ছাবের আহমদ মাস্টার। চট্টগ্রামের এক প্রান্তিক জনপদের জ্যোতির্ময় পুণ্যাত্মা। যিনি কর্মে, জীবনাচারে, ভাবনায়, চেতনায় পারিবারিক-সামাজিক-পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলে একজন পরিশুদ্ধ ও পরিশ্রুত মহাপ্রাণ। আজীবন শিক্ষকতায় ব্রতী এই গ্রামীণ বুদ্ধিজীবী তাঁর ব্যক্তিক সত্তা ব্যষ্টিক ব্যাপ্তিতে প্রসারিত করে দিয়েছিলেন এক পশ্চাপদ অঞ্চল।
বাঁশখালীর সমুদ্র উপকূলবর্তী বাহারচরা ইউনিয়নের রত্নপুর গ্রামে ১৯১২ সালে ছাবের আহমদ মাস্টার জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৮ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রায় শতাব্দীর সমান বয়সী কর্মমুখর জীবনের সর্বাঙ্গীন চালচিত্র মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান গ্রথিত ‘কালোত্তীর্ণ পুরুষ: ছাবের আহমদ মাস্টার’ শীর্ষক স্মারকগ্রন্থ। এ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে এই কীর্তিমান পুরুষের জীবনের আদ্যোপান্ত। বলা যায় এই পুস্তক ছাবের আহমদ মাস্টারের সারাজীবন। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, কর্মজীবন, সংসার, বৃত্তি, মানবিকতা, সমাজকর্ম – সর্বোপরি জীবন দর্শন বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর উত্তর প্রজন্ম, প্রতিবেশী, সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিত্ব। লেখক সূচিতে রয়েছেন – অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ, মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান, আয়েশা আকতার, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল কাদের , ডা. ফররুখ আহমদ চৌধুরী, ডা. আতাউর রহমান শোয়েব, মো. আবুল কালাম আজাদ, মৌ. মোজাহেরুল আলম চৌধুরী, হামিদুর রহমান, মৌ. আবদুচ ছালাম আনোয়ারী, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান, ওয়াফা ফিরোজা বেগম, শ্রী রনজিৎ চক্রবর্তী, এস এম শফি, মো. খুরশীল আলম চৌধুরী, এডভোকেট এ. কে. এম ফজলুল হক, সুব্রত কুমার দে, আনোয়ারুল ইসলাম, খুরশীদ জাহান, মাস্টার (কবি) আবদুল মান্নান চৌধুরী, আমির হোসেন চৌধুরী, মৌলানা মনজুর আহমদ নুরী, মাস্টার মনজুর আলম, দিলরুবা খানম, হোছনে আরা বেগম, শওকত আরা বেগম, খাতেমন আরা বেগম, মৌ. আবুল মনছুর মোহাম্মদ ইছহাক, কামরুন্নেছা, মুহাম্মদ মসিউর রহমান, হালিমা রহমান, মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, তানভিরুল ইসলাম নাহিদ, মুহাম্মদ হাছান, ওবাইদুর রহমান (শহীদ), মোহাম্মদ আকবর হোছাইন, ফয়জুর রহমান, মুবিদুর রহমান (সুজাত), মো. কামরুল হোসাইন, দুরদানা রহমান, মফিজুল আলম, আদিবুর রহমান, ফজলুল হক সায়েম, আমির হোসেন চৌধুরী ও সিরাজুল মুনিরা।
এ ছাড়া ছাবের আহমদ মাস্টারের হাতে লেখা কয়েকটি চিঠি ও আলোকচিত্র সংযোজিত হয়েছে।
গ্রন্থের মুখবন্ধ রচনা করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ। তিনি রেখাচিত্রের মতো কয়েকটি আঁচড়ে এই কীর্তিমান ব্যক্তিত্বের প্রাণসত্তা পরিস্ফুট করেছেন। তাঁর একটি বিশেষ মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন – ‘সাধারণের জ্ঞান যেখানে ধর্মশিক্ষা নির্ভর, সেক্ষেত্রে জ্ঞানীদের সাধারণ আচরণে ধর্মের মূল বিষয় প্রতিফলিত হয়ে থাকে’। এই জীবনদর্শন বিশেষভাবে তাৎপর্যবাহী ও উল্লেখ্য এ কারণে যে, ছাবের আহমদ মাস্টার ছিলেন আপাদমস্তক একজন সাত্ত্বিক ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি। কী বেশভূষা, কী চাল-চলন, লেন-দেন, দান-দক্ষিণা সব কিছুতেই তিনি ছিলেন বলা যায় একজন সন্ত পুরুষ। সমাজ জীবনের গড়পরতা আর দশজন মানুষের চেয়ে আলাদা। তাঁর কাছে ব্যক্তিজীবন এবং ধর্মজীবন ছিল সমার্থক। পক্ষান্তরে জনহিতৈষণা বা হুক্কুল ইবাদ (সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য) একজন প্রকৃত কামেল মানুষের অন্বিষ্ট। তাই ৮০ বছর বয়সে পুত্রকে লেখা চিঠিতে তাঁর মানস-সত্য তথা কল্যাণব্রতের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত। তিনি লিখেছেন – ‘বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আমার স্বপ্ন, এই স্বপ্নের সুন্দর ও সফল বাস্তবায়ন এবং তার অগ্রগতি আমার মনে আনন্দ ও শরীরে শক্তি যোগায়’। কী এক অলিখিত দায়বদ্ধতায় তাই এই কর্মযোগী শিক্ষাব্রতী এলাকায় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিলেন পুত্রের আনুকূল্যে। নিজের গ্রামে ৬০ বছর অবৈতনিক পোস্টমাস্টারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আজ থেকে ৭০ বছর আগে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সমবায় সমিতি।
শিশু বয়সে পিতৃহীন ছাবের আহমদ মাস্টার স্বীয় প্রচেষ্টায় নিজেকে স্থাপন করেছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। তাঁকে বলা যায় একজন ‘সেল্ফমেড ম্যান’। অনমনীয় প্রাণশক্তির অধিকারী এই বিদ্যোৎসাহী ৫৩ বছর বয়সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এই প্রাণশক্তি ব্যতিক্রম ও দুর্লভ।
তাঁর সমস্ত জীবনবীক্ষা ও দর্শনের মৌল উপাদান হলো মানুষ। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ – এই অমোঘ বাণী বুকে ধারণ ও লালন করেই তাঁর জীবন চর্চা। তাই তো তিনি অকপটেই উচ্চারণ করেছেন – ‘ওখানে যা চাষ করি তা মানুষের খাওয়ার জন্য করি, ওখান থেকে আর্থিকভাবে উপকৃত হওয়ার চিন্তা আমি কোনদিন করি নাই’।
এই মহাপ্রাণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে তাঁর সুযোগ্য পুত্র মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন। তিনি যেমন পিতৃদায় ও কর্তব্য সম্পাদন করেছেন, বৃহত্তর পরিসরে এই ‘মানুষের মতো মানুষ’টির পরিচয় তুলে ধরে সকলের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। [‘কালোত্তীর্ণ পুরুষ : ছাবের আহমদ মাস্টার’। সম্পাদনা: মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান, প্রচ্ছদ: দীপক দত্ত, প্রথম মুদ্রণ: ২০০৮ সাল, ২য় মুদ্রণ: ২০২১ সাল, মূল্য: ৩০০ টাকা।]
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, সমালোচক।