কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৩ মার্চ, ২০২২ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

বইমেলা এবং অকল্যাণের অপশক্তিরা

যেকোনো ধর্মের মূল বাণীটি হলো সত্য বলা। কখনো মিথ্যা কথা না বলা। লক্ষ লক্ষ বছরের মানবেতিহাসে ধর্মের আবির্ভাব হাজার পাঁচেক বছর আগে। ধর্মেরও আগে সমাজের অগ্রসর চিন্তার মানুষগুলো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে, মানুষে মানুষে বিশ্বাস, আস্থা ও নির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরি করতে না পারলে সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, হানাহানি বাড়বে এবং তার ফলে মানবসভ্যতাই লোপ পাবে। তাই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত আর মিথ্যাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
ইংরেজিতে বলা হয় আরও চমৎকারভাবে, ‘স্পিক ট্রুথ অর্থাৎ সত্য বলো। অন্যদিকে বলা হয়েছে, ‘ডোন্ট টেল এ লাই’ অর্থাৎ একটি মিথ্যাও বলবে না। কী চমৎকার তাই না। আদেশের মতো বলা হচ্ছে সত্য বলো, এটাই যেন স্বতঃসিদ্ধ। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, একটি মিথ্যাও নয় কারণ, একটি মিথ্যা অজস্র মিথ্যার জন্ম দেয়।
চট্টগ্রামে বইমেলা শুরু হয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে। কিন্তু অত্যন্ত বিস্ময়, ক্ষোভ আর হতাশার সঙ্গে লক্ষ করলাম মেলা শুরুর কয়েকদিন আগে থেকে একটি চিহ্নিত ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী গোষ্ঠী মেলার বিপক্ষে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা একটি সনাতন ধর্মীয় সংগঠনের নাম উল্লেখ করে এবং অন্য কোথাও করা একটি স্টলের ছবি যুক্ত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে বইমেলায় এমন সংগঠনকে স্টল করার অনুমতি দেওয়া হলেও ইসলামী বই বিক্রি করতে দেওয়া হচ্ছে না। সে সঙ্গে তারা বইমেলা বয়কট করার ডাকও দেয়। উগ্রবাদীদের এমন প্রচারে কেউ কেউ ফেসবুকের মাধ্যমে মেলা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেয়। কয়েকদিন আগে ফটিকছড়ির ভুজপুর থেকে পুলিশ এমন এক হুমকিদাতাকে গ্রেফতারও করেছে।
অথচ বাস্তবতা একেবারেই উল্টো। মেলায় অন্তত দশটির মতো প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠানের স্টল আছে যারা বিভিন্ন ধরনের ইসলামধর্মীয় বই প্রকাশ ও বিপণন করে। আর যে সংগঠনের নাম দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে তারা কোনো স্টল দেয়নি। স্টলের জন্য আবেদনও করেনি। কঠিন বাস্তবতাটি হচ্ছে দেশে অনেক ধর্মের মানুষ বাস করলেও মেলায় শুধু ইসলামী বইই বিক্রি হচ্ছে। অন্যকোনো ধর্মীয় বই বা প্রকাশনা এই কয়েকদিনের মধ্যে দেখা যায়নি।
আমার প্রশ্ন হলো যারা এত বড় মিথ্যা প্রচার করল তারা কোনো যুক্তিতে নিজেদের ধার্মিক বলে পরিচয় দেয় এবং অন্যরাও কীভাবে মিথ্যুক, ঘৃণা সৃষ্টিকারী দাঙ্গাবাজদের কথা বিশ্বাস করে। শুধু বিশ্বাসই নয়, এমন কথায় মারদাঙ্গাও হয়ে ওঠে।
মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন ও সহযোগী সংস্থা চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক সংস্থা যখন জনসমক্ষে প্রকৃত সত্যটি তুলে ধরে তখন অপপ্রচারকারীদের সুর পাল্টে যায়। তারা তখন বলতে থাকে, সেসব (ইসলামি প্রকাশনা) তো সুফিবাদি বই ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা দরকার তা হলো, শুধু বাংলাদেশ নয় এই উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ও প্রচার দুই-ই ঘটেছে সুফি-দরবেশদের মাধ্যমে, যেটি ইসলামের প্রকৃত রূপ। যে কারণে শত শত বছর ধরে এই অঞ্চল (উপমহাদেশ) হিন্দুপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও এখানে ইসলাম প্রচার সহজ হয়েছে এবং সুফি-দরবেশরা ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে সকলের কাছে সম্মানীয়, গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে মওদুদি ও সালাফি মতবাদই উগ্রতা ও ঘৃণা ছড়িয়ে ইসলামের সর্বজনীনতাকে ক্ষুণ্ন করেছে।
এদেরই অনুসারীরা তাদের চিরাচরিত চরিত্র অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে বইমেলা বন্ধ করে দেওয়ার লক্ষ নিয়ে মাঠে নেমেছে। যে কায়দায় ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে সারাদেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। সরকারি অফিসে লুটপাট চালিয়ে আগুন দিয়েছিল, পুলিশ হত্যা করেছিল এবং দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদহানি করেছিল। এরা বিশ্বের সকল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অর্থাৎ সকল শোভন, সুন্দর, সুষমা, মানবিকতার বিরোধী। এদের কাছে হত্যাই উৎসব, ঘৃণাই এদের আদর্শ।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বইমেলা হয়। তাদের বিশাল বিশাল আয়োজনগুলো সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক মানের। লেখক ও পাঠকদের বৈশ্বিক পরিচয়ের সেতুবন্ধ রচনার উদ্দেশ্যে বইমেলাগুলো হয়ে থাকে। লেখার অবয়ব বৃদ্ধি পাবে বলে বইমেলার নাম উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু এইসব বইমেলার সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য স্থানে আয়োজিত একুশের বইমেলার চেতনা ও আবেগগত ভিন্নতা আছে। বাংলাদেশের একুশের বইমেলা স্রেফ একটি বইমেলা নয়, এটি বাঙালির প্রাণের মেলা, চেতনার মেলা, আবেগের মেলা এবং সর্বতোভাবে বাঙালির আত্মানুসন্ধানের মেলা। এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির শোক এবং সাফল্যের অনন্য ও যুগপৎ গৌরবগাঁথা। অর্থাৎ একদিকে রক্তঝরা একুশের শোকাবহ স্মৃতি এবং অন্যদিকে তার ফলে জেগে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতালাভের গৌরব।
যারা হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করে এবং বাংলা ভাষায় কথা বলে।এই অঞ্চল বলতে কি আজকের বাংলাদেশ? রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় বরেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজের মিলও ছিল না। তবু এর মধ্যে এক ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। আমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি।’
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ বলেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতিতে যেসব অভিন্ন উপাদান আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলা ভাষা। সমাজের ভিন্নতা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা সব বাঙালির ভাষা।’
সময়ের বিবর্তনে মানচিত্র পরিবর্তিত হয়। আজকের বাংলাদেশ একসময়ের পূর্ববঙ্গ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এই নামেও পরিচিত ছিল না। এই বিশাল অঞ্চল একসঙ্গেও ছিল না। বিভিন্ন রাজা বা শাসকের সময়ে একেক অঞ্চল একেক নামে পরিচিত ছিল যেমন, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, বরেন্দ্রী, গৌড়, রাঢ়, তাম্রলিপ্তি, সুহ্ম এবং বঙ্গ। একসময়ে এসে পুরোটা জোড়া লেগে হয়ে উঠেছে বঙ্গ, বাঙ্গাল এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঙালিদের অসাধারণ ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও দেশভাগের সময় বাংলা ও পাঞ্জাবের ওপর নেমে আসে খড়গহস্ত। ভাগ করে দেওয়া হয় দুটো প্রদেশকে। পূর্ববাংলাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তান নামক এক আজগুবি ও চরম সামপ্রদায়িক রাষ্ট্রের পেটের মধ্যে। আর সমস্যাটি শুরু হয় তখন থেকেই।
এই অন্যায্য সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ছিল বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন। ভাষা যেহেতু সংস্কৃতির বাহন সেহেতু এই আন্দোলনকে খুব সহজেই আমরা সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় রক্ষার আন্দোলন বলেও অভিহিত করতে পারি। এই আন্দোলন এবং এর সাফল্য বাঙালির জনমানসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।এরই অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে বাঙালি স্বাধিকার ও পরে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল। এই আন্দোলনকে বাঙালির রেনেসাঁস বলেও অভিহিত করতে পারি। এখনো জাতির কোনো সংকটে আমরা উদ্দীপ্ত হই একুশের চেতনা থেকেই। সে চেতনার ফল ঢাকায় বাংলা একাডেমি চত্বরের বইমেলা যা স্বাধীনতার পরপর শুরু হয়ে এখনো দিনদিন বর্ধিতই হচ্ছে। এখন এই মেলা বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে।
১৯৮৯ সালে চট্টল ইয়থ কয়ার মুসলিম হলের সামনে প্রথমবারের মতো ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী বইমেলার আয়োজন করে। সে কমিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন জহীর কাজী, মহাসচিব মফিজুর রহমান এবং সমন্বয়কারী ছিলেন অরুণ বণিক। এই বইমেলা সংগঠনে ড. অনুপম সেন, আবদুল্লাহ আল হারুন ও সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। কয়েকবছরেই মেলাটি বেশ জমে উঠেছিল। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় বড় পরিসরে বইমেলা করার উদ্যোগ নেন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন লালদীঘির মাঠ থেকে শুরু করে মিউনিসিপ্যাল স্কুলের মাঠ হয়ে মুসলিম হল বা শহিদমিনার চত্বর পর্যন্ত মেলার আয়তন থাকবে। কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নানা জটিলতার কারণে প্রথম বছরই মেলাটি ফ্লপ করে। এরপর মুসলিম হলের সামনে বইমেলার আয়োজনটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে তার পরের বছর ডিসি হিলে এই মেলার আয়োজন হয় তৎকালীন জোট সরকারের আমলাদের প্রবল অসহযোগিতা সত্ত্বেও। এই মেলা পরে একুশমেলা পরিষদের ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়েছে দীর্ঘদিন। এর পাশাপাশি সিটি করপোরেশন আয়োজিত একুশের বইমেলাও চলেছে দীর্ঘদিন ধরে।
শূন্য দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম একাডেমির আয়োজনে শুরু হয় স্বাধীনতার বইমেলা, যেখানে শুধু চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ও চট্টগ্রামের লেখকদের বই-ই স্থান পেতো। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোগে পরপর দু বছর বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ডিসি হিল প্রাঙ্গণে। এভাবে বেশ কয়েকটি মেলার আয়োজন হলেও দেখা গেল কোনো মেলাই প্রকৃত ও সফল বইমেলা হয়ে উঠছে না। তাই একটি সময়ে এসে চট্টগ্রামের লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীরা একটি সম্মিলিত মেলা আয়োজনের তাগিদ বোধ করে। এবং এবিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও হতে থাকে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একসময় এ বিষয়ে সহযোগিতার অনুরোধ করা হলে তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরউদ্দীন আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন এবং সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমান বইমেলার যাত্রা শুরু হয়। সে ধারাবাহিকতা বর্তমান মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীও বজায় রাখেন। বইমেলার আয়োজন করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও মহিউদ্দিন চৌধুরী, মনজুর আলম, আ জ ম নাছিরউদ্দীন এবং রেজাউল করিম চৌধুরী শুধু ভালোবাসা ও আন্তরিকতার টানে বইমেলা সংগঠিত করে চট্টগ্রামবাসীকে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন।
অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবার বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।এ মেলাকে কোনো মৌলবাদী, সামপ্রদায়িক গোষ্ঠীর হতে দেওয়া যাবে না। তাদের আস্ফালন ও হুমকি-ধমকিতে বিব্রত হওয়া যাবে না। বাংলাদেশ যেমন সব ধর্ম, সব মতের মানুষের তেমনি একুশের বইমেলাও সব ধর্ম-মতের মানুষের, সব বাঙালির প্রাণের মেলা। কোনো উগ্রবাদীর নয়। এই বইমেলা চিরজীবী হোক, শাণিত ও আরও বিস্তৃত হোক সে প্রত্যাশা করি।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণে শ্রদ্ধায় ফয়েজ আহমদ চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধইউক্রেনে হামলার নিন্দায় জাতিসংঘে প্রস্তাব ভোট দেয়নি বাংলাদেশসহ ৩৫ দেশ