কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৭ জুন, ২০২১ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

বেলবটম, এভারগ্রিন এবং ও ‘ও প্রাণের রাজা’

ঝাঁকড়া চুল, বডিফিট শার্ট, হাইহিল জুতো আর বেলবটম প্যান্ট এই ছিল স্বাধীনতাপরবর্তী প্রজন্মের ফ্যাশন।
বেলবটম প্যান্ট ছিল বড় অদ্ভুত। কোমরের কাছে টাইট আর নিচের দিকে নামতে নামতে ঢোলার আয়তন দাঁড়াতো ত্রিশ থেকে চল্লিশ ইঞ্চি। বটম অর্থাৎ তলা বা প্রান্তটা ঘণ্টার মতো গোল হতো বলে নাম হয়েছিল বেলবটম। প্যান্টের বেল্ট হতো বেশ চওড়া। কাঠের তৈরি জুতোর হিলের উচ্চতা হতো তিন থেকে ছয় ইঞ্চি। শার্টের কলার হতো বেশ চওড়া, অনেকটা রামছাগলের কানের মতো।
প্রথম ফ্যাশন হিসেবে যোগ হলো চুলে তেল না দেওয়া। অনেকে অবশ্য দাড়িও রাখতো। দাড়ি রাখার ট্রেন্ডটি এসেছিল স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে। তবে ওই সময়ের তরুণদের অধিকাংশই ছিল পাতলা ও ছিপছিপে। ঘড়ি ছিল ঢাউস টাইপের। শুকনো কাঠির মতো হাতে বড় ঘড়ি বেমানান দেখালেও কিছুক্ষণ পরপর হাত ঝাঁকিয়ে সে ঘড়ি প্রদর্শন করার প্রবণতাও ছিল অনেকের মধ্যে। তখন দেশে আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, জানে আলমদের মতো পপস্টারদের দারুণ জনপ্রিয়তা। একটি গন্দমের লাগিয়া আল্লাহ বানাইলো রে দুনিয়া, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, আলালের দুলাল, মামুনিয়া ও মামুনিয়া গানগুলো তখন তরুণদের মুখে মুখে। বিদেশি ব্যান্ডের মধ্যে বনিএম, অ্যাবা ইত্যাদি খুব জনপ্রিয়। বনিএমের কয়েকটি গান তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
আমি এসএসসি পাস করি ১৯৭৬ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র আমি। ৭৬ সালের শেষের দিকে আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো। সে উপলক্ষে আমরা ছোটরা নতুন কাপড় পেতে যাচ্ছি। বড় ভাই একদিন শহরে নিয়ে এলেন প্যান্ট-শার্টের কাপড় কেনা হবে বলে। কাপড় কেনাও হলো। এবার সেলাইয়ের পালা। সে সময় তৈরি পোশাক পাওয়াই যেত না, গেলেও দামের কারণে তা কিনতো না বেশিরভাগ লোক। তখন কয়েকটি জনপ্রিয় টেইলারিং শপ ছিল। তার অধিকাংশই নিউমার্কেটে। আমার ইচ্ছে ছিল জহুর হকার্স মার্কেটের মুখে অবস্থিত এ্যারো টেইলার্সে সেলাই করা। কিন্তু বড়ভাই নিয়ে গেলেন নিউমার্কেটের বি ব্লকে একটি দোকানে। প্যান্টের মাপ দেওয়ার সময়ে নিচের দিকে ত্রিশ ইঞ্চি ঢোলা দেওয়ার কথা শুনে বড়ভাইয়ের চক্ষু কপালে উঠে গেল। আমাকে ধমক দিয়ে সে ঢোলা মাত্র আঠারো ইঞ্চিতে নামিয়ে আনা হলো। মনে মনে ভেবে রেখেছি জুতো নেব অন্তত পাঁচ ইঞ্চি হিলের। বড় ভাই এখানেও ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তা মাত্র আড়াই ইঞ্চিতে নামিয়ে আনলেন।
বাড়ি ফিরলাম খুব মন খারাপ করে। মন খারাপের কথা মাকে জানালাম। বোঝালাম কাপড় নতুন হলেও তা পরে আমি সামান্যও আনন্দ পাবো না। মা বুঝলেন। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যে এসব বিষয়ে আমার চেয়ে অনেক স্মার্ট। তাকে গিয়ে মনের কষ্ট বোঝালাম। সিদ্ধান্ত হলো সকালে শহরে গিয়ে প্যান্টের মাপ ঠিক করা হবে। এবং তাই হলো কিন্তু জুতোর দোকানদার জুতো বদলাবার সুযোগটি দিলেন না। পাঁচ ইঞ্চি হিলের জুতো পরতে না পারার দুঃখ বেশ কয়েকবছর আমাকে বহন করতে হয়েছে।
সে সময় আমাদের বিনোদন বলতে ছিল সিনেমা দেখা। স্বাধীনতার পরপর আমাদের সিনেমাও পাল্টে গেল। সহজ -সরল হাবাগোবা ভালো মানুষ নায়কের স্থান দখল করে নিল রংবাজের নায়ক। সিনেমার গল্প পাল্টাতে লাগল। সেখানে উঠে আসতে লাগল স্বাধীনতা পরবর্তীকালের তরুণদের হতাশা, ক্ষোভ এবং সমাজের অস্থিরতা। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় দেশের প্রথম রঙিন ছবি বাদশা। পরিচালক আকবর কবির মিন্টুর এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন খশরু, শাবানা, নূতন। এই ছবির একটি গান অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ‘আরে ও প্রাণের রাজা’ দৈতকণ্ঠের গানটি গেয়েছিলেন প্রবাল চৌধুরী ও তার বোন উমা খান। সেসময় তিনি উমা ইসলাম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই গানটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় গান হিসেবে বিবেচিত হবে। ছবিটি দেখেছিলাম আলমাসে। আমরা সেসময় পপ গানের পাশাপাশি সিনেমার গান নিয়েও মেতে থাকতাম। রেডিওর অনুরোধের আসর এবং দুপুরে বিজ্ঞাপন তরঙ্গের সঙ্গে ছায়াছবি নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানের ভক্ত ছিলাম আমরা।
এর পাশাপাশি তখন টু-ইন-ওয়ানের তুমুল জনপ্রিয়তা। ক্যাসেটে গান শোনা, গানের তালিকা করা,নিউ মার্কেটের চারতলায় সরগম, গীতাঞ্জলি, ঐকতানসহ অন্যান্য রেকর্ডিংয়ের দোকানে নতুন গানের খবর নেওয়া ছিল নিয়মিত কাজ।
এই বেলবটম চলটি ৭০ দশকের শেষের দিকে বিদায় নেয়, আসে স্ট্রেটকাটের প্যান্ট। চওড়া বেল্টের জায়গায় আসে একেবারে সুরু বেল্ট। শার্টের কলার ছোট হয়ে গেল তার টাইটফিট অবস্থা আর রইল না।
আশির দশকের শুরুর দিকে নিউমার্কেটে বেশ কিছু টেইলারিং শপ ছিল। নিচের তলায় আলমগীর নামে একটি দোকান ছিল জিন্স ও প্যান্টের কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। ডিকেন্স, গ্রিনউইচ এভারগ্রিন টেইলার ছিল পুরুষদের। দোতলায় বেশ কিছু টেইলারিং শপ ছিল নারীদের। তিনতলায় এভারগ্রিন টেইলার্স ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর মালিক ছিলেন সিদ্দিক নামে এক ব্যক্তি তবে আমরা সবাই তাকে সিদ্দিক মামা বলেই ডাকতাম। তিনি ছিলেন সবার মামা। বড়-ছোট সবাই তাকে মামা বলেই সম্বোধন করতেন। তুমুল জনপ্রিয় এই দোকানে শহরের ফাশনসচেতন সবাই আসতেন। সিদ্দিক মামা তখন এতই ফর্মে ছিলেন যে, তার সঙ্গে পরিচয় আছে এটাও অনেকের শ্লাঘার বিষয় ছিল। তিনি একসময় লেডিস টেইলারও করেছিলেন। এভারগ্রিনে শার্ট-প্যান্ট বানানো ছিল স্মার্টনেস ও আভিজাত্যের লক্ষণ। সে সময় প্যান্টের ট্রায়াল দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
এখন মানুষ রেডিমেড কাপড় কিনতে অভ্যস্ত। তাছাড়া তৈরি পোশাকশিল্পের প্রসারের কারণে তাদের রিজেক্ট হওয়া কাপড়ই খুব অল্প দামে পাওয়া যায় ফলে আগের জৌলুশ হারিয়ে এভারগ্রিন টেইলার্স এখন কোনোভাবে টিকে আছে বিপণি বিতানে।
এভারগ্রিনের জৌলুশ না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি কোনোভাবে হলেও টিকে আছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে বিখ্যাত ডায়মন্ড রেস্তোরাঁ, যেখানে খাওয়া-দাওয়া করা ছিল একসময়ে আভিজাত্য ও বড়লোকি ব্যাপারস্যাপার। এই রেস্তোরাঁর কাটলেট, বোম্বাই টোস্ট আর ব্রেকফাস্টে পরোটার সঙ্গে লিভার ও ডালফ্রাইয়ের স্বাদ অনেকে এখনও ভোলেননি। সে ডায়মন্ড এখন নেই। নেই মার্কেটের উল্টো দিকের চিমবুক রেস্তোরাঁও।
বিপণি বিতানের পশ্চিম পাশে। নিচে হার্ডওয়ার সামগ্রী ও কয়েকটি স্বর্ণের দোকান ছিল। তার ওপরে দোতলায় একটি চমৎকার রেস্তোরাঁ ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিখ্যাত একটি পাহাড়ের নামে নাম চিমবুক। অবশ্য পাহাড়টি ‘চিম্বুক’ বানানেই বেশি পরিচিত। প্রশস্ত এই রেস্তোরাঁ বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছিল তার বিশেষ কয়েকটি খাবারের কারণে। আর সে সাথে ছিল একটি খোলা বারান্দার মত জায়গা। সন্ধ্যার পরে বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থী আর শিল্পী সাহিত্যিক ও নতুন লেখকদের আড্ডায় মুখর হয়ে থাকতো সে অঙ্গন। সময়টি গত শতকের সত্তর ও আশির দশক। নগর তখনও মানুষ ও যানবাহনে এমন ভারী হয়ে ওঠেনি। সন্ধ্যায় খোলা বারান্দায় খোলা হাওয়ায় দোল খেতে খেতে কত নব্য কবি তার প্রেয়সীর জন্য পঙক্তি রচনা করেছে, কত লেখক তার লেখার উপাদান খুঁজে পেয়েছে। কত প্রেম, কত বিরহ, কত আনন্দ বেদনার সাক্ষী ছিল এই চিমবুক রেস্তোরাঁ। বিপণি বিতানের ডায়মন্ড রেস্টুরেন্ট আর এই চিম্বুককে ঘিরে কত যে গল্প আছে এই শহরে। কত যে স্মৃতি আছে অনেকের বুকে। মাঝে মধ্যে ভাবি এ সব কিছুই যদি কথা বলে উঠতে পারতো, তবে হয়ত প্রলয় ঘটে যেত। তখন শহরে এখনকার মতো এত ঝলমলে অসংখ্য রেস্তোরাঁ ছিল না। শহরের বনেদি মার্কেট ছিল বিপণি বিতান। কাজেই এর আশেপাশেই গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহ। সিনেমা দেখার আগে বা পরে সচ্ছল পরিবারের সদস্যরা কিছু খেতে চাইলে এ দুটি রেস্তোরাঁকে বেছে নিতো। ’৯০ দশকের শুরুর দিকে চিম্বুক বন্ধ হয়ে গেল।
বলছিলাম সিনেমার কথা। চিম্বুকের কিছুটা উত্তরে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো জলসা সিনেমা হল। এই হলটির স্থাপত্য ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের নান্দনিকতায় মুগ্ধ হতেন সবাই। এমন কি রাজধানী থেকে বেড়াতে আসা অনেকেও। সম্পূর্ণ শীতাতপ এই হলটি শহরের অন্যতম জনপ্রিয় হল ছিল এবং এই হলে সিনেমা দেখা আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এর প্রতি তলায় একটি করে রেস্তোরাঁ ছিল। শো শুরুর আগে-পরে এবং ইন্টারভ্যাল বা বিরতির সময় ক্রেতায় পূর্ণ থাকতো রেস্তোরাঁগুলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই হলে ছবি দেখতো বেশি। ’৭০ ও ’৮০ দশক ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালীকাল। সিনেমা হলের ব্যবসা তখন জমজমাট। কোন সপ্তাহে কোন ছবি চলবে তা জানিয়ে দেওয়া হতো আগাম। শহরের পরিবারের কে কোন সপ্তাহে কোন ছবি এবং কোন শো’টা দেখবে তা পরিকল্পনা করে রাখতো আগে থেকেই। তখন বিনোদনের অন্য কোনো মাধ্যমও ছিল না। টেলিভিশন কেবল জনপ্রিয় হতে যাচ্ছে। একই দশকে আরও দুটি সিনেমা হল স্থাপিত হলো। স্টেশন রোডে নূপুর ও মেলোডি। নূপুর ছিল বড়, মেলোডি ছিল ছোট হল। নূপুরে সাধারণত বাংলা ছবি এবং মেলোডিতে ইংরেজি ছবিই বেশি দেখানো হতো। তবে নূপুরেও বিখ্যাত ইংরেজি ছবিগুলো দেখানো হতো। নূপুর উদ্বোধন হয়েছিল ‘লর্ড জিম’ ছবিটি দেখানোর মাধ্যমে। (চলবে)
লেখক : কবি- সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনের ওপর চাপ কমাতে করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম