কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৩ নভেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আগস্ট থেকে নভেম্বর : হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা

মোহাম্মদ তোয়াহা ছিলেন একজন বাম রাজনীতিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে না নেওয়া বামদের মধ্যে তিনি এবং তাঁর দল ‘সাম্যবাদি দল’ ছিল অন্যতম। ওই সময় প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সরকারকে উচ্ছেদ করার হুমকি প্রদান ছিল তাঁদের প্রধান কাজ। স্বাধীনতার পর বিভিন্নকারণে তাঁর ওপর হুলিয়া জারি হয়। পুলিশ পেলে তাঁকে গ্রেফতার করবে। তিনি গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকছেন এবং খুব কষ্টে জীবনযাপন করছেন। এই খবর শুনে তোয়াহাকে ডেকে পাঠালেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, এভাবে তো বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে না। তুমি এক কাজ করো আমার বাসাতেই থাকো। তুমি এখানে লুকিয়ে আছো সেটা তো কেউ সন্দেহ করবে না।
এই বাম বিপ্লবী বঙ্গবন্ধুর আশ্রয়েই ছিলেন বেশ কিছুদিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৮ আগস্ট সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বিবৃতি ছাপা হয় পত্রিকায়। সেখানে বলা হয়, ‘বিগত ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনী রুশ-ভারতের নিয়ন্ত্রিত খুনি দুর্নীতিবাজ মুজিব সরকারকে উৎখাত করেছে। দেশবাসী তাতে আনন্দিত। আমরাও সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশকে স্বাগত জানাই।’
স্বাধীনতার পর মাওলানা ভাসানীরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সর্বদা বিষোদগার করলেও তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে তার প্রভাব পড়েনি। তার অন্যতম কারণ হলো বঙ্গবন্ধু ভাসানীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর খোঁজখবর নিতেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু ভাসানীর নিকট নিয়মিত টাকাও পাঠাতেন। সে ‘মজলুম জননেতা’ ১৬ আগস্ট খোন্দকার মোশতাকের নিকট পাঠানো এক বার্তায় নতুন সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান এবং এই পরিবর্তনকে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেন। ভাসানী মোশতাকের উদ্দেশে বলেন, ‘আল্লাহ আপনার ও নয়া সরকারের সহায় হোন।’
আতাউর রহমান খান ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বাকশাল গঠিত হলে তিনি সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্টকে তিনি ‘নাজাত দিবস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। জেনারেল ওসমানী মোশতাক সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। শফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়া হলেন সেনাপ্রধান। কোনো বিদেশির জন্য ওপরের খবরগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও প্রতিটি বাঙালির জন্য এইসব তথ্য কোনো বিস্ময় সৃষ্টি করবে না। এ খবর কাউকে অবাক করবে না। কারণ বাঙালির ক্ষেত্রে এসব সাধারণ ও মামুলি ঘটনা। বাঙালি নিজেরাই জানে বিশ্বাসঘাতকতা তাদের চরিত্রের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অনেককিছুই রাতারাতি বদলে গিয়েছিল। মানুষের মুখোশগুলো অবিরাম খুলে পড়ছিল। তার অন্যতম কারণ হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড স্রেফ ক্ষমতা বদলের জন্য হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল আদর্শকে, স্বপ্নকে, সভ্যতাকে, সুন্দরকে। হত্যাকারীরা ছিল প্রতিবিপ্লবী, অপশক্তি, ধর্মাবেপারি আর ভয়ংকর মিথ্যাবাদী। এরা সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য পাল্টে দিয়েছিল। এই খুনীরা হাতে জাতির পিতা ও তার পরিবারের নিরপরাধ সদস্যদের রক্তের দাগ নিয়ে বেতারে গিয়ে দেশকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বলে ঘোষণা দিয়েছিল। নিষ্ঠুর খুনীরা তাদের কৃতকর্ম ঢাকতে চেয়েছিল ধর্মের আড়ালে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনীরা সদ্যস্বাধীন দেশটিকে এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। বঙ্গভবন থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র বিরাজ করছিল নিয়ন্ত্রণহীন শাসনব্যবস্থা। কয়েকজন খুনী সেনা অফিসারের খেয়ালখুশিমতোই পরিচালিত হচ্ছিল দেশ। আর এই পরিস্থিতি অবলোকন করে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। ফলে আরেকটি অভ্যুত্থান তখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সে সময় ঘটনার সম্মুখে উপস্থিত হন দেশের অন্যতম সেরা মুক্তিযোদ্ধা-সেনাকর্মকর্তা খালেদ মোশাররফ।
পরিস্থিতি যখন খুনীদের বিপক্ষে যাচ্ছে তখন তারা স্থির করে আওয়ামী লীগকে বিনাশ করতে হলে তার নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দিতে হবে। যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তারা ছাড়া যারা ক্ষমতার লোভে মোশতাকের সঙ্গে জুটেছিল, যারা জীবনের ভয়ে বা কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের আস্থায় রেখে আওয়ামী লীগের আদর্শবান নেতা যারা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, প্রয়োজনে আবার আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য, মোশতাকের সঙ্গে আপোষ না করে জেলজীবন বেছে নিয়েছেন এমন নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের সময় আওয়ামী লীগনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। তাঁর বয়ান থেকে জানা যায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারা পুলিশ মহাপরিদর্শকের পুরনো অফিসকে ‘নিউ জেল’ নাম দিয়ে বন্দীদের রাখা হতো। ওখানে কামরা ছিল তিনটি। এক নম্বরে রাখা হয়েছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমেদকে। দুই নম্বর কামরায় আরও কয়েকজনের সঙ্গে ছিলেন কামারুজ্জামান। আর তিন নম্বরে রাখা হয়েছিল ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও আব্দুস সামাদ আজাদকে। যে খুনীরা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করতে কারাগারে এসেছিল প্রথমে তাদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছিল। তখন খোন্দকার মোশতাক বঙ্গভবন থেকে আইজি (প্রিজন)-কে ফোন করে অস্ত্রধারী সৈনিকদের জেলের ভিতরে ঢোকার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা কারাগারে প্রবেশ করে এক নম্বর কামরায় যেখানে সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন ছিলেন সেখানে দুই ও তিন নম্বর কামরা থেকে কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে নিয়ে আসে এবং জাতীয় এই চার নেতার ওপর ব্রাশফায়ার করে। আওয়ামী লীগের পক্ষে অভ্যুত্থান ঘটলেও আওয়ামী লীগ যেন নেতৃত্বশূন্যতায় পড়ে সে লক্ষ্যেই জেলহত্যার মতো বিশ্বের ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিল মোশতাক।
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড পৃথকদিনে ঘটলেও হত্যার উদেশ্য এবং হত্যাকারীরা একই। অর্থাৎ একই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের আচরণগত কিছু বিশেষত্ব ছিল। ওই সময়ের ছবি ও টিভি ফুটেজগুলোতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আশেপাশে কোনো নেতার মাথায় টুপি নেই ব্যতিক্রম একমাত্র খোন্দকার মোশতাক। মোশতাক অদ্ভুত ধরনের একটি কালো টুপি মাথায় দিতেন। বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, ‘তোরা জানিস না ওর কত বুদ্ধি। এই টুপি দিয়েই ঢেকে রাখে। প্রেসিডেন্ট হয়ে মোশতাক দেশে ইসলামি পোশাকের প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই টুপিকে তিনি তার কথিত ইসলামি পোশাকের অংশ করেছিলেন। দিল্লিতে তৎকালীন হাই কমিশনারের কর্মকর্তা কামালউদ্দিনের একটি বক্তব্য পাওয়া যায় মহিউদ্দিন আহমেদের ‘বেলা-অবেলায়। কামালউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কাছে বার্তা পাঠালেন, পাঁচ শ টুপি ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে পাঠাও। উনি (মোশতাক) জানতেন দিল্লিতে এটা জোগাড় করা সম্ভব।’
আরেক বিশ্বাসঘাতক তাহেরউদ্দিন ঠাকুর হাতে জায়নামাজ নিয়ে হাঁটতেন। মোশতাক ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদপন্থী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়ায় দু দেশের দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। মার্কিন দলিলে উল্লেখ করা হয়, ‘১৯৭৫ সালের আগস্টে একট দুর্নীতিগ্রস্ত, অকার্যকর সহিংসপ্রবণ হয়ে ওঠা সরকারের পতন ঘটাতে সংকল্পবদ্ধ তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের পরিচালিত অভ্যুত্থানে মুজিব নিহত হন।’ অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি পত্রিকা প্রাভদায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘মুজিব ও তাঁর পরিবারকে হত্যাকারী কসাইদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর বিয়োগান্ত মৃত্যুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ গভীর শোক প্রকাশ করছে।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কারা ক্ষমতায় এসেছিল এবং দীর্ঘ ২৬ বছর এ দেশকে শাসন করেছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় ১৫ অগাস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিবৃতিতে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের প্রতি আমাদের প্রথম ও স্বতঃস্ফূর্ত শুভেচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে (পাঠক লক্ষ্য করুন, ‘প্রথম ও স্বতঃস্ফূর্ত শুভেচ্ছা’) আমি পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে ৫০ হাজার টন চাল, ১ কোটি গজ কাপড় উপহার হিসেবে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ সেদিন খুব ভোরবেলা তাড়াহুড়ো করে পাকিস্তানের সংসদ অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে এই সংবাদ উদযাপনের জন্য।
বঙ্গবন্ধু বা জেলহত্যা কারা কীভাবে ঘটিয়েছিল তা আজ কমবেশি অনেকেই জানেন। আমি নতুন কোনো তথ্য দেওয়ার জন্যও আজকের লেখাটি তৈরি করছি না। আমি বলতে চাইছি, যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, যে আদর্শ ও লক্ষ্যকে হত্যা করতে চেয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকের বিচার হলেও সমাজে তাদের চিন্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবকে কমানো যায়নি বরং তা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে থাকলেও সমাজ পরিচালিত হচ্ছে একাত্তরের ঘাতকদের আদর্শে। ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান ও প্রভাব, সমাজে ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সর্বক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাব দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে প্রকৃত ধার্মিকের সংখ্যা বাড়ছে না। বাড়ছে ভণ্ডদের সংখ্যা। ধর্মকে পণ্য করে তোলায় সমাজে ঘুষ-দুর্নীতি, নকল-ভেজাল, ধর্ষণ-বলাৎকার বেড়ে চলেছে। আর এসবের অধিকাংশই ঘটছে ধর্মীয় লেবাসের অন্তরালে। পঁচাত্তরের ঘাতকদের মতো ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে মোশতাকের মতো বকধার্মিক বাড়ছে, বঙ্গবন্ধুর মতো প্রকৃত ধার্মিকের সংখ্যা কমছে।
এখন সময় এসেছে পরিস্থিতিকে বোঝার। কারণ এই ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকেই শুধু হত্যা করেনি তারা হত্যা করেছিল প্রকৃত বাংলাদেশকে, মৌলিক বাংলাদেশকে, যে বাংলাদেশ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত আর তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত। যে বাংলাদেশের মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। রাষ্ট্রে এ দুই নীতির অনুপস্থিতি ঘাতকদের সাফল্যের কথাই মনে করিয়ে দেবে। যা হতে দেওয়া যাবে না।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিভীষিকাময় রক্তক্ষরা জেলহত্যা দিবস
পরবর্তী নিবন্ধ৩ নভেম্বর : প্রাসঙ্গিক কথা