মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটা সমাধান আর নয়
রাজপুত্র সিদ্ধার্থ রাজপাঠ, সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বিশ্বস্ত ও বন্ধু সহিসকে সঙ্গে নিয়েছিলেন এবং অনোমা নদীর পাড়ে এসে সহিসকে বিদায় করে দিলেন। এরপর তিনি ত্যাগ করলেন রাজকীয় পোশাক, মাথা মুণ্ডন করে চুলগুলো নিক্ষেপ করলেন ঊর্ধ্বমুখে। সে থেকে তাঁর মতানুসারীরা কল্যাণ ও সর্বমঙ্গলের কামনায় ফানুস উড়িয়ে সব অমঙ্গলকে আকাশে লীন করে দেওয়ার আচারটি করে থাকে। এর বাইরে আরও বিশ্বাস ও মিথ আছে।
প্রবারণা উৎসবসহ বৌদ্ধরা তাদের অন্যান্য উৎসবে ফানুস ওড়ায় যার মাধ্যমে জগতের সকল অমঙ্গল, অসত্য, অসুন্দরকে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে মাটির পৃথিবীকে শান্তিময়, সুখকর করার সাধনা করে।
আমরা ছোটবেলা থেকে প্রবারণা ও বুদ্ধপূর্ণিমায় ফানুস ওড়ানো দেখছি। আমার গ্রামের বাড়ি রাউজানের দক্ষিণ গহিরায়। আমাদের গ্রামের পশ্চিমে একটি বড়ুয়াপাড়া আছে, পূর্বে আছে বিনাজুরি গ্রাম যেখানে অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর বসবাস। সে সময় কাছ থেকে ফানুস কিংবা ফানুস ওড়ানো দেখতে না পেলেও আকাশভরা ফানুস দেখে ছোটবেলায় আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটতো না। কী করে আকাশে ফানুস ওড়ে তা দেখেছি অনেক পড়ে শহরে এসে নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দিরে।
বছর বিশেক ধরে আমরা নিজেরাও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব ও আয়োজনে ফানুস ওড়ানোর ব্যবস্থা করেছি। সে সময় অনেক খোঁজাখুঁজি করে ফানুস বানাতে ও ওড়াতে পারেন এমন অভিজ্ঞ মানুষ জোগাড় করেছি। কয়েকবছর ধরে দেখছি ফানুস বানাতে বা ওড়াতে লোক খোঁজাখুঁজির দরকার পড়ে না, বাজারে এখন রেডিমেড ফানুস পাওয়া যায়। কিনে এনে উড়িয়ে দিতে খুব ঝামেলা পোহাতে হয় না। দিনে দিনে তাই ফানুস ওড়ানো আমাদের সংস্কৃতির অংশই হয়ে উঠল।
সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠা অবশ্যই ইতিবাচক ঘটনা। এমনকি এই ফানুস ওড়ানো যদি কখনো বিশ্বইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর মতো কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি অর্জন করে তাহলেও তা আনন্দ ও গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। যদিও জানা যায় ফানুস শুধু এই উপমহাদেশে নয় খৃস্টপূর্বে আরব ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে, যেমন মিশরে ফারাওদের শাসনামলে ফানুস জ্বালানো বা ওড়ানো হতো। মোট কথা ফানুস ওড়ানো ইতিহাস খুবই পুরনো এবং নানান দেশে এর প্রচলন ছিল।
বলছিলাম বাংলাদেশে কোনো উৎসবে ফানুস ওড়ানোর ইতিহাস নতুন হলেও দ্রুত তা জনপ্রিয় একটি অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে উৎসবের। ফানুস ওড়ানো উৎসবে নয়া মাত্রা যোগ করলেও তা নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি এতদিন। কিন্তু গত ৩১ ডিসেম্বর বা থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফানুস ওড়ানোর কারণে কিছু কিছু স্থানে আগুন লাগাকে কেন্দ্র করে ফানুস ওড়ানো নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পাঠকদের সুবিধার্থে এ নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট তুলে ধরছি। একাধিক পত্রিকা লিখেছে, ‘উদযাপন শুরুর কিছু সময়ের মধ্যে ঘটে যায় অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। একসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর হট লাইন নম্বরগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে সারা দেশ থেকে প্রায় ২০০টি অগ্নিকাণ্ডের খবর আসে ফায়ার সার্ভিস ও ৯৯৯-এর কন্ট্রোল রুমে।’
ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিক তদন্ত করে পত্রিকাকে জানিয়েছে, আগুনের বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে ফানুসের কারণে। তবে কয়েকটি আতশবাজির কারণেও ঘটেছে । এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডিএডি আব্দুল জলিল বলেন, গতকালের মতো এত ফানুস আগে কখনো ওড়ানো হয়নি। একসঙ্গে অনেক বেশি ফানুস ওড়ানোর কারণে গতকাল রাতে এমন ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন জায়গায় দাহ্য বস্তু খোলামেলা থাকে আর এসব ফানুস গিয়ে সেগুলোতে পড়ার কারণে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। পত্রিকা বলছে, ফায়ার সার্ভিস ফানুস ওড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে। এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত না হলেও লিখতে হচ্ছে এ কারণে যে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। সপ্তাহখানেক আগে কক্সবাজারে এক নারী ধর্ষণের ঘটনা দেশে তোলপাড় তুলেছিল। নারীর অভিযোগ ছিল ধর্ষকরা তাঁকে বিচের লাবনী পয়েন্ট থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের করিৎকর্মা সরকারি কর্মকর্তাগণ নারীদের নিরাপত্তা বিধানে সৈকতের কিছু জায়গা চিহ্নিত করে নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা জোন করে ফেলেছিলেন যদিও দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে মাত্র দশ ঘণ্টার ব্যবধানে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়।
এইসব করিৎকর্মাদের কথা ভেবে শঙ্কিত না হয়ে পারছি না যে, আসছে মাঘি পূর্ণিমা বা যেকোনো অনুষ্ঠানে ফানুস ওড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়। কারণ এদের কাছে মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলাই উত্তম চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত। এমন ঘটনা যদি ঘটে তাহলে সেটিও কক্সবাজারের ঘটনাটির মতোই হাস্যকর ও হটকারি সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। মনে রাখতে হবে বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে জড়িত ফানুস ওড়ানোর ইতিহাস। এটার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা মানে তাদের ধর্মীয় আচার পালনে হস্তক্ষেপ করা যা বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হবে।
শত শত বছর ধরে বৌদ্ধদের ধর্মীয় উৎসবে ফানুস ওড়ানো হয়েছে কোনো সমস্যা হয়নি। একসময় গ্রামে এমনকি শহরেও অধিকাংশ বাড়িঘর ছিল শন ও বাশেঁর অর্থাৎ কাঁচাঘর। সে সময়েও আগুন লাগার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই, দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া। আজ আগুন লাগার কারণ হিসেবে যে ফানুসের কথা বলা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তার জন্য ফানুস নয় যারা ওড়াচ্ছে তাদের অদক্ষতা ও যেনতেনভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা ফানুস দায়ী। বৌদ্ধরা ফানুস ওড়ায় পবিত্র ও পুণ্য সাধনের লক্ষে। তারা ফানুসগুলো তৈরিও করে অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে। এ কাজে তাদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি আছে। তারা বাণিজ্যিক লক্ষে এসব বানায় না। আজকাল বাজারে বিক্রি হওয়া রেডিমেড ফানুস এবং আনাড়ি হাতে ওড়ানোর ফলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। নিয়ন্ত্রণ করতে হলে খোলাবাজারে ফানুস বিক্রি এবং অদক্ষ লোক বা যেকোনো স্থলে ও আয়োজনে ফানুস ওড়ানো নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। একেবারে বিধিনিষেধ আরোপ করা যাবে না।
বাংলাদেশের অনেকে আছেন যারা অন্য ধর্মের খুঁত বা দুর্বলতা ধরতে উন্মুখ হয়ে থাকেন। কোনো উসিলায় যদি তাদের বাধাগ্রস্ত করা যায়, তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে, এ দেশে থাকতে হলে সংখ্যাগুরুদের মেজাজ-মর্জি মেনে থাকতে হবে তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন না। তারা এমন ইস্যু পেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব করে তোলেন। মনে রাখতে হবে দেশটা সবার। সব ধর্মের মানুষের। লেখক : কবি-সাংবাদিক