কারেন্ট জালে মরছে ডলফিন

এক সপ্তাহে ভেসে উঠলো তিনটি

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২২ জুলাই, ২০২২ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

এশিয়ার বৃহত্তম প্রাকৃতিম মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি ডলফিনের মৃত্যুর ঘটনা পরিবেশবাদীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। হালদা নদীতে গত বছর কয়েকের মধ্যে মোট ৩৮টি ডলফিনের মৃত্যু ঘটেছে। একের পর এক ডলফিন মৃত্যুর ঘটনা বিপন্ন প্রজাতির এই প্রাণীর অস্থিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। যা নদীর পরিবেশ এবং প্রতিবেশে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। পরিবেশবাদীরা ডলফিন রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

সূত্র বলেছে, ডলফিন পানিতে বসবাস করলেও এটি কোনো মাছ নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী। ডলফিন মানুষের মতোই ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, বাচ্চা জন্ম দেয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাচ্চাকে দুধ পান করায়। ডলফিনকে প্রতি ৩০ থেকে ১২০ সেকেন্ডের মধ্যে একবার শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির উপরে উঠে আসতে হয়।
হালদা নদীর উপর পিএইচডি ও এম.এসসি. (থিসিস) ডিগ্রি অর্জনকারী হালদা গবেষক, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে সাত প্রজাতির ডলফিন পাওয়া যায়। যার মধ্যে গাঙ্গেয় ডলফিন মিঠাপানির নদীর প্রধান ডলফিন। এগুলোকে স্থানীয়ভাবে শিশু, শুশ, হুস, হুচ্চুম, শুশুক প্রভৃতি নামেও ডাকা হয়। এই প্রজাতির ডলফিন বর্তমানে দেশে বিপন্ন প্রজাতির বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা এবং সাঙ্গু-কর্ণফুলী-হালদা ও অন্যান্য কিছু নদীতে ডলফিনের বিচরণ রয়েছে। ডলফিন চোখে না দেখার কারণে প্রতিধ্বনি তৈরির মাধ্যমে চলাচল করে। সারাবিশ্বে ডলফিন মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে কারেন্ট জাল। বিশ্বে যা ডলফিন মারা যায় তার অন্তত ৭০ শতাংশ মারা পড়ছে জালে প্যাঁচিয়ে। জালের সুতা শব্দ তরঙ্গ শোষণ করে বিধায় ডলফিন চলাচলের সময় জালের অবস্থান প্রতিধ্বনির মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারে না। এতে করে ডলফিন খুব সহজে জালে জড়িয়ে পড়ে।

হালদা নদীর প্রতিটি ডলফিনের মৃত্যুর পেছনে জালের ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করে স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, গত এক সপ্তাহে এই নদীতে তিনটি ডলফিন মারা পড়েছে। এর মধ্যে ১৪ জুলাই দক্ষিণ গহিরার বুড়ি সর্তা খালে একটি, ২০ জুলাই আজিমারঘাটে একটি এবং সর্বশেষ গতকাল ২১ জুলাই আজিমারঘাটে চলতি সপ্তাহের তৃতীয় ডলফিন মারা পড়ার ঘটনা ঘটে। গতকাল আজিমারঘাটে মৃত অবস্থায় যে ডলফিনটি পাওয়া গেছে সেটির গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। হালদা নদীতে ডলফিন মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত জাল। বিশেষ করে কারেন্ট জালে আটকা পড়ে একের পর এক ডলফিন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলেও ড. শফিকুল ইসলাম মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, জাল ছাড়াও খাদ্যের অভাব, দূষণ, পানির গুনাবলি পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডলফিন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

হালদা নদীকে গাঙ্গেয় ডলফিনের বাস উপযোগী করতে নদীতে অবৈধভাবে যেকোনো ধরনের জাল দিয়ে মাছ ধরা সম্পূর্ণরূপেই বন্ধ করতে হবে উল্লেখ করে ড. শফিক বলেন, নদীতে ইঞ্জিন চালিত নৌযানের অতিরিক্ত চলাচলও বন্ধ করতে হবে। হালদা নদী ও এর শাখা খালসমূহকে দূষণমুক্ত রাখার পাশাপাশি বিষ দিয়ে মাছ মারা ধরা বন্ধ করতে হবে। হালদা এবং এর শাখা খালগুলোতে প্রচুর পলি জমছে, যা পানি প্রবাহ ঠেকিয়ে ডলফিন বসবাসে সংকট সৃষ্টি করছে। এসব পলি দ্রুত অপসারণের উদ্যোগ নেয়ারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হালদা ও এর শাখা খালে পানির গুনাবলি পরীক্ষা করার উপর গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে যে, কমিউনিটি বেইজড ডলফিন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম গ্রহণ করলে সুফল মিলবে।

ডলফিন পরিবেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাণী বলে মন্তব্য করে ড. শফিক বলেন, এই প্রাণীর পরিবেশগত গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে স্থানীয় জেলে ও জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ডলফিন ডাটাবেজ তৈরি করে নিয়মিত ডলফিনের সংখ্যা ও আবাসস্থল মনিটরিং করার উপর গুরুত্বারোপ করে ড. শফিক বলেন, ডলফিন সংরক্ষণে আলাদা বিশেষজ্ঞ মনিটরিং টিম গঠন করে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২-(ডলফিন ও তিমি আইন)-৩৭ ধারা সঠিকভাবে প্রয়োগের উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

হালদার ডলফিন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো বলেছে, এই ডলফিন নিচিহ্ন হলে হালদার চরিত্রই বিপন্ন হয়ে যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসচেতন হতে হবে নদী পাড়ের মানুষদের
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ১২ বছরে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়