ্ঠুর। আমি নিজেই একজন ইসলাম ধর্মানুসারী হিসেবে প্রত্যক্ষ করছি যে, বিশ্বের কোনো ধর্মাবলম্বীর সঙ্গেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সদ্ভাব নেই, যদিও ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলা হয়ে থাকে। (ইতিহাসের দিকে দৃকপাত করলে আমরা দেখতে পাবো প্রায় প্রতিটি ধর্মই একটি পর্যায়ে অত্যন্ত এঙট্রিমিটি অধ্যায় অতিক্রম করে। সেটি ইউরোপে হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের আগে পর্যন্ত। এমনকি এই উপমহাদেশেও সম্রাট অশোকের পরে সনাতন ধর্মের এঙট্রিমিটি কমতে শুরু করেছিল। আমার ধারণা বর্তমানে ইসলাম ধর্ম এমন একটি অধ্যায় পার করছে।
এই মনোভাবের কারণেই ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতে ইদানীং ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব দৃঢ় হচ্ছে। স্থানীয়দের মধ্যে বর্ণবাদের মতো চরম মতাদর্শ বিকাশ লাভ করছে। মুসলিমরা উন্নত ও নিরাপদ জীবন, নিজের ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। স্থায়ী হওয়ার জন্য মরণপণ চেষ্টা করছে। স্থায়ী হয়ে সেসব দেশের সমস্ত সুযোগসুবিধা ভোগ করছে কিন্তু সে দেশ, দেশের জনগণ ও সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে পারছে না, গ্রহণ করতে পারছে না। পশ্চিমা দেশের খোলামেলা জীবনযাপন মেনে নিতে না পারলেও তারা সেখানেই বসবাস করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে না।
অথচ এই মুসলিমরাই বসবাসের জন্য অন্য উন্নত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে বেছে নেয় না। উন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অন্যদেশের মুসলিমদের নিজ দেশে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ দেয় না। অন্যদিকে ইহুদি-নাসারার দেশ বলে মুসলমানদের কাছে নিন্দিত দেশগুলোই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্যদেশের লোকদের পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া থেকে শুরু করে চাকরি ও ব্যবসায় সুযোগ করে দেয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর আইনগত জটিলতা না থাকলে নাগরিকত্ব ও কাজের অনুমতি দেয় এবং সবশেষে নিজদেশের নাগরিকদের মতো সবধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। এর পরিবর্তে একদল মুসলমান সে দেশের প্রতি এবং সেদেশের নাগরিকের প্রতি প্রকাশ্যে ঘৃণা প্রদর্শন করে। এবং অনেকে সে দেশকে তার নিজ ধর্মমতে চলার দাবিও জানিয়ে থাকে। অর্থাৎ সে দেশের প্রচলিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। এর প্রতিক্রিয়ায় এখন পশ্চিমাদেশে মুসলিমবিদ্বেষ বাড়ছে। ফ্রান্সের ঘটনা তাতে আরও ঘি ঢেলে দেবে। ভবিষ্যতে এসব দেশে মুসলিম অভিবাসীরা আরও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। সহিংসতা আরও সহিংসতার জন্ম দেবে।
বাংলাদেশের মুসলিমরা নিজ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চায় না অথচ পশ্চিমা দেশে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার সুযোগ ঠিকই গ্রহণ করে। অনেক ক্ষেত্রে সেসব দেশের উদারতার সুযোগ নিয়ে ইসলামী সংস্কৃতি, যা মূলত মধ্যপ্রাচ্যেরই সংস্কৃতি তা চালু করার দাবি তোলে।
শুরুতে একজন জোলালির গল্প বলেছিলাম। পশ্চিমারা মুসলিমদের জোলালিতে পরিণত করেছে। মাঝেমধ্যে কিছু একটা করে আর জোলালির খেপামো দেখে। মুসলমানদের নিজেদের স্বার্থে আরও সহনশীল আচরণ করা দরকার। সহিংসতার পথ পরিহার করে শান্তি ও সহাবস্থানের পথ বেছে নেওয়া দরকার। এই ধরনের আচরণ অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে মুসলমানের ভাষায় ইহুদি-নাসারাদের দেশে মুসলমানদের বাস করা কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক