কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

দাম শাসন, দেশ শাসন

শিরোনামটি নিয়েছি অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ (১৯১৪ ১৯৯৪)- এর একটি বইয়ের নাম থেকে। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও সংগঠক। যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এই বামপন্থী রাজনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বাংলা ও ইংরেজি মিলে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা ২৭টি । ২০০৫ সালে তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। তিনি স্যাটায়ারধর্মী লেখার জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।

চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, কাঁচামরিচ, মুরগি, ডিম ইত্যাদির সঙ্গে এবার যুক্ত হলো আলু যা সচরাচর সস্তা সবজি হিসেবে এতদিন পরিচিত ছিল। বাজারে একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়ানো হয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এবার তারা আলুর দাম বাড়িয়েছে। হঠাৎ কেন দাম বাড়বে, কারা বাড়াবে, কতটুকু বাড়াবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। হঠাৎই দেখা যায় দাম বেড়ে গেল। তারপর থেকে শুধু বাড়তেই থাকবে।

প্রতিবার যা হয় এবারও তা হয়েছে। বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে। মূল্য তালিকা ও ক্রয় ভাউচার সংরক্ষণ না করায় নগরীর পাহাড়তলী বাজারের আলু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৩ আড়তদারকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত বুধবার এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।

তবে আলুর বাজারে কেন এ অস্থিরতা তার কোন সঠিক তথ্য দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এমনকি অভিযানের সময়েও তাদের কাছে মিলছে না ক্রয় রশিদ ও বিল ভাউচার। ব্যবসায়ীরা নানা ইস্যু সৃষ্টি করে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করছে বলে মন্তব্য করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপ পরিচালক বলেন, ‘পাহাড়তলী বাজারে অভিযানে ব্যবসায়ীরা দামবৃদ্ধির কোন প্রমাণপত্র দেখাতে পারেননি। তারা আমাদের বলেছেন, জয়পুরহাট, মুন্সিগঞ্জের আলু ব্যবসায়ীরা আলুর দাম নির্ধারণ করে দেন যা তারা কমিশনে বিক্রি করেন। আর তাই আলুর দাম বেড়েছে।’

এদিকে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দাবি করেছেন বর্তমানে দেশে আলুর কোনো সঙ্কট নেই। সমিতির নেতারা বলেছেন, বর্তমানে দেশের হিমাগারগুলোতে যে পরিমাণ আলু সংরক্ষিত রয়েছে, তা দিয়ে আগামী ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে আলু সরবরাহ করা সম্ভব হবে। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নতুন আলু বাজারে আসবে। ফলে বাজারে আলু সরবরাহের কোনো ঘাটতি হবে না। হিমাগারের মালিকদের এই সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজি করে আলুর দাম বাড়াচ্ছেন।

এরপর বাজারে বাড়তে থাকা দামের লাগাম টানতে নতুন করে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দিয়েছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার এই তিন পণ্যের দাম ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বেশ কিছুদিন ধরে এই তিন পণ্যের দামে বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এখন থেকে খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম হবে সর্বোচ্চ ১২ টাকা, প্রতি কেজি আলু ৩৬ এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, কৃষি বিপণন আইন, ২০১৮ুএর ক্ষমতাবলে দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এত দিন আমরা কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিইনি। আজই (বৃহস্পতিবার) প্রথম তা করে দিলাম। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই তা করা হয়েছে। আশা করছি এটা বাস্তবায়ন করতে পারব।’

পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া নতুন নয়। আগে কয়েক দফায় ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বেঁধে দিলেও তা কার্যকর করতে পারেনি সরকার। এই ব্যর্থতার জন্য অনেকবারই বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছিল। তাই ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, কীভাবে নতুন দাম কার্যকর করা হবে, তার কোনো কৌশল সরকারের নেই।

আমরা অতীতেও বেশ কয়েকবার দেখেছি সরকার যতবারই বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে ততবারই তার উল্টো ফল ঘটেছে। শুধু রাজনৈতিক সরকারের বেলায় ঘটছে তা নয়। ১/১১ সরকারের আমলেও চালের দাম নিয়ে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছিল। বাজারে যখন অভিযান চলে তখন এক চিত্র, অভিযান শেষ হলে পরিস্থিতি পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তৎক্ষণাৎই কার্যকর হয় অথচ দাম কমার সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে হতে আবার দাম বাড়ার ঘোষণা চলে আসে। এ বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে সরকার।

বাণিজ্যমন্ত্রী অবশ্য দাম ঠিক না রাখলে ভারত থেকে ডিম আমদানির হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। এতে কোনো কাজ না হওয়ায় দাম নিয়ন্ত্রণে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য শুরুতে চার কোটি ডিম আদমানি করতে চারটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ‘যত দ্রুত সম্ভব’ ডিম দেশে আনতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দেশের বাজারে ডিমের দাম কমিয়ে আনা। সে জন্য আমদানির অনুমতি দেওয়া শুরু হয়েছে। ডিমের দাম না কমা পর্যন্ত আমরা এটা চালিয়ে যাব।’ অন্যদিকে ডিম ব্যবসায়ীরা বলছেন, পোল্ট্রি খাদ্যের দাম না কমালে ডিমের দাম কমবে না। আমরা সাধারণ মানুষ অনেককিছু বুঝি না। তাই প্রশ্ন জাগে মনে, আমদানিকৃত ডিম যদি ১২ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হয় তাহলে ঘরের পাশের ডিম কেন ১২ টাকায় বিক্রি সম্ভব নয়। এর কারণ তো অনুসন্ধান করা উচিত এবং কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে তা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। ওই সরকারের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। সে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক কৃতিত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল বাজার পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল রাখা। পাঁচ বছরে আকস্মিকভাবে কোনো পণ্যের দাম বেড়েছিল বলে জানা নেই। এমনকি ২০১৩/১৪ সালে বিএনপিজামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের সময় যখন পরিবহন ব্যবস্থাকে এক প্রকার অচল করে দেওয়া হয়েছিল সেসময়ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারেনি কেউ। সে দুর্যোগকালীনেও সারাদেশে সরবরাহ ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল ছিল কাজেই মূল্য পরিস্থিতিও সহনশীল ছিল। তাহলে কেন এখন সকালে একদর, দুপুরে একদর রাতে আরেক দরে কিনতে হবে? কেন সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার বারবার ব্যর্থ হবে?

পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবন যখন ওষ্ঠাগত তখন কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যে সাধারণ মানুষ খুব মর্মাহত হয়। মানতে হবে সব দেশেই এখন পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তবে তার সঙ্গে দেশের তুলনা করা গরিবের সঙ্গে পরিহাস করার মতো। আমার কাছে এই মুহূর্তে সঠিক তথ্যউপাত্ত নেই। তবে ধারণা করে বলতে পারি অন্তত দু কোটি মানুষ আছেন যাদের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার বেশি নয়। এই লোকের পরিবারে যদি চারজন সদস্য থাকে তাহলে দেশের কোনো অর্থনীতিবিদ কিংবা আমাদের অর্থমন্ত্রী কি তাদের খরচের একটি তালিকা করে দিতে পারবেন? তবে হ্যাঁ অনেক মানুষের জীবনযাপনে জৌলুশ কমেনি। নগর থেকে গ্রামে হোটেলরেস্তোরাঁ কিংবা বিয়ে, উৎসব দেখে বোঝার উপায় থাকে না এ দেশে এক হাজার টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কেনা অনেকের জন্য দিবাস্বপ্ন আজ।

এ নিয়ে রাজনীতিবিদদেরও কোনো মাথা ব্যথা নেই। বিরোধীদল নির্বাচনের আগে আগে সরব হয় সুষ্ঠু ভোটের দাবিতে আর সরকারি দলের বড় বড় নেতারা বাজারে যায় বলেও মনে হয় না। বাজারব্যবস্থার এমন নাজুক পরিস্থিতিতে সরকারিদলের উচিত ছিল যার যার জায়গায়, যার যার অবস্থান থেকে ব্যবসায়ী তথা আমদানিকারক, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা। তাদের সঙ্গে আলাপআলোচনা অব্যাহত রাখা। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। তাতে সাধারণ মানুষ মনে করতো এই দল আমাদের কথা ভাবে। সবাই ব্যবসায়ীবান্ধব হয়ে থাকতে চায়। ব্যবসায়ীবান্ধব হওয়া দোষের নয়। তবে যখনই কিছু অকাজ হয় তখন বলা হয়, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ীসেই অসাধুদের প্রতি সদয় হওয়ার তো যুক্তি থাকতে পারে না।

তাছাড়া আমাদের দেশে অধিকাংশ পণ্যের উৎপাদনখরচও বেশি। যেমন এই সময়ে বিশ্ববাজারে প্রতিটি ডিমের দাম ৫.৬১ টাকা, আর দেশে তা ১২ টাকার ওপরে। আমদানি করা ডিম সে দেশের উৎপাদকেরা লাভ রেখে বিক্রি করবে নিশ্চয়ই। এরপর তার সঙ্গে যুক্ত হবে পরিবহন ও অন্যান্য খরচ। আমদানি শুল্কও নিশ্চয় যুক্ত হবে। এরপর বিভিন্ন হাত ঘুরে সে ডিম ১২ টাকায় বিক্রি করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের পোল্ট্রি ফার্মাররা কেন তা পারবেন না। তাদের দাবি হচ্ছে ফিডের দাম না কমালে ডিমের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।

দাম নিয়ন্ত্রণে আসলে কী করা যায় তা নিয়ে জাতীয়ভাবে আলোচনা হওয়া উচিত। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধান করা না হলে শুধু অভিযান পরিচালনা করে লাভ হবে না। সেসঙ্গে সততা ও আন্তরিকতা না থাকলে ব্যবসায়ীদের আইন দিয়ে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান পত্রিকাকে বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সেটা করতে হলে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তার একটা হলো মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে যেসব উপায়উপকরণ আছে, তার সঠিক ব্যবহার করা। সেই কাজটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য করা কঠিন। এটা হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে।

একটি দৈনিক কিছু বড় কোম্পানি, বাজার বিশ্লেষক, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারিত দর কার্যকর না হওয়ার চারটি কারণ বের করেছে ১. বড় কোম্পানি, উৎপাদক অথবা আমদানি পর্যায়ে দর কার্যকর করতে না পারা। ২. পাইকারি বাজার ও খুচরা পর্যায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি না থাকা। দেখা গেছে, যতক্ষণ বাজারে অভিযান চলে, ততক্ষণ দাম কম থাকে। ৩. চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা। সরবরাহুসংকট থাকলে কোনোভাবেই নির্ধারিত দর কার্যকর করা সম্ভব নয়। ৪. বেড়ে যাওয়ার পর দর নির্ধারণে লাভ হয় না।

সরকার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে আশা করি। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমেদ বলতে চেয়েছিলেন, দাম শাসন করতে পারলে দেশ শাসন সহজ হয়। ক্ষমতাসীন দল বাস্তবতাটি বোঝে কিনা জানি না। বুঝতে বুঝতে নির্বাচনও তো ঘনিয়ে এলো।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃতির রূপ বৈরী কেন?
পরবর্তী নিবন্ধঅস্তিত্ব অন্বেষা : চর্যাপদের উৎসভূমি চট্টগ্রাম ও পণ্ডিত বিহার