কালের সাক্ষী নয়া পল্টনের শতবর্ষী শিল্পী বাড়ি

রশীদ এনাম | সোমবার , ১৮ আগস্ট, ২০২৫ at ৯:০০ পূর্বাহ্ণ

ঢাকা নয়া পল্টন মসজিদ গলি দিয়ে একটু ভিতরে গেলে বালুর মাঠ আবাসিক এলাকা। পুরান ও নতুন ঢাকার মাঝামাঝি পল্টন এলাকা। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারম উত্তর পাশ পুরানা পল্টন। পল্টন মডেল থানা এবং জোনাকী ও নয়া পল্টন মসজিদ গলি হলো নয়া পল্টন এলাকা। জোনাকী সিনেমাহলটিও আদিকালের। এখন আর সিনেমাল হল নেই। জোনাকি কনভেনশন হল পাশে মুগল কাবাব ঘর, পুলিশ সমবায় সমিতির পলওয়েল মার্কেট অপর পাশে চায়না টাউন শপিং মল। একসময় পল্টন ছিল রমনার অংশ। পল্টনে ছিল সবুজে ঘেরা। ইংরেজি প্লাটুন থেকে পল্টন নামের উৎপত্তি। ব্রিটিশ আমল থেকে এখানে সেনানিবাস ছিল। পল্টনের উত্তর পাশে ছিল রামকৃষ্ণপুর। দেশভাগের পর অনেকে বাড়ি ঘর বিক্রি করে ভারতে চলে যায়। পল্টনের আবার কিছু বিহারীও ছিল। পল্টনে বেশির ভাগ শত্রু/অনিষ্পন্ন সম্পত্তি রয়েছে। নয়া পল্টনে বালুর মাঠের একটু সামনে এগুলে দেখা মিলবে ছবির মতো ছোটো একটা দোতলা পুরানো বাংলো বাড়ি ৯৩/নয়া পল্টন। বাড়ির ফটকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন আমের গাছ, একটু ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে আনোয়ার পারভেজ সংগীত ঘর। সংগীত ঘরের দরজার ওপরে আরবিতে লেখা ‘লা ইলাহা ইলল্লাহু মুহাম্মদুর (সা.)।’ বাড়ির পেছনে বেশ কয়েকটি কাঁঠাল গাছ দেখা যাবে। আদি বাড়িটি দেখলে মনে হবে এটি পুরানো জমিদার বাড়ি। বাড়িটি এত নান্দনিক যে বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে যে কেউ এক পলক তাকিয়ে থাকবেন। বাড়ির দেওয়ালে শ্যাওলা লতাপাতায় ঢেকে আছে। কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল ঝুলছে। বাড়ির দেওয়ালে পরগাছা ছোটো পাকুড় গাছের শেকড় দেওয়ালটিকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরেছে।

নয়া পল্টনে নায়ক জাফর ইকবাল ও সুকণ্ঠী গায়িকা শাহনাজ রহমতুল্লার বাড়ি বললে এক নামে চিনে। বাড়িটি দেশবরেণ্য তিন বিখ্যাত শিল্পীর স্মৃতি বহন করছে। সুরকার আনোয়ার পারভেজ, শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ এবং নায়ক জাফর ইকবাল। চলচ্চিত্র জগতের তিন কিংবদন্তি ছিলেন দেশের তিন উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। বাড়ির ইতিহাস জানার পূর্বে জানা যাক তিন গুণী শিল্পী পরিবারের পেছনের গল্পপুরান পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা প্রাচীন মহল্লা চকবাজার থানার বিপরীতে, চকবোর্ডিং। এটি নন্দকুমার দত্ত রোড নামে এলাকায় অবস্থিত। রাস্তার পাশে মিয়া সাহেবের বাড়ি, কাজী বাড়ি, সুফি বাড়ি। পাশে চুড়িহাট্টা ছোটো মসজিদ। সামনে একটু এগুলে চকবাজার শাহী জামে মসজিদ। মসজিদের পাশে আইনজীবী ফজলুল হকের বাড়ি। আইনজীবী ফজলুল হকের পিতার নাম জাকারিয়া। আইনজীবী ফজলুল হক ও আসিয়া হক দম্পতির সাত সন্তান। আনোয়ার পারভেজ, শাহনাজ রহমতুল্লাহ,জাফর ইকবাল ও ফুয়াদ। সাত ভাইবোনের মধ্যে বাকি তিনজনের নাম জানা যায়নি। আদিকাল থেকে শিল্পী পরিবারটি শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতি, হিতৈষী, মূল্যবোধের বেশ নামযশ ছিল।

আইনজীবী ফজলুল হকের ভাই হাফেজ জহুর কাদেরিয়া তরিকতের কামেল পির ও শায়ের ছিলেন। ফজলুল হক পরিবারে আদিকাল থেকে মুশায়েরা গানের আসর, সামা গজল ও কাওয়ালি আসর বসত। ফজলুল হকের স্ত্রী আসিয়া হক ছিলেন সংগীতপ্রেমী। তিনি চাইতেন তাঁর সন্তানরা সংস্কৃতিমনা হোক এবং নিয়মিত সংগীত চর্চা করুক। তাঁর ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকে পরিবারের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশে ঋদ্ধ হতে থাকল। একসময় ধ্যান অনুশীলন চর্চার মাধ্যমে তিনজনই সংগীত জগতের বিখ্যাত তারকা বনে যান। ভাইবোন তিনজনে আপন মহিমায় জায়গা করে নেন ইতিহাসের পাতায়। একজন হলেন বিখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজ, চলচ্চিত্র শিল্পী সুদর্শন নায়ক জাফর ইকবাল, কিংবদন্তি গায়িকা শাহনাজ রহমতুল্লাহ। ফজলুলআসিয়া দম্পতির তিন সন্তান সংস্কৃতিজগতে তাঁদের স্বপ্নের শিখরে পৌঁছে যান।

শাহনাজ রহমতুল্লার জন্ম ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারি। মাত্র ছয় বছর বয়সে শিশুকিশোর সংগঠন খেলাঘরের এক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে এগারো বছরের শিশু শিল্পী হিসেবে টেলিভিশনে গান গাওয়ার মাধ্যমে মিডিয়ায় আত্মপ্রকাশ করেন সুরেলাকণ্ঠী গায়িকা শাহানাজ রহমতুল্লাহ। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত হয় উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলন। ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সম্মেলনে সে সময় যোগ দিয়েছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত গুণী শিল্পী ওস্তাদ ফতেহ আলী খাঁ, ওস্তাদ আমানত আলী খাঁ, ওস্তাদ নাজাত আলী খাঁ, ওস্তাদ মেহেদী হাসানসহ আরো অনেক গজল সম্রাট। সেই অনুষ্ঠানে শাহনাজ রহমতুল্লাহ গান পরিবেশন করেছিলেন। তাঁর গান শুনে ওস্তাদ মেহেদী হাসান মুগ্ধ হন। তিনি ঢাকায় একজন শিষ্য তৈরি করার তাগিদে শাহনাজ রহমতুল্লাহকে তালিম দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেই সময় থেকে শাহনাজ রহমতুল্লাহর সংগীত সাধনায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়। একসময় ওস্তাদ মেহেদী হাসানের শিষ্য হয়ে বিখ্যাত শিল্পী হয়ে ওঠেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। দেশাত্মবোধক জনপ্রিয় গানের বেশির ভাগই গেয়েছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। তিনি ১৯৯০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র ও ১৯৯২ সালে একুশে পদক পান। ২৩ মার্চ ২০১৯ সালে কিংবদন্তি এই শিল্পী না ফেরার দেশে চলে যান।

চলচ্চিত্র অভিনেতা জাফর ইকবাল ২৫ সেপ্টম্বর ১৯৫০ সালে নয়াপল্টনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে ছিলেন সংগীতশিল্পী, গিটারবাদক ও অভিনেতা। আশির দশকে বাংলাদেশের হার্টথ্রুব নায়ক ছিলেন জাফর ইকবাল। তিনি ছিলেন দেখতে যেমন সুদর্শন, তেমিন পোশাকআশাকেও বেশ স্মার্ট ও স্টাইলিশ। নায়ক জাফর ইকবাল ভালো গিটার বাজাতেন। তাঁর আদর্শ ছিলেন রক এন রোলের রাজা এলভিস প্রিসলি। গান করতে ভালোবাসতেন। ১৯৬৭ সালে তাঁর বন্ধু তোতা, মাহামুদ ও ফারুককে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘র‌্যাম্বলিং স্টোনস’ নামের একটি ব্যান্ড।

জাফর ইকবাল ছিলেন আশির দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক। ‘আপন পর’ ছায়াছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে আসেন নায়ক জাফর ইকবাল। তিনি প্রায় ৩০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। শুধু অভিনেতা কিংবা গায়ক নন তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি কিংবদন্তি নায়ক দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

সুরকার ও সংগীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজের জন্ম ১৯৪৪ সালে। ষাটের দশকের তিনি সংগীত জীবন শুরু করেন। কর্মজীবনে চট্টগ্রাম বেতারেও তিনি কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের সুর করেন। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি দেশাত্মবোধক গানের সুর করেছেন। ১৯৭৬ সালে “দি রেইন” ছবির চলচ্চিত্রে সুর করে তিনি সংগীতবোদ্ধাদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন। সংগীত জীবনের ৪০ বছরে দুই হাজারেরও বেশি গানে সুর দিয়েছেন আনোয়ার পারভেজ। দেশবরেণ্য এই বিখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক ১৭ জুন ২০০৬ সালে পরকালে পাড়ি জমান।

দেশের কিংবদন্তি এই তিন গুণী শিল্পীর স্মৃতি বিজড়িত নয়া পল্টনের আদি বাড়িতে একসময় গানের আসর বসত। বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার, গায়ক, নায়করা নিয়মিত আসাযাওয়া করতেন এই বাড়িতে। গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার এক রাতে নায়ক জাফর ইকবালদের নয়া পল্টনের আদি বাড়িতে বসে লিখেছিলেন, ‘তুমি সাতসাগরের ওপার হতে আমায় ডেকেছ আর মন ভ্রমরের কাজল পাখায় ছবি এঁকেছ’ (ছায়াছবি: কত যে মিনতি) গানটিতে সুর দিয়েছিলেন আনোয়ার পারভেজ এবং গেয়েছিলেন শিল্পী মোঃ আব্দুল জব্বার ও শাহনাজ রহমাতুল্লাহ। শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে, এক নদী রক্ত পেরিয়ে, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে, প্রথম বাংলাদেশে আমার শেষ বাংলাদেশ, এক তারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল ইত্যাদি।

শতবর্ষী এই আদি বাড়িটি আইনজীবী ফজলুল হক ও আসিয়া হক দম্পতি নয়া পল্টনের বিহারি হিন্দু জমিদার পার্ল সাহেবের কাছ থেকে কিনে নেন। এই বাড়িতে গুণী তিন শিল্পীর জন্ম। প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবালের ছোটো ভাই ফুয়াদ মাঝে মাঝে গিটার বাজান এই বাড়িতে। গুণী শিল্পীদের বর্তমান প্রজন্মরা মাঝে মাঝে এই বাড়িতে বেড়াতে আসেন। ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে শতবর্ষী শিল্পী বাড়িটি পাহারা দিচ্ছেন সেকান্দার আলী (৮৮)। তিনি জানান, বাড়িটি দেড়শ বছরের পুরানো। এটি ছিল হিন্দু পার্ল সাহেবের বাড়ি। নয়া পল্টনে এটি সবচেয়ে পুরানো বাড়ি। পাখি ডাকা ছায়া ঘেরা সুনিবিড় সুনসান শতবর্ষী বাড়িটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

তথ্যঋণ: ফুয়াদ, নায়ক জাফর ইকবালের আপন সহোদর; আলোকচিত্র: তারেক মাহামুদ (যমুনা টেলিভিশন); সিকান্দার আলী

# রশীদ এনাম, সমন্বয় সহকারী ইতিহাসের খসড়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধজিলু খান : কালজয়ী সুরস্রষ্টা