কাল আজকাল

বাঙালির পরশ্রীকাতরতা, মাত্রাজ্ঞান ও কথোপকথন

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৪ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সেদিন অসীম ভিড়ের ভিতর

ধরলো দুহাত খপ করে,

বলল, জানিস আমার ছেলে

ভীষণ ভালো জব করে।

শুনে আমার মনের বাতি

নিভে গেল দপ করে,

আমার ছেলে ঘরে বসে

আফাডাইঙ্গা গপ করে।‘ (আফাডাইঙ্গা গপ মানে অবাস্তব গল্প বা চাপা মাড়া)

এটা হলো অধিকাংশ বাঙালির প্রকৃত মানস। অর্থাৎ পরের খুশি বা উন্নতিতে নাখোশ হওয়া, ঈর্ষাকাতর হওয়া। অনেকে বলে থাকেন অন্যকোনো ভাষায় পরশ্রীকাতরতার প্রতিশব্দ নেই। এটা একমাত্র বাঙালির আছে। বাঙালির অবশ্য মাত্রাজ্ঞানও নেই। কখন, কাকে, কতটুকু বলা যাবে সে জ্ঞান বাঙালির নেই।

কিছু উদাহরণ দিই। বেশ কয়েকবছর পর পরিচিত জনের সঙ্গে দেখা হলো, কুশল বিনিময় করতে গিয়ে বললাম, ভালো আছি। কিন্তু দেখা গেল তিনি তাতে সন্তুষ্ট না। বললেন, না, না। আপনাকে কিন্তু দেখে তা মনে হচ্ছে না। শুকায় গেছেন, কালো হয়ে গেছেন। আপনার চেহারার সেই দ্যূতি আর নেই। কিছু একটা হইছে ভাই। ডায়াবেটিস চেক করাইছিলেন? লিভার? ঠাট্টা করছি না। চেক করান। আসলে কোথায় চেক করাবেন? এদেশে তো কিছুরই ঠিক নাই। এক কাজ করেন চেন্নাই নতুবা বেঙ্গালুরু চলে যান। আমার ভাবির বড়ভাই

এই অবস্থায় আমার মতো আপনি ভালো আছেন তা বোঝাতে অনেক কৌশিশ করবেন কিন্তু তিনি ক্ষান্ত হবেন না। আপনার চেহারা যে নষ্ট হয়ে গেছে সেটা আপনাকে দিয়ে স্বীকার না করিয়ে ছাড়বেন না।

আপনার মানসিক শক্তি বিনষ্টে বছরে এমন একজনের সঙ্গে দেখা হলেই যথেষ্ট।

কোনো অনুষ্ঠানে পরস্পর পরিচিত দুই নারীর সঙ্গে কথা হচ্ছে, আপনার শাড়িটা তো দারুণ ভাবী। কোথা থেকে কিনলেন?

শুনে অপর নারীর মুখটি উজ্জ্বল হয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই আগেরজন বললেন, ইশ আপনার রংটা যদি আরেকটু ফর্সা হতো তাহলে ফাটাফাটি হয়ে যেত। মুহূর্ত আগে উজ্জ্বল হওয়া নারীর মুখটি ম্লান হয়ে গেল। মানুষের হাসিমুখ ম্লান করে দিতে বাঙালির কোনো জুড়ি নেই।

বাঙালির চরিত্র মাছির মতো শুধু ক্ষত খুঁজে বেড়ায়। যে প্রসঙ্গে বললে আপনি বিব্রত হবেন, মনে কষ্ট পাবেন খুঁজে খুঁজে সে প্রসঙ্গটিই তুলবে। আপনাকে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত না করলে যেন শান্তি নেই। আপনার দুর্বল জায়গায় আঘাত করে এক অপার্থিব সুখলাভ হয় তাদের।

বাসায় নিমন্ত্রণ করে খাওয়াচ্ছেন। খাওয়ার টেবিলেই কেউ একজন বলে ফেলবে, ‘সবকিছু ঠিক ছিল ভাবী, তবে মাছে যদি ঝোল কম হতো তাহলে ভালো হতো।

আচ্ছা এটা কীভাবে করেছো? আরেকটু কষালে ভালো হতো। একদিন আমি শিখিয়ে দেব।

মোটামুটি ভালো বেতনে চাকুরি করা এক যুবককে প্রশ্ন করলো তার এক আত্মীয়।

তুমি কোথায় চাকুরি করো?

অমুক কোম্পানিতে ।

স্যালারি কতো?

৩০ হাজার টাকা।

মোটে ৩০ হাজার? কী বলো? তোমার মতো একটা জিনিয়াসকে দেয় মাত্র ৩০ হাজার?তোমার মালিক তোমার প্রতি অবিচার করছে। তোমার যা যোগ্যতা, তাতে হেসেখেলেই তুমি লাখ টাকা বেতন পেতে পারো।

যুবকের মনে হলো তাই তো। এতদিন ঠকেছি। নিজের কাজ ও বসের প্রতি রুষ্ট হয়ে উঠলো সে। মাসখানেক পর বসকে বেতন বাড়ানোর দাবি জানালো। তার অসৌজন্যমূলক ব্যবহারে তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে ছেলেটি বেকার বসে আছে এখন।

ধার চাইতে এসেছেন এক প্রতিবেশিনী। গৃহিণী বললেন, ‘আমার কাছে তো টাকা নেই। আপনার ভাইও নেই। ও বাসায় এলে ওর কাছ থেকে নিয়ে দিতে পারব ভাবী।

কেন ভাবী, ভাই আপনার কাছে টাকা রাখে না? হাত খরচার জন্যেও তো কিছু দিতে পারে। তার কাছে কি আপনার কোনও মূল্যই নেই? আপনি বুয়া নাকি?’

স্ত্রীর মনে কাঁটা বিধে রইল বুয়া শব্দটা।

সারাদিন কথাটা ভাবতে ভাবতে মনটা বিষিয়ে উঠলো। সত্যিই তো! আমাকে একটা টাকাও কখনো ছোঁয়ায় না! রাতে কর্মক্লান্ত স্বামী ঘরে ফিরলো।

স্ত্রীর মুখ দিয়ে বোমা বিস্ফোরিত হলো। রেগে গেলো দু’জনে, কথা কাটাকাটি ঝগড়া। পরে হাতাহাতি, শেষ পর্যন্ত তারা আলাদা হয়ে গেল।

এই বয়েসে এত কষ্ট করছেন? ছেলে ঢাকায় থাকে, বড় চাকুরি করে শুনেছি। মস্ত বড় ফ্ল্যাটে বউবাচ্চা নিয়ে থাকে। আপনাদের দু’জনকে সাথে নিয়ে যেতে পারে না? আপনাদের দেখতেও তো আসে না!’

বাবা আপত্তি করেন, ‘না না, ছেলে আমার খুবই ব্যস্ত। টাকা পাঠায় তো। ফোনেও খোঁজখবর নেয় নিয়মিত।তাতে সন্তুষ্ট নন কথিত শুভাকাঙ্ক্ষী।

কী এমন ব্যস্ততা তার শুনি? নিজের মাবাবাকে দেখতে আসার সময় হয় না?’

সারাদিন অফিসবাসা করতে করতেই তো তার সবটা সময় চলে যায়।

আপনি খোঁজ নিয়েছেন? নিজের ফ্লাটে থাকে, দামি গাড়ি হাঁকায় আর আপনারা একা পড়ে আছেন এখানে?

মাবাবার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতদিন যা ভাবেননি এখন তাই ভাবছেন। ছেলেটি এত স্বার্থপর হয়ে গেল!

ছেলে যখন পড়ালেখা শেষ করলো।

ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দিন না ভাই। এ দেশে কী করবে সে? বুঝতেছেন না। এখানে কোনো ভবিষ্যৎ নাই। আমেরিকা, কানাডা পাঠাই দেন। মাঝেমধ্যে ভাবীকে নিয়ে বেড়িয়ে আসবেন।

আমার একটা ছেলে ভাই। ও আমাদের ছেড়ে যেতে চায় না।

ছেলে বুঝতেছে না ভাই। ওর ভবিষ্যতটা নষ্ট করে দিচ্ছেন।

মনে করুন ছেলেটার চাকরি হলো।

ছেলেকে বিয়া করান না কেন ভাই?’

করাব।

কখন করাবেন। চাকরি তো করে এখন করাই দেন। ওর কি পছন্দ আছে? থাকলে তো বেশ।

ভাবী রাজি হয় না মনে হয়।

না না। ও এখন করতে চাচ্ছে না।

আরে ভাই জোর করে করাই দেন। এখনকার ছেলেমেয়ে বিয়ে করতে চায় না। নাকি ছেলের কামাই খাওয়ার জন্য বিয়া করান না?’

বিয়ের পর যা হয়।

বউ কোথা থেকে আনছেন। বাড়ি কই। বাসা কই?

পাথরঘাটা? পাথরঘাটার কোন জায়গা? বাবার নাম কী? কী করে? নানার বাড়ি কোথায়?

আর বর্তমানে।

বউ আপনাদের জন্য কিছু আনে না? সেকি? বউ চাকরি করে শ্বশুরশাশুড়ির জন্য কিছু আনবে না?

শ্বশুর বাড়ি থেকে ছেলেকে কী দিয়েছে? ওমা! আমাদের মধ্যে তো কতকিছু দেয়।

এখানে শেষ নয়। এখন দ্বীনি দাওয়াতের প্রচলন বেড়েছে। প্রচুর নারীরাও এখন দাওয়াতি কর্মসূচিতে অংশ নেন।

দাওয়াতের নমূনা

ভাবী, স্বামীসন্তানসংসারের জন্য বহুকিছু করছেন। এখন নিজের আখেরাতের জন্য কিছু করেন। হাসরের ময়দানে খালি হাতে আল্লাহকে কী জবাব দেবেন। ফেলে রাখেন সংসার। ওরা আপনাকে বেহেস্তে নিয়ে যাবে না। নিজের আখেরাত নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।

এখন সে নারী সপ্তাহে পাঁচদিন দাওয়াতি কর্মসূচি পালন করে। বউ আখেরাতের আশায় ঘরে ঘরে ঘোরে আর নিজ ঘরে তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে দুনিয়ায় দুইবেলা খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। তাদের শান্তিপূর্ণ পারিবারিক বন্ধনটি আর নেই।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকটি পোস্ট দিয়ে নারীটি নিজেকে আবিষ্কার করে একদিন। আরে আমি তো ফুরিয়ে যাইনি। একটা ছবি দিলে শত শত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। লাইক কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। ইনবক্স ভরে ওঠে পুরুষের প্রশংসায় প্রশংসায়।

দুচার লাইন কবিতা লিখে খ্যাতি পাওয়া সে নারী একদিন বিদ্রোহ করে বসে। স্বামী সন্তান তখন তুচ্ছ হয়ে যায়।

এভাবে কেউ পথ হারায়। সামান্যই দিশা পায়। অনেকে ভুল মানুষ ভালোবাসতে গিয়ে শেষ বয়সে সকলই হারায়।

বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। বাঙালির চরিত্রও সে খেলার মতো। কেউ উঠতে চাইলে তাকে চেপে ধরবে দশজন। বাঙালি তার চেয়ে উঁচুতে থাকা কাওকে সহ্য করে না। ফলে তাকে টেনেহিঁচড়ে তাদের সমপর্যায়ে নামিয়ে আনতে না পারলে যেন শান্তি পায় না। এরা ফেসবুকে বিপ্লব করে। নিজেকে মহৎ হিসেবে জাহির। আসলে বাঙালি হচ্ছে এরকম

আমরা কেহই মহৎ না

মহৎ হবার ভান করি,

সুযোগ পেলে মশার মতো

রক্ত টেনে পান করি।

আমরা কেহই মহৎ না

মহৎ হবার ভান করি,

বাইরে করি গলাগলি

গোপন ছুরি শান করি।

আমরা কেহই মহৎ না

মহৎ হবার ভান করি,

মিষ্টি কথায় ছেলে ভোলাই

পারলে বাবার কান ধরি।

আমরা কেহই মহৎ না

মহৎ হবার ভান করি,

সুযোগ পেলে তেল মারি আর

কর্তাবাবুর গান করি।

আমরা কেহই মহৎ না

মহৎ হবার ভান করি,

সামনে করি প্রশংসা আর

অইদ্দোবানে ভঁহ করি।

(অইদ্দোবানে অবর্তমানে)

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকাত্তরের খণ্ডচিত্র
পরবর্তী নিবন্ধইউএসটিসির ১৯৪তম সিন্ডিকেট সভা