চট্টগ্রামবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্পের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে আজ। আজ বুধবার সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্য দিয়ে চান্দগাঁও–বোয়ালখালী ও পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্তত ১ কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। আশ্বাসের পর আশ্বাস; একটি সেতুর জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছিল না। প্রধান উপদেষ্টা কালুরঘাট সেতু প্রকল্পটি গত বছরের ৭ অক্টোবর একনেক সভায় অনুমোদন দেন। আজ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কালুরঘাট নতুন সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। ব্যস্ততার কারণে কালুরঘাটের পরিবর্তে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ভিত্তিপ্রস্তরের ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ১১টা ৪৫ মিনিট থেকে ১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করা হবে বলে জানা গেছে।
দেশের ইতিহাসে ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচনের বিষয়টি। ভিত্তিপ্রস্তরের ফলকে নাম দিতে চাচ্ছেন না প্রধান উপদেষ্টা। ফলে প্রধান উপদেষ্টার নাম ছাড়াই ফলক তৈরি করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টার হাতে চট্টগ্রামবাসীর এই গুরুত্বপূর্ণ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কারণে চান্দগাঁও–বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী উৎফুল্ল। দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর হওয়ার আশায় ওই এলাকার মানুষের মাঝে উৎসাহ–উদ্দীপনা বিরাজ করছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কালুরঘাট রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নির্বিঘ্ন ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বর্তমান পুরাতন সেতুর পাশে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর নতুন রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রেলপথ মন্ত্রণালয় ২০৩০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করবে।
প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকে জানা গেছে, এঙট্রা ডোজ টাইপ সেতুটির এক পাশে দুটি ডুয়েলগেজ রেলপথ ছাড়াও অন্য পাশে স্ট্যান্ডার্ড মানের দুই লেনের (প্রতিটি লেন ১৮ ফুট) সড়ক ছাড়াও উভয় পাশে সার্ভিস লেনসহ (৫ ফুট করে) পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা রাখা হবে। সেতুটির নদীর অভ্যন্তরে পাঁচটিসহ মোট সাতটি স্প্যান থাকবে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীণ আজাদীকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে কর্ণফুলী নদীর উপর কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করবেন। সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গুরুত্বপূর্ণ কালুরঘাট রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় দোহাজারী–কঙবাজার রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরীকে।
ভূমি অধিগ্রহণসহ সেতু নির্মাণের কাজ পুরোদমে কবে শুরু হবে–এমন প্রশ্নের জবাবে কালুরঘাট সেতুর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহাম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, বলতে গেলে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে পরামর্শক নিয়োগের টেন্ডার হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়েছে। বিদেশি পরামর্শক নিয়োগের পর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে। ফিল্ডে কাজ শুরু হতে একটু সময় লাগবে।
২০২৪ সালে একনেকে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটির পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে আটটি দেশি–বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নেওয়ার পর এঙপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) ডাকা হয়েছে। দুই ধাপে এ নিয়োগ সম্পন্ন করতে প্রায় ছয় মাস সময় লাগবে। এরপর জমি অধিগ্রহণ ও প্রকল্পের ডিটেইল ডিজাইন চূড়ান্ত করে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি ভৌত কাজ শুরু করবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। ৭০০ মিটার দৈর্ঘ্যের (মূল সেতু) সেতুটি ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মাণ শেষ হবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকার মধ্যে ৭ হাজার ১২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ)। অবশিষ্ট ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। ভূমি অধিগ্রহণ সরকারি অর্থায়নে হবে।
কালুরঘাট সেতুর মূল প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ৭০০ মিটার রেল–কাম রোড ব্রিজ নির্মাণ, ৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ, ২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার সড়ক ভায়াডাক্ট, ৪ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার বাঁধ, ১১ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ এবং আনুষঙ্গিক কাজ। সেতুর উচ্চতা হবে ১২ দশমিক ২০ মিটার। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ১১ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১০০ ফুট। তবে নদীর উপর মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হবে মাত্র ৭০০ মিটার। উভয় পাশে সাড়ে চার কিলোমিটার করে ভায়াডাক্ট নির্মাণ হবে।
আনন্দ মিছিল : কালুরঘাট সেতুর ভিত্তি স্থাপনের পরদিন বোয়ালখালীর সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ ও বোয়ালখালী কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের উদ্যোগে আনন্দ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় আনন্দ মিছিলে হবে। মিছিলটি কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হবে। এতে যোগ দিতে বোয়ালখালীর সর্বস্তরের নাগরিক সমাজের পক্ষে সৈয়দ জাকির হোসাইন ও সাংবাদিক মনজুর মোরশেদ এবং বোয়ালখালী কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষে আহ্বায়ক আবদুল মোমিন ও যুগ্ম আহ্বায়ক মুস্তফা নঈম অনুরোধ জানিয়েছেন।
এছাড়া কালুরঘাট সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে শুকরিয়া আদায় এবং সেতুর নির্মাণকাজ সূচারুরূপে যাতে সম্পন্ন হয় এর জন্য ১৬ মে শুক্রবার জুমার নামাজের পর বোয়ালখালীর সকল মসজিদে দোয়া ও বিশেষ মোনাজাত করার জন্য মসজিদের খতিবদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।