এরপর কি একটি বার্ন হাসপাতাল হবে?
সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ যারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা ‘আশঙ্কাজনক’ জানিয়ে তাদের ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। সোমবার ঢাকা থেকে বার্ন ইউনিটে দগ্ধ রোগীদের দেখতে আসেন তিনি। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এই চিকিৎসক। তবে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকলে রোগীদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকার হত না বলে নিজের মত প্রকাশ করেন তিনি।
এ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমদ জানান, ডিপোর অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে আহত ও দগ্ধদের মধ্যে যে ১০২ জন এখনও ভর্তি আছেন, তাদের ৪৩ জন আছেন বার্ন ইউনিটে।
তার আগে দগ্ধদের মধ্যে ১৬ জনকে ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। সামন্ত লাল জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই তিনি চিকিৎসার বিষয়টি দেখভাল করছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তিনি চট্টগ্রামে এসেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আহত ও দগ্ধদের ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান করতেই এখানে আসা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বার্ন রোগীর চিকিৎসায় যেন কোনো অবহেলা না হয়।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রাক্তন এই চিকিৎসক বেশ সুনামের সঙ্গে বার্ন ইউনিট পরিচালনা করেছিলেন। পরে তাঁর উৎসাহ ও প্রধানমন্ত্রীর গভীর আগ্রহ ও আন্তরিকতায় ঢাকায় একটি স্বতন্ত্র ও আধুনিক বার্ন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় ডা. সামন্ত লাল সে হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন। একইদিন সাংবাদিকদের চট্টগ্রামে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট করার পরিকল্পনা আছে জানিয়ে সামন্ত লাল বলেন, হাসপাতালের জন্য প্রস্তাবিত জায়গা ছিল চারটি, এখন জায়গা নির্ধারিত হয়েছে।
এই খবর জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন প্রধান ছাত্রাবাসের উত্তর পশ্চিম পাশের স্থান নির্বাচন হয়েছে। এটি হলে বেশি বার্ন হওয়া রোগীদের আর ঢাকায় পাঠাতে হবে না।’
এই খবরে কি আমরা নিশ্চিত হতে পারি এমন প্রয়োজনীয় একটি ইউনিট শেষ পর্যন্ত হতে যাচ্ছে? আমার সংশয়টি কেন সেটি বুঝতে হলে অতীতের একটি লেখার উদ্ধৃতি দিতে হবে।
২০১৭ সালে লিখেছিলাম- ‘২০১৪ সালে ১০০ শয্যার একটি বিশেষায়িত বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সে প্রস্তাবনায় ১০ শয্যার আইসিইউ ছাড়াও তিনটি অস্ত্রোপচার কক্ষ এবং অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়। সে অনুযায়ী ২০১৬ সালে এই প্রকল্পের অর্থায়নে এগিয়ে আসে চীন সরকার। বার্ন ইউনিট গড়ে তুলতে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনাও করে চীন। কিন্তু শেষ পর্যন্তচমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বার্ন ইউনিটের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা দিতে না পারায় অর্থায়ন থেকে সরে আসে চীন।
অথচ চট্টগ্রামে এখন শুধু ১০০ শয্যার বার্ন ইউনিটই নয়, পূর্ণাঙ্গ একটি বার্ন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। বর্তমানে চমেক হাসপাতালে যে বার্ন ইউনিটটি রয়েছে তার সক্ষমতা মাত্র ২৬ শয্যার। তবে প্রতিদিন এখানে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী ভর্তি থাকে। এই ইউনিটে চিকিৎসক সংখ্যা মাত্র ৫ জন। ২৬ শয্যার এই ইউনিটে তিন থেকে চারগুণ রোগীর সংকুলান করা খুব কঠিন। অত্যন্তঝুঁকি নিয়ে রোগীদের ফ্লোরে, বারান্দায় এমনকি সিঁড়ির পাশে স্থান দিতে হয়। আর যারা চিকিৎসা ও সেবা দান করবেন তাদের পক্ষে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবাদান কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। এই ইউনিটে আইসিইউ সংকট থাকায় গুরুতর রোগীদের বাধ্য হয়ে ঢাকায় পাঠাতে হয়।
চীন এই প্রকল্প থেকে অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জায়গার সংস্থান করতে পারেনি। বিষয়টি অদ্ভুত শোনালো কারণ এই হাসপাতাল চত্বরেই চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে সময় চট্টগ্রামের সচেতন মহলের দাবির মুখে শেষ পর্যন্তকর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্তপরিবর্তন করে ফৌজদারহাটের বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য যদি জায়গার সংস্থান করতে পারে কর্তৃপক্ষ তাহলে একটি বার্ন ইউনিট করার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানের সংকুলান কেন করা যাবে না তা প্রশ্নসাপেক্ষ বটে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশের বার্ন ইউনিট সমপ্রসারণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চীনের চাহিদা অনুযায়ী জায়গা দিতে পারছে না। এজন্য তারা বিনিয়োগ না করে ফিরে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে একটি বার্ন ইউনিট গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। চীনা প্রতিনিধিদল ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম সফর করে চমেক হাসপাতালের ২০ কাঠার একটি জায়গা পছন্দ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জায়গাটি বার্ন ইউনিটের জন্য বরাদ্দ দিতেও রাজী হয়। সেই অনুযায়ী কাজ অনেকদূর এগিয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই জায়গাতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) রেডিওলজি ইউনিট গড়ে তুলবে। তৎকালীন হাসপাতাল প্রশাসন জায়গাটি ২০১৪ সালে জাইকাকে বরাদ্দ দেয় বলে জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’
জানা গেছে, এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, জাইকার প্রকল্প সমন্বয়ক ও চীনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি।
এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। জায়গার অভাবে চট্টগ্রামে বার্ন ইউনিট গড়া সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একই জায়গা চীন ও জাইকাকে বরাদ্দ দেওয়ায় মূলত জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণে হয়েছে বলে গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন চমেক হাসপাতালের বর্তমান উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম।
ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, ‘চীনা প্রতিনিধিদল জানিয়েছে, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট নির্মাণে জায়গা নির্ধারণ হওয়ায় তাদের সরকার অবকাঠামোর নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। ইতোমধ্যে ভবনের নকশা তৈরির কাজ শেষ। নতুন কোনো জায়গায় বার্ন ইউনিট নির্মাণ করতে চাইলে আবারও অনুমোদন নিতে কয়েক বছর সময় লাগবে।’
অন্যদিকে রেডিওলজি ও ইমেজিং ইউনিট প্রকল্পের ডিপিপি ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদন হয়েছে। ফলে জায়গা পরিবর্তন করতে হলে আবারও ডিপিপি তৈরি নতুনভাবে অনুমোদন নিতে হবে। এরই মধ্যে এ কাজটি করতে পাঁচ বছর সময় লেগেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিকল্প জায়গা দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও দুই পক্ষ তাতে রাজি হয়নি। ইতোমধ্যে জাইকা রেডিওলজি ইউনিটের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ভৌত কাজ শুরু করলেও অন্যদিকে চীন বিনিয়োগ না করে ফিরে যাচ্ছে।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, প্রশাসনিক ভবনের পাশে খালি জায়গার পরিমাণ প্রায় ২০ কাঠা। ইতোমধ্যে কিছু অংশ জাইকাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে এখন প্রায় ১২ কাঠা জায়গা খালি রয়েছে। আমরা চীনকে সেই জায়গায় ১০ তলা ভবন করে বার্ন ইউনিট গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সেই প্রস্তাবে তারা রাজী হয়নি। চীনের অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।’
সে একই কলামে লিখেছিলাম, ‘একই পরিণতি হয়েছিল বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের বেলায়ও। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করলে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে সরকারি বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল গড়ে তুলবেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি প্রতিশ্রুতি পূরণের নির্দেশ দেন। সে নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকায় রাজউকের দেওয়া ১০ একর জায়গায় পূর্বাচলে গড়ে উঠেছে এক হাজার শয্যার একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম শিশু হাসপাতাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সে লক্ষ্যে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সদ্য প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম চট্টগ্রামে এসে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালককে শিশু হাসপাতালের জন্য স্থান নির্বাচনের দায়িত্ব দেন। সে সঙ্গে প্রাথমিকভাবে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। আজ পর্যন্তশিশু হাসপাতালে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যায়নি বলে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে একটি বিশেষাযয়িত হাসপাতাল থেকে বঞ্চিত হলো চট্টগ্রামবাসী।
প্রয়াত জাসদনেতা, চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসনের সাবেক সাংসদ মাঈনুদ্দিন খান বাদল অনেক চেষ্টা-তদবির করেছিলেন চট্টগ্রামে একটি হৃদরোগ হাসপাতাল গড়ে তোলার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর তিন বা সাড়ে তিন বছর পর তিনি হৃদরোগের চিকিৎসা নিতে ভারতের বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার দেবি শেঠির হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর সার্জারির সময় তিনি চিকিৎসকদের সঙ্গে হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেন এবং তার নিজ জেলায় একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পরে এ নিয়ে ডাক্তার দেবি শেঠির সঙ্গে সাংসদ বাদলের কথা হয় এবং ডাক্তার দেবি শেঠি চট্টগ্রামে একটি হৃদরোগ হাসপাতাল গড়ে তুলতে তাঁর সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ডাক্তার দেবি শেঠির আশ্বাস পেয়ে মাঈনুদ্দিন খান বাদল বন্দরের জায়গায় এমন একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন এবং বন্দরের বোর্ডসভায় তাঁর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভাগ্য বাদলের হাসপাতাল করার প্রস্তাবের বিরোধিতাকারী সবাই ছিলেন চট্টগ্রামেরই সন্তান। তাদের আপত্তির মুখে এবং চট্টগ্রামের নেতাদের অসহযোগিতার কারণে গরিবদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়।’
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল, এই পাঁচ বছরে একটি বার্ন ইউনিট গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, গড়ে তোলার উদ্যোগও নেওয়া হয়নি বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের। এই ব্যর্থতা কার?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। তাঁর কাছে পরিকল্পনা নিয়ে গেলেই তিনি পাশ করে দেন। চট্টগ্রামে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার পর তিনি ডা. সামন্ত লালকে পাঠিয়েছেন চট্টগ্রামে। তিনি বলে দিয়েছেন চিকিৎসায় যেন কোনো প্রকার গাফিলতি না হয়। তিনি হাসপাতাল করে দিতে চান। তিনি নিজে থেকেই সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু স্থান নির্বাচনের জটিলতায় শিশু হাসপাতাল হয়নি, হয়নি আলাদা বার্ন ইউনিট। একজন প্রধানমন্ত্রীকে কি হাসপাতালের জায়গাটাও নির্বাচন করে দিতে হবে? দায়িত্বশীলদের কাজ কী তবে?
লেখক : কবি-সাংবাদিক