কবিয়াল ফণী বড়ুয়া চিরস্মরণীয় এক নাম। দেশীয় লোকজ সাহিত্য সংস্কৃতির একজন বিরল বহুমাত্রিক প্রতিভাধর কবি। তিনি ছিলেন নিখিল ভারত উপমহাদেশের কিংবদন্তি কবিয়াল। গানের মানুষ, প্রাণের মানুষ।
উনিশ শতক থেকে আশি দশক পর্যন্ত ছিল কবিগানের স্বর্ণযুগ। প্রায় ৭০ বছর ধরে ফণী বডুয়া উপমহাদেশে অবিরাম কবিগান গেয়েছেন। তার অনবদ্য সৃষ্টি রচনা শৈলীগুলো এদেশের গণমানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। ইতিহাস ঋদ্ধতায় কবিগানকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। ফণী বডুয়া গভীর দেশপ্রেম, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রেরণার প্রিয় দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি কবিগানকে নিছক আনন্দ বিনোদন হিসেবে নেয়নি। বরঞ্চ তাঁর রচিত গানের অপরূপ সুর ও ছন্দভরা অন্ত্যমিল ছিল। তাঁর এ কবি গানের প্রতিভার বিকাশ ঘটে পরম কল্যাণ মিত্র গুরু কবিয়াল রমেশ শীলের হাত ধরে। তিরিশের দশকের শুরুতেই গুরু শিষ্যের মধ্যে এই কবি গানের লড়াই শুরু হয়। বোয়ালখালীর জ্যৈষ্ঠপুরায় কৃষক সম্মেলনে গুরু রমেশশীল ও কিশোর ফণী বড়ুয়ার মধ্যে ‘কৃষক বনাম জমিদার’ শীর্ষক পালা পরিবেশিত হয়। ফণী বড়ুয়ার একটি গানের বাণীতে তাঁর প্রিয় গুরুকে উৎসর্গ করে তিনি মঞ্চে গেয়েছিলেন ‘রমেশ শীলের সঙ্গে থাকি/ ধর্মীয় কবিগান শিখি/ ফরিয়াদি অবাস্তবের ধ্যান। বছর তাহার সনে/ পাল্টা দিলাম কবিগানে। পাই নি কোনো রাজনীতির সন্ধান।’ এ কবি গানে কৃষকের ভূমিকায় ফণী বডুয়া জমিদার পক্ষে রমেশ শীল বিপক্ষে গান করেন। প্রথম গুরুকে কবিতার ছন্দে বলেছিলেন–
‘স্মরণ করলে যাদের স্মৃতি বুকে জাগে স্বদেশ প্রীতি
চালাইতে মুক্তির অভিযান।
সূর্য সেনের নেতৃত্বে পাঞ্জা ধরি মৃত্যুর সাথে
স্বাধীনতা করতে চাই অর্জন।
জালালাবাদে পাহাড়েতে অস্ত্রের জবাব অস্ত্রে দিতে
করিয়াছে জীবন বিসর্জন।’
এই গানের মাধ্যমে তিনি সমকালীন রাজনীতিকে তুলে এনেছেন। দেশে তখন চারদিকে তেভাগা আন্দোলনের কড়া নাড়ছে। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন জনতা। এই প্রসঙ্গে ফণী বড়ুয়ার উক্তি– ‘রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে শোষিত প্রজায় / জমিদারী উচ্ছেদ হবে লাঙ্গলের ঠেলায়’। এই প্রতিবাদী দৃপ্ত কণ্ঠের গানগুলো শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। জনতা জয়ের ধ্বনির মাধ্যমে কবিকে উৎসাহিত করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মাস্টারদা সূর্যসেন কর্তৃক ব্রিটিশের অস্ত্রাগার দখল ও তাঁর ফাঁসি ইত্যাদি বিষয়ে ফণী বড়ুয়ার সাহসে উচ্চারণ ছিলো এভাবে ‘অগ্নিপুরুষ সূর্যসেন অগ্নিমন্ত্রে শিক্ষাদানে/ স্বাধীনতার করিতে লড়াই/ অস্ত্রের জবাব অস্ত্রে দিতে ইংরেজকে তাড়াইতে/ এই সংকল্প অন্তরে জানাই।’ তিনি বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের আদেশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এভাবে– ‘সূর্যসেনের সূর্যের মতো তেজ–বীর্য–সাহস/ কোনো বাঁধায় টলেনি তার বিপ্লবী মানস। অগ্নিমন্ত্রে গঠন করে গুপ্ত সংগঠন / ঘুচাইতে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শোষণ। চট্টগ্রাম জালালাবাদে পাহাড়ের চূড়ায় / যুদ্ধ করি স্বাধীনতার পতাকা উড়ায়। তিনি অন্য পংক্তিতে লিখেছেন ‘সূর্যসেন স্মরণে জাগে ভীরু মরুমন/ স্বাধীনতার মূল অধিকার করিতে অর্জন’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে তার ডাক আসে চট্টগ্রামের বাইরে। তিনি চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকা, কলকাতাসহ নিখিল ভারতের বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে কবিগান গেয়ে দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ফণী বড়ুয়া ১৯১৫ সালে (১৭ শ্রাবণ, ১৩২২ বঙ্গাব্দ) তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামের রাউজানের পাঁচখাইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নন্দকুমার বড়ুয়া এবং মাতা শ্যামা বড়ুয়া। তিনি তার পিতামাতার তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। তার শৈশবেই তিনি তার মাকে হারান। গ্রামের বিদ্যালয়ে তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।
জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে এক কঠিন সময় পার করতে হয়েছিল আজীবন সংগ্রামী ফণী বড়ুয়াকে।
২০০১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত কবিয়াল ফণী বড়ুয়া নাগরিক স্মরণসভা কমিটি, চট্টগ্রাম–এর ‘স্মরণিক’ স্মরণপত্রে কল্পতরু সেনগুপ্ত রচিত ‘দেশব্রতী কবিয়াল ফণী বড়ুয়া স্মরণে’ নিবন্ধ, সুচরিত চৌধুরী রচিত ‘কুসুম বালিকা’ স্মৃতিনিবন্ধ, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন রচিত ‘বর্ষীয়ান কবিগায়ককে শ্রদ্ধাঞ্জলি’ নিবন্ধ, মৃণাল চৌধুরী রচিত ‘কবিয়াল ফণী বড়ুয়া এবং লোকসংস্কৃতির শ্রেণি সচেতনতা’ নিবন্ধ, বাদল বরণ বড়ুয়া রচিত ‘কবিয়াল ফণী বড়ুয়া: সংক্ষিপ্ত জীবনকথা ও তাঁর কবিগানের বিষয় সমীক্ষা’ নিবন্ধ এবং শিমুল বড়ুয়া রচিত ‘যিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি’ নিবন্ধে কবিগানে ফণী বড়ুয়ার অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া তার স্মরণে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে শিমুল বড়ুয়া সম্পাদিত কবিয়াল ফণী বড়ুয়া স্মারকগ্রন্থ–এর প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালে সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক পান ফণী বড়ুয়া। ২০০১ সালের ২২শে জুন তিনি প্রয়াত হন।
গণ চেতনার মাধ্যমে তিনি শোষিত মানুষের সুখ–দুঃখ, হাসি–কান্না, আশা–নিরাশা ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণভাবে। একান্ত সাদা খোলা মন নিয়ে নির্ভীক চিত্তে সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধানে পথ খুঁজে দিতে পেরেছেন তিনি। এ জন্যই বাংলার মানুষ আজও তাঁকে মনে রেখেছেন। বাংলার মাটিতে ফণী বড়ুয়া আরো বহু বছর জেগে থাকবেন।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।