কাল আজকাল

বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে জামায়াতে ইসলামী

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১ আগস্ট, ২০২৪ at ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ

ধার্মিকতা ও আধ্যাত্মিকতা এক জিনিস নয়। যদিও প্রতিটি ধর্মে আধ্যাত্মিকতার কথা বলা হয়। একজন মানুষ কোনো প্রথাগত ধর্ম পালন না করেও আধ্যাত্মিকতায় ঋদ্ধ হতে পারেন, আধ্যাত্মিকচর্চা করতে পারেন। যেমন ফকির লালন শাহ। তিনি কোনো প্রথাগত ধর্মের অনুসারী ছিলেন না কিন্তু ঈশ্বরের বন্দনা করে গেছেন। ঈশ্বরকে পরমাত্মা ভেবে তাঁর প্রতি আত্মবিসর্জনের আহ্বান করেছেন। বাউলরা সবাই নির্দিষ্ট ধর্মের অনুশাসন না মেনেও আধ্যাত্মিকচর্চা করে থাকেন। অন্যদিকে কোনো একটি ধর্মের অনুসারী হলেও অনেকে আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ নাও হতে পারেন। এটার ব্যাখ্যা পরে দিচ্ছি।

ভারতের আজমির শরীফে গিয়ে অনেকে শান্তি পান আবার অনেকে সেখানে ইসলাম ধর্মের বিকৃতি দেখতে পান। একই ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার শরীফের ক্ষেত্রেও। সেখানে গিয়ে অনেকে বলেন, এখানে তো অনৈসলামিক কাজ চলছে। আসলে কি তাই? আজমির শরীফ, মাইজভান্ডার শরীফে গিয়ে ধর্ম খুঁজলে বোকামি হবে। সেখানে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষ আধ্যাত্মিকতার টানে ছুটে যায়। সেখানে প্রথাগত ধর্ম গৌণ হয়ে আধ্যাত্মিকতা ও মানবধর্ম মুখ্য হয়ে ওঠে।

মূলত এই উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল সুফিবাদের পথ ধরে। খাজা বাবা মঈনুদ্দিন চিশতি ভারতে এসে যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন তখন তিনি ইসলামের উদারতা, সহনশীলতা এবং পরমতসহিষ্ণুতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সে সময় ভারতে হিন্দু ধর্ম তথা সনাতন ধর্মে বর্ণবাদ চরম আকার ধারণ করছিল। প্রান্তিক ও দলিত শ্রেণি যারা উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছিলেন তারাই দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন প্রধানত ইসলাম ধর্মে জাতপাতের বাড়াবাড়ি না দেখে এবং সব মানুষের সমমর্যাদায় আকৃষ্ট হয়ে। শুধু এটা নয়, মঈনুদ্দিন চিশতিও ইসলাম প্রচারের বেলায় সতর্ক ছিলেন ভারতবর্ষের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি যথাযথ সম্মান বজায় রাখতে।

শুধু তিনি নন, মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুসলিম শাসকরাও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি একমাত্র আওরঙ্গজেব ছাড়া। একজন উদারনৈতিক বাদশা আকবর ভারতে যেভাবে ধর্মীয় সহনশীলতা বজায় রেখে মোঘল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন ঠিক তার উল্টোটি করে আওরঙ্গজেব ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের অধপতনের শুরুটা করেছিলেন। তবে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, সুদূর মধ্য এশিয়া থেকে এসে ভারতে মুসলমানদের কয়েক শ বছর শাসন করা সম্ভব হয়েছিল ভারতের বহুত্ববাদী ধ্যানধারণার কারণে। তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সম্মেলনে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে।

আরবের ইসলাম ভারতে এসে এখানকার আবহাওয়া, জলবায়ু, সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে আচারিক দিক দিয়ে ভিন্ন একটি রূপ পরিগ্রহ করে। স্থানীয় রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। আরবেও যেমন প্রাকইসলামিক বহু রীতিনীতি বা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেভাবে কয়েক শ বছর যাওয়ার পরে বিশেষ করে ব্রিটিশ আমল থেকে ইসলাম ধর্মে রিফর্মেশন‘- এর ঢেউ লাগে। সংস্কারের নামে শুরু হয় নানা ধরনের মতবাদ। একটি সময়ে এসে সুফিবাদী ইসলাম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রিফর্মেশনের নামে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম সুফিবাদী দর্শন থেকে ক্রমেই কট্টরবাদীতার দিকে ধাবিত হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওয়াহাবিবাদ, মওদুদিবাদ এবং অধুনা সালাফির মতো আচারসর্বস্ব ধর্মীয় মতবাদ। এই মতবাদ বা মতাদর্শগুলো ইসলাম ধর্মের শান্তি, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব এবং অন্যধর্মের প্রতি সম্মানজনক আচরণের পরিবর্তে ভয়, আগ্রাসন এবং জোরাজুরির ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পায়। মানবিক ইসলাম, উদার ও শান্তির ইসলাম অপসৃত করে তারা এক যান্ত্রিক ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যেটা শুধু আচার সর্বস্বতায় পরিণত হয়। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, তজবিহ পড়া, পুরুষদের লম্বা জুব্বা আর নারীদের হিজাব, নেকাবে আবৃত করা। এর পাশাপাশি নীতিনৈতিকতার শিক্ষার অভাব থাকায় এরা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে আবার অন্যদিকে ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে, মিথ্যাচার করে, ভেজাল করে, নকল করে। এরা দিনে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ খেয়ে হিসাব কত রাকাত নামাজ, কতবার তাজবিহ জপে গুনাহের চেয়ে সওয়াবের মাত্রা বাড়ানো যাবে। এদের কাছে ভালোমন্দ বা পাপপুণ্যের ব্যাপারটি অনেকটা ব্যাংকের ডেবিটক্রেডিটের মতো। কোন অ্যাকাউন্টে কত জমলো। এদের মতাদর্শে একজন মুসলমান স্রেফ একটি রোবোটে পরিণত হয়। তার ভালোমন্দের বিচারবোধ লোপ পায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো রোবোটিক হয়ে ওঠে ওরা। ওদের যতটুকু আউটপুট দেওয়া হয় তার বাইরে স্বাধীনভাবে বিবেক খাটিয়ে কোনো কাজ করতে পারে না। এদেরকে বোমা মারতে বললে বোমা মারে, কতল করতে বললে কতল করে। তার যৌক্তিকতা জানারও প্রয়োজন মনে করে না এরা। এরা যান্ত্রিকভাবে ধর্ম পালন করে কিন্তু অন্তরে কোনো আধ্যাত্মিকতা নেই। সুফিদের কাছে সব ধর্মের মানুষ যেতেন আধ্যাত্মিক ও মানসিক শান্তি পাওয়ার আশায় আর এদের বেশভূষা ও ব্যবহারে অন্য ধর্মের লোক আসবে কি! স্বধর্মের শান্তিকামীরাই পালিয়ে কূল পায় না।

ওয়াহাবি মতবাদীদের দ্বারা বর্তমানে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো শাসিত হচ্ছে আর উপমহাদেশের দুটি মুসলিমপ্রধান দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করছে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী জামায়াতে ইসলামী। ভারতে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোটায় বলে সেখানে জামায়াত এনজিওধর্মী কাজগুলো করে।

জন্মের পর থেকেই এই দলের ভূমিকা বিতর্কিত। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্টে এই সামপ্রদায়িক দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। প্রথম নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। মওদুদী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি হায়দারাবাদ থেকে লাহোরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং আমৃত্যু লাহোরেই ছিলেন।

তিনি পাকিস্তানি আহমদীয়া জামায়াতকে অমুসলিম ঘোষণা করে লাহোরে দাঙ্গা হয় বাধিয়ে দিয়েছিলেন। সে দাঙ্গায় প্রায় পাঁচ লক্ষ কাদিয়ানী বা আহমদিয়া নিহত হন। দাঙ্গার অপরাধে মাওলানা মওদুদীর ফাঁসির সাজা হয়েছিলো। জামায়াতকে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তৎকালীন সৌদি বাদশার হস্তক্ষেপে পাকিস্তান সরকার তার ফাঁসির আদেশ রহিত করেছিলো।

জামায়াতে ইসলামীর কুকীর্তির এখানেই শেষ নয়। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাই শুধু করেনি; ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারাই রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলো। আলবদর বাহিনীও তারা গঠন করেছে। আলবদরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অঙ্গীভূত করে নিয়েছিলো। হত্যা, ধর্ষণ তাদের কাছে স্বাভাবিক ছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বমুহূর্তে তারা ঢাকা শহরে বাসা থেকে তুলে নিয়ে বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিলো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য তিনি দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করেছিলেন।

জিয়াউর রহমান এই রাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে স্বাধীন দেশে রাজনীতি করতে দেওয়া, যে দেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিল তারা। শুধু তাই নয়, এদেশে গণহত্যা সংঘটনে সহায়তাও করেছিল তারা। স্বাধীন বাংলাদেশে পুনরুজ্জীবনের পর জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে অর্থাৎ ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত লাগাতার ২১ বছর বাধাহীন রাজনীতি করে জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। আসলে স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মধ্যে দীর্ঘ ২৮ বছরই এ দেশ শাসন করেছে বিএনপি, জাতীয় পার্টির মতো বাংলাদেশের মূল চেতনার পরিপন্থী দলগুলো। আর এসময়ে দৌর্দণ্ডপ্রতাপে রাজনীতি করেছে ছাত্রশিবির। শিবিরের হাতে আহতনিহত প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন তথা ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী সংখ্যা হাজার হাজার। দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ইসলামী ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে। তৎকালীন সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোর ছিল শিবিরের তাণ্ডবের কাছে অসহায়।

গত শতকের সত্তর দশকের শেষের দিকে এসে মধ্যপ্রাচ্যে লোক যাওয়া শুরু হয়। বাংলাদেশে পেট্রোডলারের সঙ্গে প্রবেশ করে মধ্যপ্রাচ্যের কট্টর ওয়াহাবিবাদ। মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় এদেশে জামায়াত রাতারাতি বর্ধিত হতে থাকে। অন্যদিকে কওমি মাদরাসাশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। বর্তমানে মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সমান্তরাল হয়ে উঠেছে মাদরাসা বিশেষ করে কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা।

স্বাধীন দেশে, যে দেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিল, রাজনীতি শুরু করার পর প্রথমবারের মতো নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি। যদিও গত ৫০ বছরে সমাজের নানা স্তরে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে জামায়াত। সরকারি দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে জামায়াতের লোক। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী কোথায় নেই জামায়াত। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার দুষ্ট চক্র তৈরি করে কয়েকদশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ চাকরি ও পদে জামায়াতশিবিরের লোকদের বসানো হয়েছে। জামায়াত জানে, এ দেশে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেই। তাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভক্যু করে ক্ষমতায় যেতে হবে। সে লক্ষ্যের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছে জামায়াত।

কাজেই এত বছর পরে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে কতটুকু ফায়দা হবে তা কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারবে। কারণ জামায়াত শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়। তারা একটি আদর্শে পরিচালিত হয়। সে আদর্শের লড়াইয়ে না জিততে পারলে তাদের বিনাশ সম্ভব নয়। আমরা বিগত এক দশক ধরে বলতে চেষ্টা করেছি যে, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও সমাজ পরিচালিত হচ্ছে জামায়াতি ভাবধারায়। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতার গায়ে মুজিবকোট থাকলেও মগজ তার জামায়াতি। আর এখনকার ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার উপায় নেই ওরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সমর্থক নাকি মওদুদীর জামায়াতের। সাইদীর মৃত্যুর পর তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে বিস্মিত হতে হয়েছে। বাইরে মুজিবকোট অন্তরে জামায়াতএই ধরনের নেতাকর্মীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতবিরোধী আন্দোলন কতটা সফল করতে পারবে তা নিয়েও দ্বিধা আছে। আওয়ামী লীগেরও জামায়াতিকরণ হয়ে গেছে বহু আগে।

একটি সময়ে আমাদের শিক্ষা শুরু হতো বাল্যশিক্ষা পড়ার মধ্য দিয়ে। জামায়াত হচ্ছে জঙ্গিবাদ তথা সব ধরনের উগ্রবাদের বাল্যশিক্ষা। বর্তমান আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশবিরোধী সকল কর্মকাণ্ডে নেপথ্যের শক্তি জামায়াতে ইসলামী। এর অগ্রযাত্রা থামাতে না পারলে দেশ থেকে উগ্রবাদ নির্মূলও সম্ভব নয়। লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় অবৈধ মৎস্য আহরণ বন্ধ করা হোক
পরবর্তী নিবন্ধযুক্তরাষ্ট্রে মসজিদ প্রাঙ্গণে গুলিতে মুসল্লি নিহত