একজন সম্পাদক এবং একজনের কলামলেখক হয়ে ওঠা
একদিন আজাদী অফিসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে সম্পাদক সর্বজন শ্রদ্ধেয় এম এ মালেক অনেকটা অভিযোগের সুরে বললেন, আপনি আমাদের কাগজে নিয়মিত লেখেন না কেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, লিখি তো।
এখন থেকে প্রতিসপ্তাহে নিয়মিত লিখবেন বলে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন দাদামনি অরুণ দাশগুপ্ত ও সিদ্দিক আহমেদ ভাইয়ের সামনে (তাঁরা দুজনেই প্রয়াত হয়েছেন)। বললেন, এখন থেকে বাদল সাহেব নিয়মিত লিখবেন, তারপর আমার দিকে দৃকপাত করে বললেন, কলামের জন্য একটা নাম ঠিক করে দিন।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেলাম। আমি মাঝেমধ্যে লেখা জমা দিলেই দাদামনি বা সিদ্দিক ভাই তা ছাপিয়ে দেন। কখনো কোনো ওজর–আপত্তি করেননি। আজ সম্পাদক মহোদয় সরাসরি বলায় তাঁরা কি মনে করবেন যে, আমি সম্পাদকের কাছে নালিশ করেছি বা তাঁদের ডিঙিয়ে সরাসরি সম্পাদকের কাছে লেখা ছাপানোর অনুরোধ করেছি? যেখানে আমার খুশি হওয়ার কথা সেখানে মনে কিছু দ্বিধা নিয়ে ঘরে ফিরলাম। তবে কয়েকদিন পরে লেখা জমা দিতে গিয়ে দুজনকেই সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিলাম। দেখলাম তাঁরা কিছুই মনে করেননি বরং তাঁদের উদার মনোভাব দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করেছেন।
সে থেকে শুরু। এরপর আজাদী ছাড়াও সুপ্রভাত বাংলাদেশ, পূর্বদেশ, আমাদের সময় ও বিডিনিউজ২৪. কম–এ প্রচুর লিখেছি। সেসব থেকে কিছু লেখা নিয়ে ‘স্বকালচিত্র‘ গ্রন্থটি বেরিয়েছে। সঙ্গত কারণে বইটি উৎসর্গ করেছি পরম গুরুজন এম এ মালেক মহোদয়কে। কারণ তিনি সেদিন চেপে না ধরলে আমার মতো অলস ব্যক্তির পক্ষে প্রতি সপ্তাহে একটি লেখা তৈরি সম্ভব হতো না।
অসাধারণ এই মানুষটির কাছে যতবারই গেছি ততবারই ফিরে এসেছি দারুণ মুগ্ধতা নিয়ে। এই বয়সে এত সপ্রাণ, এত ইতিবাচক, এত জীবনরসে ভরপুর ব্যক্তি আর দেখিনি। প্রতিবারই নতুন কিছু না কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে।
আমরা যখন সিআরবিতে নববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম তখন পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে ছিল না। একটি পক্ষের প্রবল বিরুদ্ধতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়েছিল আমাদের। অনুষ্ঠানটির আয়োজক আমরা হলেও প্রথমবার সভাপতি এমন এক ব্যক্তিকে করতে চেয়েছিলাম সারা দেশে যাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে। সে ভাবনা থেকে প্রথমবারই তাঁকে সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি সবিনয়ে বললেন, প্রথমবার নয়, পরের বছর থেকে তিনি দায়িত্ব নেবেন। আমরা প্রথমবার সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলাম এবার একুশে পদক প্রাপ্ত বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. মনিরুজ্জামান স্যারকে। প্রথমবছর দায়িত্ব না নিলেও তিনি সকাল থেকে অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত মঞ্চের পাশে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সেদিনের একটি ঘটনার কথা কোনোদিন ভুলব না। সেদিন রাত আটটা/সাড় আটটার দিকে যখন অনুষ্ঠান শেষ করতে যাচ্ছি তখনও চারপাশে হাজার হাজার দর্শক অনুষ্ঠান চালানোর জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে। সে সময় তিনি পকেট থেকে টাকার বান্ডিল বের করে আমাদের বললেন, যা টাকা লাগে নিয়ে যান। শিল্পী নিয়ে আসুন। তখন অবশ্য সে উপায় আর ছিল না।
দ্বিতীয় বছর থেকে তিনি দায়িত্ব নেন সভাপতির। এখন অব্দি তিনি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম–এর সভাপতি। মূলত তাঁর নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসবটি কোনো স্পন্সর না নিয়ে, কোনো চাঁদা না নিয়ে সফলভাবে উদযাপিত হচ্ছে। সিআরবিই বর্তমানে সারা দেশের মধ্যে নববর্ষ উদযাপনের বড় আয়তন।
এম এ মালেক প্রচণ্ড ধার্মিক মানুষ তবে তিনি যে গোঁড়া বা ধর্মান্ধ নন তার প্রমাণ পেলাম তিনি যে বছর দায়িত্ব নিলেন সে বছরেই। দ্বিতীয় বছর আমরা যখন মাঠে প্রস্তুতির কাজ করছি তখন সেখানেও একটি পক্ষ প্রবল বিরোধিতা করতে এসেছিল পাশে মসজিদ আছে এমন ইস্যু নিয়ে। সেদিন খুব দৃঢ়ভাবে অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন মালেক সাহেব। স্বীকার করতে হবে যে, সেদিন তিনি তীব্র প্রতিবাদ করে তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় না থাকলে সিআরবিতে অনুষ্ঠান করা সবার জন্য কঠিন হয়ে পড়তো।
তাঁর মতো বয়োজ্যেষ্ঠ সম্পাদক এখন আর নেই। এত দীর্ঘকাল সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিও বিশেষ আর নেই। ছাপাখানার ক্রমবিকাশ, বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ক্রমবিকাশ তাঁর মতো এতো কাছে থেকে আর কেউ প্রত্যক্ষ করেননি। তাই আমি তাঁকে এ বিষয়ে জীবন্ত অ্যানসাইক্লোপেডিয়া বলে থাকি। তিনি ছাপার মেশিনের শব্দ শুনেই বুঝতে পারেন কোনো সমস্যা আছে কি না।
তিনি চট্টগ্রামে অনেক অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে ইমপেরিয়াল–অ্যাপোলো হাসপাতাল অন্যতম। এর বাইরে তিনি মা ও শিশু হাসপাতালে ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল কয়েকদিন আগে তাঁর অফিসকক্ষে। কথা বলতে বলতে তাঁর কাছে আসা এক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর কথা বলতে গিয়ে তিনি কেঁদে দিলেন। ভাবলাম, একজন মানুষ মানুষের প্রতি কতটা আত্মনিবেদিত হলে এমন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে পারেন। তাঁকে নিয়ে আরও অনেক কিছু লেখার আছে। লিখতে হবে, তবে তা তাঁর কাগজে নয়।
তাঁর নিরোগ দীর্ঘজীবন কামনা করি। তিনি আছেন বলে অনেকে হয়ত এখনো অনুধাবন করতে পারি না তিনি কতটা বড় মাপের মানুষ।
লেখক : কবি–সাংবাদিক










