কালের সাক্ষী চন্দনপুরার নাচঘর

নেজাম উদ্দিন আবির | বুধবার , ২৮ মে, ২০২৫ at ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র চন্দনপুরায় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরনো ভবন সাজ্জালেলার নাচঘর। নবাব সিরাজউদদৌলা সড়কের পাশে, চন্দনপুরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সন্নিকটে অবস্থিত এই ভবনটি কেবল একটি স্থাপনা নয়, এটি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অতীতের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এক সময় এই নাচঘর ছিল সুরলয়ের অনন্য এক কেন্দ্র, যেখানে প্রতিদিন রাতভর প্রতিধ্বনিত হতো ঘুঙুরের শব্দ। জমিদার সাজ্জালেলার আমলে এখানে জমে উঠত বাইজিদের নৃত্য ও সংগীতানুষ্ঠান, আর অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা মিলিত হতেন এই আসরকে ঘিরে। আজ এই ভবনটি ইতিহাসের ভারে নত হলেও, এর প্রতিটি ইটপাথরে যেন লুকিয়ে আছে চট্টগ্রামের এক গৌরবময় সাংস্কৃতিক অধ্যায়।

চন্দনপুরার এই ভবনটির ইতিহাস প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো হলেও, এর নির্মাণ শুরুর প্রেক্ষাপট আরও পুরোনো। ধারনা করা হয়, ভবনটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল পর্তুগিজ শাসনামলের ধারা ধরে, ব্রিটিশ আগমনের আগেই। জমিদার সাজ্জালেলার ছিলেন প্রথম প্রজন্মের জমিদার, যার হাত ধরে এই ভবন নির্মাণের সূচনা হয়।

দুইতলা বিশিষ্ট এই ভবনটিতে রয়েছে মোট ১৪টি কক্ষ, যা নাচ, গান এবং অতিথি আপ্যায়নের কাজে ব্যবহৃত হতো। বাইজিদের জন্য ছিল আলাদা সাজসজ্জার কক্ষ, অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত অভ্যর্থনা কক্ষ এবং সুরের চর্চার জন্য বিস্তৃত হলঘর। প্রতিটি দরজা, জানালা এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে সুরের অনুরণন গোটা ভবনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

বিশেষভাবে নজর কাড়ে ভবনের নির্মাণশৈলী। ১০ ইঞ্চি চওড়া ইটের দেয়াল ভবনটিকে করেছে দৃঢ় ও স্থিতিশীল। কোথাও কোনো লোহার কাঠামোর ব্যবহার না করেও এমন মজবুত স্থাপনা আজকের দিনে বিরল। ভবনের ভেতরের দেয়ালে এখনও অঙ্কিত আছে দেবদেবী, ফুল ও অন্যান্য শৈল্পিক অলংকরণ, যা শিল্পমানের এক অনন্য নিদর্শন।

সাজ্জালেলা ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক মনস্ক জমিদার। তাঁর আমলে চন্দনপুরা, চকবাজার, আন্দরকিল্লা, নিউ মার্কেট, বাকলিয়াসহ আশপাশের অনেক এলাকার জমিদারি ছিল তাঁর হাতে। নাচঘরটি শুধু বিনোদনের জন্য নয়, এটি ছিল স্থানীয় সংস্কৃতি ও রুচির চর্চার কেন্দ্র।

বহুকাল ধরে জমিদার সাজ্জালেলার পরিবার এই ভবনটির দেখভাল করতেন। তবে ইতিহাসের চাকা ঘুরতে বেশি সময় লাগে না। পাকিস্তান আমলে জমিদারদের অনেক সম্পত্তিই সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। এই ভবনটিও বাদ যায়নি। সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে এটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় অগ্নিনির্বাপক কার্যালয়ের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এরপর বহু বছর ব্যবহার না হওয়ায় ভবনটি পড়ে থাকে অযত্নে, অবহেলায়।

স্থানীয় এক প্রবীণ বাসিন্দা ইকবাল হোসেন জানান, এ এলাকার জমিদার ছিলেন সাজ্জালেলার দাদা, যিনি চন্দনপুরা, আন্দরকিল্লা, নিউ মার্কেট, বাকলিয়াসহ আশেপাশের এলাকায় জমিদারি করতেন। তাঁর সময়েই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি নির্মিত হয়, যা পরবর্তীতে তার বংশধরদের মাধ্যমে উত্তরাধিকারসূত্রে বজায় ছিল। বর্তমানে ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে, যদিও একসময় এটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় অগ্নিনির্বাপক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এ ভবনকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রায় ২৫ বছর আগে বাংলাদেশ সরকার ভবনটিকে ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করে। এরপর থেকে ভবনটির পরিচর্যা হয়নি বললেই চলে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন এই কাঠামোর গায়ে জমেছে ধুলো, পড়ে গেছে প্লাস্টার, ঝরে পড়েছে পলেস্তারা তবু এই স্থাপনাটি আজও দাঁড়িয়ে আছে।

সামপ্রতিক বছরগুলোতে কিছু সচেতন নাগরিক ও ইতিহাসপ্রেমী এই ভবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। সরকারও একপর্যায়ে আগ্রহ দেখিয়েছে ভবনটি সংরক্ষণের। জানা গেছে, ভবনটিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মিউজিয়াম হিসেবে রূপান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই উদ্যোগ সফল হলে ভবনটি শুধু সংরক্ষিতই হবে না, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারবে।

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, জাদুঘর গড়ার বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তে অপেক্ষা আছে। মূলত ফায়ার সার্ভিসের পুরাতন যন্ত্রপাতি ও উপকরণগুলো সেখানে যত্নসহকারে সংরক্ষণ করার কথা রয়েছে। তবে সকল অফিসিয়াল প্রক্রিয়া শেষ হতে কিছুটা সময় লাগছে।

চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাস মানেই শুধু ব্যবসাবাণিজ্য, বন্দর বা রাজনৈতিক অঙ্গন নয়। এখানে ছিল রুচিশীল সংস্কৃতি, জমিদারি ঐতিহ্য এবং সুরসাধনার মহল। ‘চন্দনপুরার নাচঘর’ সেই ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। এটি শুধু একটি ভবন নয়, এটি হলো একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি, একটি হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির দর্পণ।

এখন সময় এসেছে এই ভবনটির গুরুত্ব বুঝে তা সংরক্ষণের। প্রয়োজন ঐতিহাসিক ভবন সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, বাজেট বরাদ্দ এবং সচেতন নাগরিকদের সম্পৃক্ততা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানতে পারে তাদের শহরের হৃদয়ে লুকিয়ে আছে এমন এক সাংস্কৃতিক সম্পদ সে জন্যই প্রয়োজন এই স্থাপনাকে ফিরিয়ে আনা তার প্রাপ্য মর্যাদায়।

চন্দনপুরার নাচঘর আজ আর বাইজিদের নৃত্য বা অতিথিদের কলরবে মুখর নয়, কিন্তু এই নীরব ভবনের দেয়ালে লেগে আছে ইতিহাসের ধ্বনি, স্মৃতির গন্ধ এবং এক সময়ের জমকালো সংস্কৃতির ছায়া। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই ভবনটি হতে পারে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের এক আলোকবর্তিকা। যথাযথ উদ্যোগ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে চট্টগ্রামের এই প্রাচীন সম্পদকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব তার হারানো গৌরব ও মর্যাদায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজয়কে ‘অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্রের’ মামলায় খালাস পেলেন শফিক রেহমান
পরবর্তী নিবন্ধসরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন একদিনের জন্য স্থগিত