কারার ঐ লৌহ কপাট

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৮ আগস্ট, ২০২৪ at ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, সংগঠক, নাট্যকার, সুরকার। এছাড়াও নানা ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। সর্বোপরি তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতার কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি হিসেবেও আখ্যা দেয়া যায়। বাংলাসাহিত্যে তিনি ভোরের আকাশের তারার মতো, চিরন্তন ও ভাস্বর। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল। নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সামপ্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশিবিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ড দেয়। নজরুলও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করেন, ইংরেজ সরকারের জেলজুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং এর সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান। যে প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেছেন, সে আবেগেরই ভিন্নতর প্রকাশতাঁর গদ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের বিভিন্ন সমস্যা, যন্ত্রণা নজরুলকে প্রভাবিত করেছিল। সেজন্য তৎকালীন রাষ্ট্র, সমাজ, জীবন, আশাআকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও নৈরাজ্যের ছবি বিধৃত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের গণমানুষের কবি। তিনি আমাদের জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রূপকার। একই সাথে তিনি সর্বমানবের কবিকণ্ঠ। তাঁর কবিতাগান চিরমানুষের উজ্জীবন ও প্রাণের সুর। সাধারণ মানুষের সব আশাআকাঙ্ক্ষা, বেদনাবিক্ষোভকে তিনি নিজের জীবনে আত্মস্থ করেছেন, নিজের কণ্ঠে ধ্বনিত করেছেন। তা করতে গিয়ে তিনি প্রতিভাত হয়েছেন, একই সাথে বিদ্রোহী রূপে এবং প্রেমিক রূপে। শান্তিতে সংগ্রামে, প্রেম ও বিরহে, আনন্দ ও বেদনায়, চেতনার জাগরণে নজরুল প্রাতঃস্মরণীয়। সাম্রাজ্যবাদ, সামপ্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নিমন্ত্র বাঙালি জাতির চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণাআত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সংকল্প।

বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের পর সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থান সম্পন্ন করেছে ছাত্রসমাজ। তাদের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছিল নজরুলের সে বিখ্যাত গান -‘কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল, কররে লোপাট/ রক্তজমাট/শিকলপূজার পাষাণবেদী/ ওরে ও তরুণ ঈশান/ বাজা তোর প্রলয়বিষাণ/ ধ্বংসনিশান/ উড়ুক প্রাচীর, প্রাচীর ভেদি/ গাজনের বাজনা বাজা/ কে মালিক? কে সে রাজা/ কে দেয় সাজা/ মুক্তস্বাধীন সত্য কে রে/ হা হা হা পায় যে হাসি/ ভগবান পরবে ফাঁসি/ লাথি মার ভাঙরে তালা/ যত সব বন্দীশালায়/ আগুন জ্বালা/ আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি’।

জহির রায়হান তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’য় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির যথার্থ ব্যবহার করেছেন। ’৬৯এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে সিনেমাটি নির্মিত। মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিনোমাটি কলকাতার বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়। ‘জীবন থেকে নেয়া’ বাংলার শোষণবঞ্চনা থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধীনতা ছাড়া যে মুক্তি নেইসেটা তিনি সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন জহির রায়হান। প্রভাতফেরি, ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিবর্ষণ সবই চিত্রিত হয়েছে। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের এই গান বাঙালিদের উদ্দীপ্ত করেছে।

১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বাঙলার কথা’ নামে পত্রিকায় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি লেখেন। এই কবিতায় সুর দিলেন তিনি নিজেই। এই কবিতা লেখার মাত্র তিন বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯২৪ সালে এই কবিতাটি প্রকাশ হয় ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে। এই বইটি প্রকাশের অল্পদিন পরেই তা নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। বইটি আবার প্রকাশিত হয় স্বাধীন ভারতে। যখন কবি নজরুল বাকরুদ্ধ। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ প্রথম রেকর্ড করেছিলেন গিরিন চক্রবর্তী। পরে এই গানটি অনেকে একক বা সম্মিলিতভাবে গেয়েছেন।

এই গানটি সংযোজন করা হয়েছে বলিউডের ‘পিপ্পা’ ছবিতেও। তবে গানটির সুর বিকৃতি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশে ও বিদেশে। গানটিতে অস্কারজয়ী ভারতের সংগীত পরিচালক এ আর রহমান যে সুর সংযোজন করেছেন তা নিয়েই মূলত এই সমালোচনার ঝড়। এ আর রহমান বিশ্বখ্যাত নন্দিত একজন সুরকার। এই সুরকার নজরুলের গানের সুর বিকৃত করবেন তা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

নজরুলের গানকবিতা সবসময় রাজপথে উচ্চারিত হয়েছে। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম/ মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল/ মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়’। নজরুল ছিলেন সব নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। দুঃখ কষ্টে দিনযাপনকারী নজরুল সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে অসাম্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়ে গেছেন। একদিকে শাসকের রক্তচক্ষু অন্যদিকে শোষকের প্ররোচনার বিরুদ্ধে সারাজীবন তিনি কলম চালিয়ে গেছেন। কূপমণ্ডুক ভণ্ড প্রতারকরাও নজরুলকে একদণ্ড স্থির থাকতে দেয়নি। অনটন তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কিন্তু তাকে দমাতে পারেনি। নজরুল তাই শুধু একজন কবি নন। হয়ে উঠেছেন এক চেতনার নাম।

জীবনটা ছিল তাঁর খুবই বর্ণিল। তিনি মক্তবে শিক্ষকতা যেমন করেছেন ঠিক তেমনি হোটেল কর্মচারী, রুটির দোকানের ম্যানেজার এবং ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে হাবিলদার পদে পর্যন্ত উন্নীত হন। এসব জায়গায়ই তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। বালককালে লেটোর দলে যুক্ত হন। করাচি সেনানিবাসে চাকরিকালীন তিনি পাঞ্জাবি মৌলভির কাছে ফার্সি ভাষা শিক্ষার সুযোগ পান। সেখানে তিনি সৈনিক জীবনের পাশাপাশি গল্প কবিতা চর্চা করতে থাকেন। নজরুল সবসময় তরুণ ও প্রাসঙ্গিক।

নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। মানুষকে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে যুগে যুগে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রাবণ দিন
পরবর্তী নিবন্ধতামাকুমন্ডি লেইন বণিক সমিতির সভা