কালাপানি-ধূসরপানি

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ১৮ জুলাই, ২০২২ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দরিয়ার পানি তো নীল; কিন্তু কালাপানি আবার কী? বৃটিশ আমলে কঠিন সাজার জন্যে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে দ্বীপান্তরে পাঠানো হতো। গভীর সমুদ্রের নিকষ কালোপানি পার হয়ে যেতে হতো বলে সেই সাজার নামই হয়ে গিয়েছিলো কালাপানি। কিন্তু বর্তমান আমলে? সেসঙ্গে আবার ধূসরপানিও যোগ করলাম। মানেটা কী? এর মানে অতি সহজ-জাহাজে টয়লেট-বাথরুম, রান্নাবান্নার কাজ ইত্যাদি কীভাবে হয়, এবং সেখানের পানির কী হয় সেই প্রসঙ্গেই black-water ও grey-watre চলে আসে। সমুদ্রে ভাসমান প্রতিটা জাহাজই এক একটা শহরের মত – দুটারই সার্বিক ইনফ্রা-স্ট্রাকচারে খুব বেশী একটা পার্থক্য নেই। জাহাজে আমরা নিজেরাই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সাপ্লাই দেই, পানি ও তেলের পাইপের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দিকে দিকে সেগুলোর সাপ্লাই দেই, শীত-গ্রীষ্ম অনুযায়ী এয়ারকন্ডিশানিং/হিটিং-এর ব্যবস্থা করি। বিনোদনের স্থান, বাজার সওদার জন্য কোল্ড-স্টোরেজ – মোটামুটি সবই আছে, শুধুমাত্র যানজট ছাড়া।

আজকে বোঝার চেষ্টা করি, কীভাবে জাহাজে স্যানিটেশান-সিস্টেম চলে। প্রথমে পানির রকমফের বোঝার চেষ্টা করি। আপনি টয়লেটে কমোড ব্যবহার করে ফ্লাশ করলেন- এর ফলে যেই পানি ফ্লাশ দিয়ে নীচে চলে গেলো, সেটাকে blackwater/solidwaste বলে। এইটা কোনোমতেই সরাসরি সমুদ্রে ফেলা যাবে না। বাথরুমের বেসিনে মুখ ধুয়েছেন, শাওয়ারে গোসল করেছেন। সাবান-শ্যাম্পু-কন্ডিশানার ব্যবহার করেছেন, সেটাকে বলবো greywater; রান্নাঘরে (গ্যালিতে) রান্নাবান্না, বাসনমাজা ইত্যাদি কাজে যেই পানি ব্যবহার হলো, সেগুলোও এই greywater ক্যাটাগরিতে পড়বে। আমি কালাপানি আর ধূসরপানি বলেছি, কিন্তু ধলাপানি বা সাদাপানি বলি নাই। যদি বলেও থাকি, তাহলে সেটা দুইরকমের – সমুদ্রের লোনাপানি (saltwater); এবং মিঠাপানি (freshwater)। কিন্তু একটা কিন্তু রয়ে যায় এখানে। ফ্রেশওয়াটারের মধ্যেও কিছু জাতিগোত্র ভাগ আছে- potable (পান করার উপযোগী, মিঠাপানি); এবং non-potable, পান করার অনুপযোগী। নন-পটেবল পানি ব্যবহার করা হয় জাহাজের বয়লারে, ইঞ্জিনের কুলিং সিস্টেমে (গাড়িতে যেটাকে আমরা রেডিয়েটর বলি), অন্যান্য অনেক ক্লিনিং বা মেশিনারিজ কুলিং-এর কাজে। আপনাকে বলতে পারি, পিওর ডিস্টিল্ড্‌ ওয়াটার আপনি বেশী পরিমাণে খেতে পারবেন না – লবণ-মশলাছাড়া ডাল-তরকারির মতো বা তার থেকেও স্বাদহীন। আমাদের খাওয়ার পানিতে অনেক খনিজলবণ ও উপকারী কেমিক্যাল মিশানো থাকে বলেই আমরা পান করতে পারি। জাহাজে আমরা সমুদ্রের পানি থেকেই ফ্রেশওয়াটার বানাই, সে ব্যাপারে অন্য সময় লিখবো।

এখন আসুন, অল্প একটু আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা সম্পর্কে জেনে নেই। ইন্টারন্যাশানাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশান (IMO)-র অধীনে, ১৯৭৩ সালে সমুদ্রে দূষণ কমানোর লক্ষ্যে MARPOL (Maritame Pollution) কনভেনশান হয়। এরপরে আস্তে আস্তে জাহাজে যত ধরনের দূষণ সম্ভব সেগুলো নিয়ে রেগুলেশান তৈরি করে তেলের ট্যাংকার, কেমিক্যাল ও বর্জ্যপদার্থ, ব্যালাস্ট, বায়ুদূষণ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের আজকের বিষয়টি MARPOL-এর অহহবী ওঠ কভার করেছে। একটু আগেই বলেছিলাম কালাপানি সমুদ্রে ফেলা যাবে না, সেটা এই অ্যানেক্স ফোর-এই বলা আছে। এসব নিয়মকানুন মেনে না চললে, জাহাজ আটক, কোম্পানিকে পেনাল্টি, ক্যাপ্টেন-চিফ ইঞ্জিনিয়ারসহ দোষী ব্যক্তিদের জেলে চালান- অনেককিছুরই সম্ভাবনা আছে। কালাপানির ব্যাপার তো বললাম, কিন্তু ধূসর পানি? সেটা নির্ভর করে স্থানীয় পোর্ট বা যে দেশের সীমানায় জাহাজ রয়েছে, তাদের লোকাল আইনের উপরে।

আচ্ছা, এবারে আসুন চিন্তা করি, কলম্বাস, ভাস্কো-ডা-গামাদের যুগে তারা কী করতো? আমি প্রথম যখন বৃটিশদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করি, এবং এরপরে ইংল্যান্ডে গিয়েও শুনেছি, তারা বাথরুমে বা টয়লেটে যাবো না বলে, বলে- ও ধস going to the head; হুমম, এর মানে কী? আদিকালের পালতোলা জাহাজে কোন টয়লেটই ছিলো না। পালের সাহায্যে চলতো, মানে জাহাজের পিছন দিক থেকে বাতাস দিলে, সেই বাতাসকে কাজে লাগিয়ে পাল তুলে জাহাজ চলতো। সেজন্যে, বাতাসের বিপরীতে, জাহাজের একদম সামনে, bow-তে কয়েকটা কাঠের তক্তা বিছানো থাকতো, উন্মুক্ত সমুদ্রের উপরে। সেগুলোতে বসেই, ডাইরেক্ট সমুদ্রের পানিতে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হতো। জাহাজের দুলুনীতে সমুদ্রের পানির ঢেউয়ের ঝাপটায়, সেই জায়গাটা অটোম্যাটিক্যালিই পরিষ্কার হয়ে যেত। তাদের তো আমাদের মত বদনার চিন্তা নাই। আর যদি দুলুনির চোটে সমুদ্রের পানি দিয়েই বদনার কাজটা সম্পন্ন হয়ে যায়, তাহলে সেটা তাদের জন্য বোনাস। যুগ যুগ ধরেই কিন্তু সব জাহাজ থেকেই সরাসরি সমুদ্রের পানিতেই বর্জ্যপদার্থ ফেলে দেওয়া হতো। চিন্তা করে দেখেন, কি ভয়ঙ্কর পরিমাণ দূষণ হয়েছে। সেজন্যই মারপোল হয়েছে; শুধু টয়লেটের দূষণ না, সবধরনের দূষণই তারা রেগুলেট করে।

আমরা এখন আর আগের মত সমুদ্রের পানিতেই যদি ফেলতে না পারি, তাহলে জাহাজে কীভাবে পয়ঃনিষ্কাশন করা যায়। একটা করা যায়-ট্যাঙ্কের মাঝে জমা করে রাখা যায়, পোর্টে আসলে টাকা-পয়সা-ডলারের বিনিময়ে কেউ নিয়ে যাবে। ব্যয়বহুল হলেও, এইটা একটা সমাধান বটে। আসলে সব প্লেনেই এই ব্যবস্থা-এত এত যাত্রী, প্লেনের টয়লেট ব্যবহার করে ফ্লাশ করছে, সেগুলো তো বাংলাদেশ রেলওয়ের মত ডাইরেক্ট ফেলে দিচ্ছে না। সব একটা ট্যাঙ্কে জমা হয়। এয়ারপোর্টে পাইপ দিয়ে সেই ট্যাঙ্ক খালি করে পরিষ্কার করা হয়। মহাশূন্যে ইন্টারন্যাশানাল স্পেস স্টেশানের কথাই চিন্তা করুন, তারা কী করছে? সেখানে তো পুকুরপাড়ও নাই, বাঁশঝাড়ও নাই। সাবমেরিনে? দিনের পর দিন একশ’ দুইশ’ মানুষ পানির তলায় থাকে। তারা কী করে?

হ্যাঁ, জাহাজে black-water ও grey water holding tank থাকতে পারে, সেখানে এগুলো আলাদা আলাদা ভাবে জমিয়ে রাখা যেতে পারে। তবে, সেটা জাহাজের জায়গা মেরে দিলো। আবার, পয়সা খরচ করে সেগুলো কাউকে দিতেও হবে। সেজন্যে খরচ কমাতে, আমরা জাহাজেই Sewage Treatment Plant চালাই। কমোড থেকে ফ্লাস করলে, solid-waste ফিল্টারের মাধ্যমে এসে একটা ট্যাঙ্কে জমা হয়। এই যে বললাম ফিল্টার, এটার গুরুত্ব অনেক। ট্রীটমেন্ট প্ল্যান্ট-মেশিনে শক্ত কোনো কিছু গেলে সেটা চলবে না-এই ফিল্টার সেগুলোকে আটকে দেয়। সেজন্যই কমোডে টয়লেটপেপার ছাড়া অন্যকিছুই ফেলা উচিৎ না। সাধারণ বাসা-বাড়ি, অফিসবিল্ডিং-এর কমোডে তো ফেলবেনই না; আর জাহাজে-প্লেনে এই ব্যাপারে আরো কড়াকড়ি করা উচিৎ। বাথরুম করবেন, পানি ব্যবহার করবেন, টিস্যু ব্যবহার করবেন- আর কিচ্ছু না। খবরদার! সেখানে কিছু ফেললে, আমাদেরকেই তো সেই ফিল্টার পরিষ্কার করতে হবে!

বর্জ্যপদার্থ (solidwaste) প্রথম ট্যাঙ্ক থেকে পরের ট্যাঙ্কে (aeration tank) যায়। সেখানে একধরনের অতি উপকারী ব্যাকটেরিয়া দেওয়া থাকে, যেগুলো মানুষের মলমূত্র খেয়েই বেঁচে থাকে, এবং তার বদলে পানি বের করে দেয়। মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া সেই ট্যাঙ্কে ক্রমাগত এই প্রসেস চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অবশ্য অক্সিজেনও দরকার হয়, সেজন্যে এই ট্যাঙ্কে একটা ফ্যান/ব্লোয়ারের মাধ্যমে সবসময়ই বাতাস (অক্সিজেন) সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে, এবং একে বলে এয়ারেশান ট্যাঙ্ক। এই অক্সিজেন বন্ধ হলে, ব্যাকটেরিয়াগুলোও মরে যাবে। আর, কমোডে সাবান-শ্যাম্পু বা অন্য কোন কেমিক্যাল দিলেও এই ব্যাকটেরিয়া মারা যেতে পারে। কমোড পরিষ্কার করা যাবে শুধুমাত্র কয়েকটা বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল দিয়েই। অন্যকিছু ব্যবহার করলে, ব্যাকটেরিয়া মারা যাবে। চিন্তা করতে পারছেন, সেই মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া আমাদের কত উপকার করছে! সেগুলো মারা গেলে ভীষণ বিপদ হবে। তাদেরকে ডেইলি তোয়াজ-তোষামোদ করে, আমাদের ‘ইয়ে’ খাইয়ে খাইয়ে তরতাজা-জ্যান্ত রাখতেই হবে। ব্যাকটেরিয়া যেই পানি বের করে দিলো, সেটাকে আলাদা করে নিয়ে, আরো কয়েকবার পরিশোধিত করা হয়, -আল্ট্রা-ভায়োলেট লাইট, ক্লোরিন, কেমিক্যাল ইত্যাদি দিয়ে। এখন সেই পানি সরাসরি সমুদ্রে ফেলার জন্য উপযোগী। আসলে সেই পানি এতই বিশুদ্ধ ও পরিশোধিত যে, সেটা পান করারই উপযোগী। বিশ্বের অনেক দেশই এরকম পানিকে অনেক কাজে ব্যবহার করে – কৃষিকাজে, মিল-কারখানায় ইত্যাদি।

শেষ করি কমোডের ব্যাখ্যা দিয়ে। বাসাবাড়িতে যেই কমোড থাকে, সেগুলোতে পানি থাকে, যেটা S-pipe-এর ব্যবহার করে পানি দিয়ে smell-barrier হিসাবে কাজ করে। কিন্তু পানি সাশ্রয়ের জন্যে প্লেনে এবং এখন অনেক জাহাজেও, ভ্যাকুয়াম কমোড ব্যবহার করে। এতে প্রায় আটভাগের একভাগ মাত্র পানি লাগে ভ্যাকুয়ামই সবকিছু টান দিয়ে নিয়ে চলে যায়। যেই কমোডই হোক না কেনো, সেখানে অন্যকিছু ফেলেন না কখনই। Sewage Treatment System-এ যাওয়ার আগে, একধরনের ঘুরুন্ত-চাক্তির ব্লেডের মাধ্যমে solidwaste কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়ে থাকে। অনেকটা কিমা বানানোর ইলেক্ট্রিক্যাল মেশিনের মত চিন্তা করতে পারেন- একদিক দিয়ে টুকরা টুকরা ঢুকছে, অন্যদিক দিয়ে পেস্ট হয়ে বের হয়ে আসছে। refayet@yahoo.com টলিডো, ওহাইও, ২০২২

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধএক চিরতরুণের বিদায়