কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২১ জুলাই, ২০২২ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ‘শ্রীলঙ্কা’ হলে লাভ কার

দেশের কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা এবং দেশের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর কথাবার্তা, বক্তৃতা-বিবৃতি শুনলে মনে হয় বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেন শ্রীলঙ্কার মতো হচ্ছে না তা নিয়ে তাদের মনোবেদনার শেষ নেই। অনেকে রাতে ঘুমাতে যাচ্ছেন বুকভরা আশা নিয়ে যেন ঘুম থেকে জেগে শুনবেন বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতির সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও পুরানা পল্টন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিদিন হাসিনা সরকারের সৎকার করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হলে লাভ কার?

আমার বিশ্বাস বিশ্বের কোথাও অর্থাৎ কোনো দেশের নাগরিক তার দেশের এমন সর্বনাশ কামনা করবে না। এমনকি আফগানিস্তান, এমনকি পাকিস্তানেও না। এটা বাংলাদেশে সম্ভব। এদেশের নাগরিকদের একটি অংশ এখনো এই দেশকে আপন করে নিতে পারলোই না।

তাদের এই অবস্থা দেখে একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। এক লোক সারাদিন অকর্মণ্যভাবে ঘরে পড়ে থাকে আর সারাদিন স্ত্রীর গঞ্জনা সহ্য করে। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে চলে গেল গভীর বনের মধ্যে। সারাদিন কাটিয়ে দিল একটি গাছের নিচে। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতরাচ্ছিল। দূর থেকে তাকে খেয়াল করছিলেন এক দেবদূত। তার খুব দয়া হলো লোকটির দুরাবস্থা দেখে। একসময় তিনি এগিয়ে এসে বললেন, বৎস্য তোমার কী হয়েছে? তুমি কি পরিবার ত্যাগ করে এসেছ? লোকটি তার দুরবস্থা সবিস্তারে বর্ণনা করল। শুনে দেবদূত বললেন, বৎস্য তোমাকে আমি একটা বর দিতে চাই। তোমার অভাব আর থাকবে না। তোমাকে পরিশ্রমও করতে হবে না। দেবদূত একটি শ্লেট ও পেনসিল দিয়ে বললেন, তোমার যা দরকার তা বলে এই পেন্সিল দিয়ে শ্লেটে একটি দাগ দেবে। সঙ্গে সঙ্গে তোমার কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়ে যাবে। তবে একটি শর্ত থাকবে তাহলো তুমি যা পাবে তোমার প্রতিবেশীরা তার দ্বিগুণ পাবে। তুমি কি এই শর্ত মেনে বরটি নেবে? লোকটি এতবড় বর পেয়ে এমনিতেই খুশিতে আটখানা। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। লোকটি শ্লেটপেনসিল নিয়ে বাড়ি এলো। দেখে বউ বলে, সারাদিন কোথায় ছিলে? আজও খালি হাতে ঘরে এসেছো?

লোকটি বলল, আরে খালি হাতে না। কী এনেছি দেখো। শ্লেটপেনসিল দেখিয়ে বলল, তুমি কী খেতে চাও বলো। স্ত্রী বলল, যা খেতে চাই তা খাওয়াতে পারবে? আলবৎ পারব। তুমি শুধু বলো। স্ত্রী বলল, পোলাও, কোরমা, কালিয়া, কাবাব। লোকটি এসবের নাম বলে শ্লেটে একটি দাগ দিল অমনি ওদের সামনে এসে গেল খাবারগুলো। স্ত্রী বলল, আরে কোরমা-পোলাউ মাটিতে বসে খাব কেন, ডাইনিং টেবিল আনতে বলো। সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিং টেবিল এসে গেল। এভাবে করতে করতে প্রায় শেষ রাতে স্বামী-স্ত্রী যখন ঘুমাতে গেল তখন প্রায় শেষ রাত আর তাদের দোতলা বাড়িটি আধুনিক ও দামি আসবাবে পরিপূর্ণ। সকালে গ্রামবাসীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে স্বামী-স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল। কী হয়েছে দেখতে এসে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। দেখে তার প্রতিবেশী সবার বাড়ি চারতলা হয়ে গেছে। জৌলুশ ও সৌন্দর্যে তাদের চেয়ে দ্বিগুণ। দেখে স্বামীর মনে পড়ল দেবদূতের দেওয়া শর্তের কথা। সে তার স্ত্রীকে সেসব বুঝিয়ে বলল। তারা ঘরে ঢুকল ভগ্ন হৃদয় নিয়ে। বর পেয়েছে তারা আর দ্বিগুণ সম্পদ পাচ্ছে প্রতিবেশীরা তা কোনোভাবেই তারা মেনে নিতে পারছিল না। কীভাবে প্রতিবেশীদের বঞ্চিত করা যায় তা নিয়ে ভাবতে লাগল। এবং একসময় লোকটি একটি উপায়ও বের করে ফেলল। স্ত্রীকে বলল, দেখবা আমি কী করতে পারি। শ্লেটপেনসিল হাতে নিয়ে লোকটি উচ্চারণ করল, আমাদের একটি চোখ অন্ধ হয়ে যাক। অমনি সঙ্গে সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর একটি করে চোখ অন্ধ হয়ে গেল আর তার প্রতিবেশী সবার দুটো চোখই অন্ধ হয়ে গেল। সেজন্য বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা।’ এই উপমহাদেশ ছাড়া আর কোথাও এ ধরনের প্রবাদ-প্রবচন আছে বলে জানা যায়নি। কারণ হয়ত আর কোনো জাতি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করে না।

মহামারীর অভিঘাত সরকার মোকাবেলা করতে সক্ষম হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বমন্দার শুরুতে সরকার সবক্ষেত্রেই কৃচ্ছসাধনের উদ্যোগ নিয়েছে। রিজার্ভের পরিমাণও সামান্য কমেছে। যদিও তাতে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী চক্রটি এমন প্রপাগান্ডা শুরু করেছে তাতে মনে হতে পারে বাংলাদেশ ডুবতে বসেছে। অথচ বাংলাদেশ ঋণখেলাপি হতে পারে, এমনটা ভাবছে না কানাডাভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট। বৈদেশিক ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট। এই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। তবে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে তালিকায় নাম রয়েছে পাকিস্তানের। সরকারি বন্ড, ৫ বছরের ডিফল্ট ক্রেডিট অদল-বদল, জিডিপিতে সুদের ব্যয়ের হার, জিডিপিতে সরকারি ঋণের হারের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা করা হয়েছে। এই তালিকায় স্থান পাওয়া ২৫টি দেশের র‌্যাংক করতে তারা ব্লুমবার্গের ডাটা ব্যবহার করেছে।

তালিকায় প্রথম দেশটি এল সালভাদর। সমপ্রতি এল সালভাদর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সতর্কতা উপেক্ষা করে বিটকয়েনকে সরকারি মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করে। পাশাপাশি দেশটি বিটকয়েন কিনতে থাকে। কিন্তু বিটকয়েনের হঠাৎ দরপতন দেশটির অর্থনীতিকে বিপর্যয়কর স্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। সামপ্রতিক সময়ে বিটকয়েনের দাম কমেছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। তালিকায় পরের দুটি দেশই আফ্রিকার। ঘানা ও তিউনিশিয়া। এর পরে রয়েছে নামিবিয়া, অ্যাঙ্গোলা, সেনেগাল, রুয়ান্ডা ও নাইজেরিয়া।

তালিকায় ৪ নম্বরে আছে পাকিস্তান। তালিকায় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা, মেঙিকো, মিসর ও তুরস্কের মতো মোটামুটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ইউক্রেন আছে তালিকার ৮ নম্বর স্থানে। দেশটির বন্ডের দাম এখন ডলারে ৩০ সেন্ট। অর্থাৎ ইউক্রেনের ইস্যু করা ১০০ ডলারের বন্ডের দাম এখন মাত্র ৩০ ডলার।

এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ড বা আইএমএফ সারা বিশ্বের মোট ৫০টি বড় অর্থনীতিকে নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল। এই ৫০-টি অর্থনীতির মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া থেকে মাত্র দুটি দেশ স্থান পেয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশ। ভারত বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি। অন্যদিকে বাংলাদেশ ৪১। পাকিস্তান যেমন আর্থিকভাবে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে, তেমনই অন্যদিকে, আর্থিক সমৃদ্ধির প্রশ্নে ক্রমশ এগিয়ে আসছে বাংলাদেশ। গত বছর এমন তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ছিল ৪২ নম্বরে। চলতি বছরে উঠে এসেছে ৪১তম স্থানে। মহামারীতে অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও বাংলাদেশ তা ধরে রাখতে পেরেছিল।

শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির কারণ হিসেবে বলা হয় সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত যেমন অপ্রয়োজনীয় কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া এবং তার জন্য অধিক পরিমাণ ঋণ নেওয়া। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করা অর্থাৎ ঋণখেলাপী হওয়া। এ ছাড়া কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় অর্গানিক পদ্ধতির ওপর নির্ভর করা এবং পরিবেশ নিয়ে বাড়াবাড়ি ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করা। জনগণও সরকারের এমন নীতি সহজভাবে নেয়নি। এসব কারণে শ্রীলঙ্কার কৃষি উৎপাদনে ধস নেমেছিল। বিক্ষোভ এমন চরম পর্যায়ে যাওয়ার জন্য কয়েক শ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সংশয়বাদীরা দেশটির সবুজনীতিকে দায়ী করছেন। শ্রীলঙ্কা গত বছরের এপ্রিল মাসে রাসায়নিক সারের আমদানি, কীটনাশক ও আগাছা রোধী ওষুধের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকে এগুলোকে বিক্ষোভের কারণ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশটিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে কোনো দেশই এভাবে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। থিঙ্কট্যাংক চ্যাথাম হাউসের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রোগ্রামের সহকারী ফেলো চারু লতা হগ বলেন, ‘এটি অপ্রীতিকর ও অদ্ভুত পদ্ধতি।’

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের শিক্ষক ড. থিরুনি কালেগামা বলেন, ‘রাজাপক্ষে রাতারাতি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ বিষয়ে কৃষকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। জৈবপদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য তাঁদের পর্যাপ্ত সময় বা রসদ সরবরাহের বিষয়টি নিয়েও ভাবা হয়নি।’ হুট করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে শস্যের ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়। খাদ্যের দাম বেড়ে যায়। প্রধান প্রধান খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়।

শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী অন্যতম কারণ দুটির একটিও বাংলাদেশে বিদ্যমান নয়। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে খেলাপি হয়নি। কৃষি উৎপাদনে কোনো ব্যঘাত ঘটেনি। মাছ, সবজি, ফল উৎপাদনে ক্রমাগত সামনে অগ্রসর হচ্ছে। ধান উৎপাদন চাহিদার কাছাকাছি। রিজার্ভ যা আছে তাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিলাসী ও খুুব বেশি প্রয়োজন নেই এমন পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করলে সমস্যা মোকাবেলা সহজ হয়ে যাবে। তারপরও সরকার শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি দেখে শিক্ষা নিতে পারে, সতর্ক হতে পারে।

তবে আমি ভাবছি সে দেশের জনগণের কথা। সে দেশে শিক্ষার হার প্রায় ৯৮ শতাংশ। তাছাড়া সে দেশের মানুষের দেশপ্রেম আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। এত অভাব, অরাজকতার পরও সেখানে সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটেনি। জ্বালাও-পোড়াও অন্তত আমাদের দেশের মতো হয়নি। সেদেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কার্য্যালয়ে ঢুকে পড়েছে। সেখানে অনেককিছুই করেছে কিন্তু দেশ বা জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেনি। বাংলাদেশ হলে রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত আগুন নিভিয়ে কূল পাওয়া যেত না। শুধু শেখ হাসিনার সরকারের নয় এ দেশের কিছু মানুষেরও দরকার শ্রীলঙ্কার জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া।

লেখক : কবি সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপার অপেরা মহাবিশ্বে কবিতার নাট্যমঞ্চ
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম