কাল আজকাল

বঙ্গবন্ধুর অনুধাবন এবং বাঙালির স্বরূপ

বাঙালির স্বরূপ | বৃহস্পতিবার , ১০ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পা রাখলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিনই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে, যার নাম এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে দেওয়া বক্তৃতার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সাত কোটি বাঙালিরে হে বঙ্গজননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ কবি গুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে, দুনিয়ার স্বাধীনতার সংগ্রামে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই।

এরপর যতই দিন গেছে বঙ্গবন্ধু ক্রমে ক্রমে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন আসলে বাঙালি কী জাত। তাঁকে হত্যা করার আগে তিনি যতগুলো বক্তৃতা করেছেন তা বিশ্লেষণ করলে তা আরও স্পষ্ট হবে। আমরা এতদিনে জেনে গেছি স্বাধীনতার আগে থেকেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে কমপক্ষে দুটো গ্রুপ ছিল। আওয়ামী লীগে ছিল খন্দকার মোশতাকের একটি লবি যারা চিন্তাচেতনায় ছিল প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়াশীল ও মীরজাফর ঘরানার আর ছাত্রলীগে ছিল সিরাজুল আলম খানের অনুসারী অতি উৎসাহী, পক্ষান্তরে উগ্র ও বিভ্রান্ত একটি উপদল। যারা স্বাধীনতার পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ গঠন করেছিল। এই বিভ্রান্ত রাজনীতির সহগুরুরা হলেন, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ। আর একটি প্রতিক্রিয়শীল খুনীর উপদলও ছিল শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে যারা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম হত্যার রাজনীতি শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে ছাত্রলীগের ছয়জন নেতাকর্মীকে হত্যা করে।

আ স ম রব, শাজাহান সিরাজদের দলটি স্বাধীনতার আগেও নানা রকম হটকারী কর্মসূচি ও পরিকল্পনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো; সে একই কায়দায় তারা স্বাধীনতার পরপর নানা প্রকার দাবি তুলে বঙ্গবন্ধুকে চাপে রাখতো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কথা বললে তারা বলত সমাজতন্ত্রের কথা, বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের কথা বললে তারা বলত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল চীনপন্থী নানা কিসিমের তথাকথিত বাম ও বিপ্লবী দল। তারা সদ্য স্বাধীন ও নয় মাসের যুদ্ধে শ্মশানে পরিণত হওয়া একটি দেশকে শান্তিমতো গড়ে তোলার সুযোগও তারা বঙ্গবন্ধুকে দেয়নি। সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পরপর সর্বহারা পার্টি এবং জাসদের নেতৃত্বে দেড় বছরের মাথায় গণবাহিনী সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাধারণ মানুষের চাহিদা খুব বেড়ে গিয়েছিল। অনেকে ভেবেছিল স্বাধীন হলে অভাবঅনটন, শোষণনিপীড়ন কিছুই থাকবে না। জাদুমন্ত্রের মতো এক ফু্‌ঁতে সব ভেনিস হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতাটা তেমন ছিল না। এ কথাটি বঙ্গবন্ধু অনেক বক্তৃতায় জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এরপরও কারা জনগণকে ক্ষেপিয়ে দিতেন তা অজানা ছিল না বঙ্গবন্ধুর। তিনি ২৬ জুন, ১৯৭২ নোয়াখালী মাইজদিকোর্টে এক জনসভায় বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার বোনেরা আমার, একদল লোক আছে, রাস্তায় বের হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে দেখি নাই, ইয়াহিয়া খানের দালালি করেছে, আইয়ুব খানের দালালি করেছেন। এখন আমি গণতন্ত্র দিয়েছি, ওনারা কথা বলতে শুরু করেছেন। ফুটফাট চুপচাপ ফুঁসফাস করেন। একটু আস্তে আস্তে কও চানরা। ছিলা কোথায় চানরা? করেছিল কি চানরা? দালালি করেছ ইয়াহিয়া খানের, পয়সা খেয়েছ আইয়ুব খানের, পয়সা খেয়েছ ইস্কান্দার মির্জার। যখন জীবনের ১০১১টি বৎসর আমি জেলের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি, আমার সহকর্মীরা জেলের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে, তখন তোমরা বসে বসে কোরমা পোলাও খেয়েছ। এখন সুযোগ পাইয়া এটা করল না, ওটা করল না। কোত্থেকে করবো? খাজনা মাফ, ট্যাক্স মাফ, লবণ কর মাফ, পয়সা কোত্থেকে আসবে। করবো কোত্থেকে?’

একদিকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি এবং মাওলানা ভাসানী, জাসদ ও তথাকথিত বিপ্লবীদের অপতৎপরতা অন্যদিকে তার দল ও সরকারের কিছু অসাধু ব্যক্তি মিলে সৃষ্টি করেছিল এক নারকীয় পরিবেশ। এখনকার মতো মজুতদার, কালোবাজারী ও অশুভ সিন্ডিকেট তখনও ছিল। ২৯ মার্চ, ১৯৭২ চট্টগ্রামের পোলোগ্রাউন্ড মাঠের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একপর্যায়ে বলছেন, ‘বাংলার মানুষকে আমি না খেয়ে মরতে দেবো না। বাংলার মাটিকে আমি ভালোবাসি। বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। বাংলার মানুষের সাথে বেঈমানি আমি করতে পারব না। তাই সাবধান করে দিতে চাই। জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে পারবা না। যদি কোরো আমি পুলিশ দিয়ে তোমাদের ব্যবহার করতে চাই না। আমি আমার জনগণকে হুকুম দেব তোমার নাড়ি টিপে খতম করে দেবে। ভাবছ দুর্বলতা? না তোমাদের আমি দেখতে চাই। তোমাদের আমি বুঝতে চাই। তোমাদের আমি অনুরোধ করতে চাই। তোমাদের কাছে আমি আবেদন করতে চাই। আমার কর্মপন্থা আলাদা। তারপরে না হলে যা তোমাদের দরকার তাই দেয়া হবে। এমন দেয়া হবে যে জীবনে ভুলবা না।১৬ তারিখে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা ৩ মাস হয়েছে। কী করা যাবে? আসমান থেকে আনা হবে? চট্টগ্রাম পোর্ট ভেঙে জাহাজ ডুবেছে চাল এনেছি ভিক্ষা করে। গুদামে চাল নাই । আজ মানুষ যে না খেয়ে মরছে। গ্রামের মানুষ তো আমার কাছে দাবি করে না। তারা বলে মুজিব আমার কষ্ট করে আমরাও কষ্ট করি। শহরের মানুষ দামি কাপড় পইরা বলেন, এটা দাও, ওটা দাও। কি পেয়েছেন কি আপনারা? পারবো না আমি। আমার কাছে কিছুই নাই। আমি কিছু দিবার পারবো না।

দেশটি স্বাধীন হয়েছে তিন মাস হয়নি অথচ এরই মধ্যে দাবির পর দাবি তুলে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নাজেহাল ও ব্যতিব্যস্ত করে তোলা হচ্ছিল। তিনি নিরুপায়ের মতো নিজের অক্ষমতার কথা স্বীকার করছেন জনগণের সামনে। তাঁর আরেকটি বক্তৃতায় তার আরও করুণ চিত্র পাওয়া যায় যে কত কষ্ট করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন তিনি।

২ এপ্রিল, ১৯৭২ ঠাকুরগাঁওএ জনসভায় দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তিনি যেন কৈফিয়ত দিচ্ছেন, ‘স্বাধীনতার পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাঁচ লক্ষ টন খাবার দেবেন এবং খাবার দেওয়া শুরু করলেন আমার বাংলার ভুখা মানুষকে খাওয়ানোর জন্য। তিনি কিছু টাকা দিলেন। যা দিয়ে সরকার চালাতে শুরু করা হলো। তিনি কিছু মালপত্র দিলেন, যা দিয়ে কারখানা চালাতে আরম্ভ করলাম, তিনি কিছু লোক দিলেন যা দিয়ে রেললাইনগুলোকে চালু করা হলো। বলেন তো তার কাছে অকৃতজ্ঞ কী করে হই । আমি তো মানুষ। বাঙালি নিমক হারাম নয়।..কী করবার পারি বলেন? আইসে দেখলাম মানুষের কিছু নাই। ওরা খাজনা দেবার পারবে না। ওদের যদি খাজনা দেবার বলি তাহলে ওরা শেষ হয়ে যাবে। আমি বললাম, যাও কোনও প্রয়োজন নাই, বকেয়া খাজনা সব মাফ করে দাও।

তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন বাঙালির মধ্যে দুর্নীতিপ্রবণতা দেখে ফলে যেখানে যেতেন সেখানেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতেন কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হতো না কারণ, বাঙালি স্বাধীন হলেও জাতি হিসেবে নিম্ন শ্রেণি থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। ২৬ জুন, ১৯৭২ নোয়াখালী মাইজদিকোর্টে জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সে আক্ষেপ ফুটে উঠেছে।

আর একটা অসুবিধা হয়ে গেছে। আমি ভিক্ষাটিক্ষা করে আনি, গ্রামেগ্রামে পাঠাই, চাটার দল এখনও বলে মাঝে মাঝে চাইটে চাইটে চুরি করে খায়। আমি সাবধান করে দিচ্ছি। খবরদার। গরিবের হক কেউই মেরে খাবা না। আমি গরিবের জন্য, গরিব আমার জন্য। বাংলাদেশে গরিব কৃষকের রাজ কায়েম হবে। বাংলাদেশে গরিবের রাজ কায়েম হবে। শোষকের রাজ কায়েম হবে না। ভাইয়েরা আমার, ঘুষদুর্নীতি বন্ধ কোরো। ঘুষ খাওয়া বন্ধ কোরো। গরিবের রক্ত চোষা বন্ধ কোরো। গরিবের পয়সা মেরে খাওয়া বন্ধ কোরো। না হলে ভালো হবে না। তোমরা আমাকে চেন।

বড় বড় বাড়ি দখল করেছে, বড় বড় গাড়ি দখল করেছে বড় বড় জায়গায়। চারটা এখন বাজে। এই চারটার পর থেকে বড় বড় শহরে অ্যাকশন নেওয়া হবে। যারা বাড়িঘর লুট করেছে তাদের বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হবে। যারা গুদামে চাল রেখে চালের দাম বাড়ায়ে গরিবকে লুট করে খাবার চায়, তারা সাবধান হয়ে যাও। আইন আমি পাস করছি। আইন আমার আছে। দরকার হলে আরও করবো। দরকার হয় এমন আইন করবো যে, প্রকাশ্য জায়গায় গুলি করে মারা হবে এই চোরদের। কিন্তু গরিবকে লুট করে খাওয়ার দেওয়া হবে না।’

দেশকে গড়ে তুলতে জাতির কাছে মাত্র তিন বছর সময় চেয়েছিলেন তিনি। তিন বছরের মধ্যে তিনি গুছিয়েও এনেছিলেন। সমাজতন্ত্রকে সুসংহত করতে বাকশাল গঠন করে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এদেশের শত্রুরা তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। সাড়ে তিন বছরের মাথায় হত্যা করা হয় তাঁকে। চট্টগ্রামে জনসভাতেই তিনি বলেছেন, ‘আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি যদি যুদ্ধ চলত আরও তিন বছর কী করতেন আপনারা? যুদ্ধ করতেন না, না খেয়ে কষ্ট করতেন না? নতুন জীবন শুরু করতে হবে, পারবেন? ভাইয়েরা আমার বোনেরা আমার বাংলাদেশ হবে গরিবের দেশ, বাংলাদেশ হবে কৃষক এবং শ্রমিকের দেশ, এতে কোনও সন্দেহ নাই।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য আবিষ্কার হতেই থাকবে এবং সে সঙ্গে তার পাশাপাশি অকৃতজ্ঞ এ জাতির স্বরূপও উন্মোচিত হতে থাকবে।

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅক্ষরের অস্ত্র হাতে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি ভাবনা