আমাদের প্রিয় চট্টগ্রামের দর্পণ হিসেবে পরিচিত দৈনিক আজাদী পত্রিকার ব্যাপকতা ও বিশালতা অপরিসীম। চট্টগ্রামের প্রতিটি মানুষের সুখ দুঃখ আনন্দ–বেদনা চাওয়া পাওয়া দাবি–দাওয়া প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভাষা হচ্ছে দৈনিক আজাদী পত্রিকা। প্রতিটি বর্ণ, অক্ষর, শব্দ, লাইন, কলাম ও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় এই অঞ্চলের মানুষের মনের ভাষাকে লিখিত রূপের প্রকাশ করে আসছে ঐতিহ্যবাহী দৈনিক আজাদী পত্রিকা। মনের গভীরে প্রবেশ করে প্রতিটি মানুষের অভিব্যক্তিকে একটি আক্ষরিক রূপ দিয়ে থাকে। আমাদের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দৈনিক আজাদীর ভূমিকা অনন্য ও অনবদ্য। রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো উত্থান পতনের সাথে সাথে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার উত্থান পতন ঘটেছে। কিন্তু এই আজাদী পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতায় এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।
বরং যে জনপ্রিয়তা নিয়ে আজাদী পত্রিকার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল সেই জনপ্রিয়তার অগ্রযাত্রার ধ্বনি সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সংখ্যায় এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মনের অনুভূতিকে একটি বিপ্লবী রূপ দিয়েছে। এদেশের মানুষের স্বাধীনতার প্রতি প্রবল অনুভূতিকে আক্ষরিক রূপে প্রকাশ করেছে। যখন যেভাবে জীবন অতিবাহিত হয়েছে ঠিক সেই ভাবে জীবনের অর্থ খুঁজেছে। জীবনকে জীবনের তাগিদেই সাজিয়েছে। প্রতিদিনের ঘটনা রটনার যে তথ্যচিত্র তুলে ধরে তাতে সব তথ্যগুলো এক সাথে পাওয়া যায়। সেই সকালেই জানা যায়; ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিটি সেকেণ্ড, মিনিট ও ঘণ্টার সংবাদ। একটি ছকে নিয়ে আসা এই সংবাদগুলো পত্রিকার পাতায় পাতায় একই নিয়মে প্রকাশিত হচ্ছে। কোনো ধরনের ছন্দ পতন হয় না। আঞ্চলিক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদগুলো বিশেষ বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকাশের ক্ষেত্রে আজাদীর ভূমিকা অনন্য। এক্ষেত্রে আজাদী পত্রিকা যোগ্যতা দক্ষতা বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়ে আসছে দিনের পর দিন। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে প্রতিটি ক্ষণে ঘটে যাওয়া দেশ–বিদেশের আনাচে কানাচের সংবাদগুলো সুশৃংখল ও সারিবদ্ধভাবে প্রকাশের মাধ্যমে আজাদী পত্রিকাটি বিশেষ অবদান রেখেছে। সবার অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়ে এসেছে।
বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের প্রতি মুহূর্তের সংবাদগুলো সংগ্রহ করার এবং সেই সংবাদগুলো পত্রিকায় প্রকাশের ক্ষেত্রে আজাদী পত্রিকার বিকল্প নেই। আধুনিক প্রযুক্তির বদলতে এক ক্লিকে যেমন সকল সংবাদ জানা যায় ঠিক সেই ভাবে আজাদী পত্রিকাটিও প্রত্যেকটি সংবাদকে একসাথে উপস্থাপনা করেছে। কখনো ৮ পৃষ্ঠা আবার কখনো ১২–১৬ পৃষ্ঠায় আজাদী পত্রিকা সাজানো হয়। জীবনের শুরু থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার রাত ও দিনের সংবাদগুলো নিমিষেই পাওয়া যায়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংবাদগুলো সমান ভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। জীবনের বাঁকে বাঁকে সাজানো সংবাদগুলো বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে সারা বিশ্বের যে করুণ পরিস্থিতি হয়েছিল সবকিছুই এই পত্রিকার মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে। অর্থনৈতিক মন্দার ফলে যখন সবকিছু আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখনো এই আজাদী পত্রিকা তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রাণের দাবী ও ভালোবাসার টানে প্রকাশনা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। মহাবিশ্বের সৌরজগতের জানা অজানা সকল সংবাদ সুন্দরভাবে প্রকাশনার ক্ষেত্রে অগ্রণী পালন করে আসছে। তথ্য–কণিকা থেকে শুরু করে কৌতুক গল্প, উপন্যাস, ছড়া, কবিতা, ইত্যাদি বিষয় ছোট বড় সবার উপযোগী করে প্রকাশিত হয়। যে কোনো মানসিক প্রশান্তির জন্য জীবন ভিত্তিক সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে আজাদী পত্রিকার ভূমিকা অনন্য। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস; ওষুধপত্র; হাট বাজার; দোকান পাট; কলকারখানা; চিত্ত বিনোদন; বিজ্ঞান প্রযুক্তি; শিক্ষা সংস্কৃতি; লেখাপড়া ইত্যাদি অনেক জানা–অজানা বিষয়গুলোকে জনগণের সামনে তুলে ধরে। জীবন ভিত্তিক সংবাদ প্রকাশনায় আজাদী পত্রিকা অনবদ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।
প্রাণের খোরাক হিসেবে দৈনিক আজাদীর ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে বয়স্ক পুরুষ এবং মহিলারা যারা একেবারে ঘরে বন্দি থাকেন তাদের কাছে দৈনিক আজাদী প্রাণ শক্তির মত কাজ করে। বার্ধক্যের দুর্বলতার কারণে এই বয়স্ক মানুষগুলো ঘর থেকে তেমন বের হতে পারেন না। তাছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও তাদেরকে তেমন সময় দিতে পারেন না। একটি ঘরের সাধারণত একটা অথবা দুটো টেলিভিশন থাকে। টেলিভিশনগুলো পরিবারের অন্য সদস্যরা দখল করে নেয়। উনারা প্রয়োজন ছাড়া তেমন মোবাইল ব্যবহার করেন না। তাই সেই সকালে হাতে পাওয়া আজাদী পত্রিকাটি তাদের সারাদিনের সঙ্গী হিসাবে থাকে।
এখানে উল্লেখ্য, আগ্রাবাদ সরকারি কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমাদের প্রিয় খাস্তগীর স্যার আজাদী পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হলেই আমাকে ফোন করেন। তিনি পত্রিকা পড়ে আমার লেখাটা নিয়ে আলোচনা করেন। স্যারের বয়স প্রায় ৮৫ বছর। বার্ধক্যের কারণে অনেক ধরনের অসুখ বিসুখে জর্জরিত। প্রতিদিন আজাদী পত্রিকাটি তাঁর সময় কাটানোর ও অবসরের কাটানোর একমাত্র মাধ্যম। আজাদী পত্রিকাটি তাকে এক ধরনের শক্তি যোগায়। এভাবে আরও একজন আমাদের কলেজের গভর্নিং বডি ও বাস্তবায়ন কমিটির সাবেক সদস্য ছিলেন জয়নাল আবেদীন ভাই। জয়নাল ভাই প্রায় ৮০ বছরের মতো বেঁচে ছিলেন। খুব খুশী হয়ে অনেক অনেক দোয়া করতেন। আমার এক খালাম্মা মেহেরুন্নেসা বেগম ১৯৫২ সালে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আবাসিক হোস্টেলে থাকতেন। ভাষা আনদোলনের সময় আবাসিক হোস্টেলের ছাত্রীদের ট্রাকে করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সারা চট্টগ্রাম শহরে ঘুরে ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছিলেন। ৫/৬ বছর আগে খালু মারা যান। আমি তাঁদের বাসায় যায়। কথার প্রসঙ্গে যখন তিনি জানতে পারেন; আমিই সেই আজাদী পত্রিকার কলামিস্ট আয়েশা পারভীন চৌধুরী তখন জড়িয়ে ধরেন। সেই খালাম্মার প্রতি দিনের আনন্দ ও বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল আজাদী পত্রিকা। তিনি এখন আর নেই কিন্তু সেই সুখকর স্মৃতি অমলিন থেকে গেছে। এভাবে আজাদী পত্রিকা দেশের একটি বৃহৎ অংশ যারা বৃদ্ধ এবং ঘরে এক ধরনের বন্দী জীবন যাপন করছেন তাদের জন্য প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করে। আজাদী পত্রিকাটি বার্ধক্যজনিত অসুখ বিসুখে নানার ওষুধের চেয়েও ভালো থাকার মহৌষধের মতো কাজ করে যাচ্ছে।
পেশাগত ক্ষেত্রে অনেকেই দৈনিক আজাদীর সাথে সম্পৃক্ত। সেই শুরু থেকে এই আজাদী পত্রিকার যে সংগ্রামী পথ চলা সেই চলার পথে প্রতিটি ধাপে ধাপে অসংখ্য পেশার মানুষ সম্পৃক্ত হয়ে আছে। শুধু সম্পাদক, সহসম্পাদক, অফিস কর্মচারীদের নিয়ে আজাদী পত্রিকার পথচলা সম্ভব নয়। আজাদী পত্রিকার এই অগ্রযাত্রার সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন পেশার মানুষ। এমনকি একেবারে খেটে খাওয়া মানুষদের ভূমিকাও অনেক। যাদের নিয়ে সংবাদ তৈরি হয় তাদের জীবন সংগ্রামের প্রতিটি ক্ষণ ও ঘটনা জানার জন্য সেই মানুষগুলোকে খুব কাছ থেকে জানতে হয়। জীবনের সত্যিকারের ঘটনা জানার জন্য দুই পক্ষের মানুষকেই এক হতে হয়। এভাবে অসংখ্য মানুষ আজাদী পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত আছেন। সকলের সহযোগিতা ও কর্ম প্রচেষ্টার ফসল আজাদী পত্রিকাটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অনেক ধাপ পার হতে হয়। হাতে হাত মিলিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে হকার পর্যন্ত আজাদী পত্রিকার অগ্রযাত্রার সাথে জড়িয়ে আছে। এক্ষেত্রে আজাদী পত্রিকার অগ্রযাত্রা শুরুর প্রথমে কয়েক জন নিবেদিত প্রাণ হকার ও পরিচিত আপন জনের পাশাপাশি আজকের আজাদী পত্রিকার দীর্ঘ পথ চলায় বিভিন্ন স্তরের মানুষ জড়িয়ে আছে। একটি শিশুর জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত অর্থাৎ শৈশব, কৈশোর, যৌবন, মধ্যবয়স ও বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হওয়ার মত অসংখ্য মানুষের জীবন চক্রের সাথে আজাদী পত্রিকা সম্পৃক্ত আছে। কিন্তু মানুষের জীবন চক্রের মত আজাদী পত্রিকার এই অগ্রযাত্রায় কোনো বয়সের ধাপ মানে না। কোনো রীতি–নীতির জাঁতাকলে আজাদী পত্রিকার অগ্রযাত্রায় ছন্দ পতন ঘটেনি। করোনা পরবর্তী সকল বাধা অতিক্রম করে আজাদী পত্রিকার অগ্রযাত্রা দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। জয় হোক কালের সাক্ষী আজাদী পত্রিকার অগ্রযাত্রা। জয় হোক এই বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের।
লেখক: কলামিস্ট; অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম।