১. কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উজানে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানের একটি চর। ১৯৩০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কারণে ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানে এই দ্বীপ জেগে ওঠে। চরটির আয়তন প্রায় ১০৫ একর। বর্তমানে চরটিতে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প স্থাপনের জন্য মাটি পরীক্ষার কাজ চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন।
২. কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চর বাকলিয়ায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্ল্যান্ট বসাতে চায় সিটি করপোরেশন।
বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইকো) ২০২২ সালে তাদের একটি গবেষণায় চর বাকলিয়ার উদ্ভিদবৈচিত্র্য তুলে ধরে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে সেই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় চর বাকলিয়ায় মোট ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করে। যার মধ্যে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ, ২০ প্রজাতির বিরুৎ, ৫৭ প্রজাতির গুল্ম, ১২ প্রজাতির লতানো উদ্ভিদ ও পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সংখ্যা ছিল ২টি। ১৫৫টি উদ্ভিদের ভিতর ১১৩টি ঔষধি গাছ বিদ্যমান। এগুলো ধ্বংস করে এখানে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় সিটি করপোরেশন।
৩. চট্টগ্রাম নগরের ডিসি সড়কের নালা নির্মাণ করা হয়েছিল প্রায় চার বছর আগে। এর মধ্যে নালার তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এরপরও নালাটি সংস্কার করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। সংস্কারের পর দুই ফুট উঁচু করা হয়েছে নালাটি। এই কাজ করতে গিয়ে আগের নালার স্ল্যাবও ভাঙা হয়নি। এখন তা ‘দোতলা‘ নালা হিসেবে রূপ নিয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সমপ্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালে নালাটি সংস্কার করা হয়েছিল। প্রকল্পের আওতায় সংস্কার করা নালা–নর্দমা ও খাল এখনো বুঝে নেয়নি সিটি করপোরেশন। ডিসি সড়কের নালাটি এখনো প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের আওতায় রয়েছে। সিটি করপোরেশনের ‘দোতলা’ নালাটি নির্মাণ করা হয়েছে সড়কের গনি কলোনির পাশে। এর আনুমানিক দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট। আগের নালার চেয়ে অন্তত আড়াই ফুট উঁচু করা হয়েছে নতুন নালাটি। এতে সড়কের আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও অলিগলির সড়কগুলো নিচে নেমে গেছে। আগের করা নালাটির স্ল্যাব রেখেই তার ওপরে ঊর্ধ্বমুখী সমপ্রসারণ করা হয়েছে নতুন নালাটি। নালাটির চারপাশের দেয়াল তুলে দিলেও আগের স্ল্যাবগুলোও সেভাবে রয়েছে। ফলে আবর্জনা জমে গেলে ওপর থেকে তা পরিষ্কারের কোনো সুযোগ থাকবে না।
৪. জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন একটি খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল অন্তত দশ বছর আগে। চট্টগ্রাম নগরের বারইপাড়া এলাকা থেকে শুরু হয়ে নূর নগর হাউজিং, ওয়াইজ পাড়া হয়ে বলির হাটের পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশবে নতুন খাল। নতুন এ খালের দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিলোমিটার। চওড়া ৬৫ ফুট। ২০১৪ সালের জুনে ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় খালের খননকাজ শেষ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। যদিও একই খালের কাজ উদ্বোধন করা হয়েছে দুবার। শুধু তাই নয়৷ দুই দফা প্রকল্প সংশোধনের পর ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
৫. নগরের বায়েজিদ থানাধীন নাগিন পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকা। ১৯৯৭ সাল থেকে পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি টের পায় ২০২১ সালে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নাগিন পাহাড়ের দূরত্ব মাত্র তিন থেকে চার কিলোমিটার হলেও পাহাড় কাটার সংবাদ পেতে তাদের সময় লেগেছে ২৪ বছর। বর্তমানে আবাসিক এলাকাটিতে কমপক্ষে ৫০টি প্লট রয়েছে। এতে বেশির ভাগ প্লটে নির্মিত হয়েছে ভবন।
৬. দোকানসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের কারণে চট্টগ্রাম নগরের বিপ্লব উদ্যানের সবুজ ও উন্মুক্ত পরিসরের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছিল। এ অবস্থায় আবারও উদ্যানটিতে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এ জন্য ভরাট করা হয়েছে পানির ফোয়ারা। ভেঙে ফেলা হয়েছে গ্লাস টাওয়ারও। এ নির্মাণকাজ করতে গিয়ে উদ্যানে প্রবেশের মূল পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নগরের দুই নম্বর গেটে অবস্থিত উদ্যানটিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ না করার এবং পুরোনো স্থাপনা অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিল নাগরিক সমাজ, নগর–পরিকল্পনাবিদ ও বিভিন্ন সংগঠন।
কিন্তু সবার আপত্তি উপেক্ষা করে উদ্যানে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণে অনড় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম দুই নম্বর গেটে গাছগাছালিতে ভরা দুই একরের এই উদ্যান গড়ে তোলা হয়। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি কংক্রিট অবকাঠামো থাকতে পারবে না। আর আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশও অনুমোদন করে না। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানের কংক্রিট অবকাঠামোর পরিমাণ অন্তত ৫৫ শতাংশ।
৭. সিডিএ চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ করেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠা–নামার পথ) রয়েছে। এর মধ্যে টাইগারপাসে রয়েছে দুটি। একটি দিয়ে গাড়ি উঠবে এবং আরেকটি দিয়ে নামবে। গাড়ি ওঠার র্যাম্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী অংশ দিয়ে। আর এই র্যাম্প নির্মাণ করতে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হলেও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। কাটার জন্য গাছ চিহ্নিত করে নাম্বার দেওয়া হয়েছে।
এসব নতুন কোনো তথ্য নয়। চট্টগ্রামবাসী খবরগুলো পত্রিকায় পড়েছেন, জেনেছেন। কোনোটাই আমার রিপোর্ট নয়। আমি শুধু জড়ো করে তুলে ধরলাম মাত্র। সিটি করপোরেশনের কাজ হলো নাগরিকদের সেবা দেওয়া। নালা–খাল পরিস্কার রাখা। নগরকে সুন্দর ও বাসযোগ্য রাখা। সিডিএ–র কাজ হলো একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলা। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ হলো পরিবেশ রক্ষা করা তথা পরিবেশ পাহারা দেওয়া। আর ওপরে যে অনিয়মগুলো তুলে ধরলাম সবকটির সঙ্গে জড়িত এই তিনটি প্রতিষ্ঠান। এতক্ষণ এ খবরগুলো পড়ে যারা মন খারাপ করেছেন তাদের জন্য একটি গল্প তুলে ধরছি। গল্পটাও আমার নয়। ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করেছি। রাজা তার আবহাওয়া বিভাগের প্রধানকে ডেকে জিজ্ঞাস করলেন, ‘আমি মৎস্য শিকারে যেতে চাই , আজকের আবহাওয়া কেমন থাকবে বলে জানা গেছে?’
সে বলল, ‘আজকে অতীব সুন্দর, রৌদ্রোজ্জ্বল এবং চমৎকার আবহাওয়া থাকবে জাহাপনা, আপনি নিঃশঙ্ক চিত্তে যেতে পারেন।‘ রাজা বের হলেন। যখন তিনি সাগর পাড়ে গেলেন তখন সেখানে এক জেলে ছাগল চড়াচ্ছিলো, সে বললো, ‘মহারাজ আজকে কেন আপনি সাগরে যাচ্ছেন? একটু পরেই তো প্রচণ্ড বৃষ্টি হবে।‘
রাজা রেগে বললেন, ‘বেটা জেলের বাচ্চা! তুই কী জানিস আবহাওয়ার খবর? আর আমাকে কি মূর্খ পেয়েছিস! আমি খবর জেনে তবেই এসেছি।‘ রাজা সাগরে গেলেন, কিছুক্ষণ পর শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়বাদল।
রাজা প্রাসাদে ফিরে এসে আবহাওয়া বিভাগের প্রধানকে বরখাস্ত করলেন, তার স্থলে ওই জেলেকে ধরে এনে আবহাওয়া বিভাগের প্রধান বানিয়ে দিলেন। এ অবস্থায় জেলে পড়ে গেলেন মহা ফাঁপড়ে। সে তো আবহাওয়ার কিছুই জানে না। একদিন রাজার কাছে গিয়ে জেলে কেঁদে–টেঁদে বলল, ‘মহারাজ আমাকে যেতে দিন! আমি আসলে আবহাওয়ার কিছুই জানি না।
রাজা বললেন,’তাহলে ওই দিন আমার আবহাওয়া বিভাগে চেয়েও সঠিক খবর তুই কী করে দিলি?’
জেলে বলল, ‘মহারাজ সেখানে আমার কোনো কৃতিত্ব ছিল না! সব কৃতিত্ব আমার ছাগলের! বৃষ্টি আসার আধাঘন্টা আগে থেকে ছাগলটা ঘনঘন পেচ্ছাপ করে ! তা থেকে আমি বুঝতে পারি একটু পর বৃষ্টি হবে।‘
তারপর রাজা জেলেকে ছেড়ে দিয়ে তার ছাগলটাকে ধরে এনে আবহাওয়া বিভাগের প্রধান বানিয়ে দিলেন।
এটা স্রেফ গল্প। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
আসলে একটা লেখা সম্পূর্ণ ধার করে তো হয় না নিজেরও কিছু থাকতে হয়। তাই আমার কথাটা বলি।
চট্টগ্রামের ভাষা, গান তথা সংস্কৃতিতে অশ্লীলতা খোঁজার চেষ্টা করেন অনেকে। তাদের উদ্দেশে বলি, পৃথিবীর প্রতিটা ভাষার আঞ্চলিক রূপ থাকে। অর্থাৎ প্রচলিত মূল ভাষাগুলোর কিছু উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা থাকে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা খুব সাধারণ মানুষগুলো এই ভাষায় কথা বলে। আর সাধারণ মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বলে সেখানে ভদ্রলোকদের ভাষায় কিছু ‘স্ল্যাং‘ শব্দ থাকে। এটা দোষের নয়। এটা অপসংস্কৃতিও নয়। সব আঞ্চলিক ভাষায় গালাগালি থাকেই।
বাংলা নিতম্ব বা পাছাকে চট্টগ্রামের ভাষায় পোঁদ বা পোন বলে। আবার একই শব্দটি ব্যবহার করে ‘পেছনে‘ বোঝাতে। যেমন, ছেলে পাড়ার মাস্তান বা বাজে কারো সঙ্গে চলাফেরা করে। বাবা ছেলেকে বারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘অমুকর পোঁদে পোঁদে হাঁডছ কিল্লাই? অমুকর পোঁদে পোঁদে ন ঘুরিবি। অর্থাৎ, অমুকের পিছে পিছে হাঁটিস কেন? অমুকের পিছে পিছে ঘুরবি না। কেউ কারো পিছু লাগলে অর্থাৎ ক্ষতি করার চেষ্টা করলে বলে, ‘হিতের পোঁদত দাড়া ন দিস‘। বা মানুষের ক্ষতি হয় এমন কিছু করলে বলে, ‘মাইনষুর পোঁদত দাড়া ন দিস‘। এমন শব্দ পারিবারিকভাবেই ব্যবহৃত হয়, তাতে কেউ কিছু মনে করে না। এসব আসলেই কথ্যভাষা। আমি অর্থনৈতিকভাবে এই শ্রেণিরই অংশ। কাজেই আমি এই ভাষাতেই একটি সহজ–সরল প্রশ্ন করতে চাই আমাদের কর্তাদের কাছে, ‘পরিবেশ, প্রকৃতি ও পাব্লিকর পোঁদত দাড়া ন দি কোনো উন্নয়ন করা ন যায়?’
লেখক : কবি, সাংবাদিক