কারাবন্দি হুজি নেতা আবু সাঈদের পরামর্শে জামাতুল আনসার গঠন

শারক্বিয়ার শীর্ষ নেতা শামীনকে জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়ে কার্যক্রম চালানো নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিন্দাল শারক্বিয়া গঠন করা হয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) কারাবন্দি নেতা মাওলানা আবু সাঈদের পরামর্শে। জামাতুল আনসারের শীর্ষ নেতা শামীন মাহফুজ ধরা পড়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করে। সে আরও জানায়, কারাগারে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে হুজিবির শীর্ষ নেতা মাওলানা আবু সাঈদের পরিচয় হয়। তার পরামর্শেই পাহাড়ে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করেছিল সে।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) একজন কর্মকর্তা জানান, ‘হরকাতুল জিহাদ বা হুজিবি এখন কয়েকটি অংশে ভাগ হয়ে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। একটি অংশ এখন রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে। একটি অংশ নিজেরাই গোপনে নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর অন্য অংশটি আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। তাদের অনেকেই বিভিন্ন মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও পলাতক থেকে তৎপরতা চালাচ্ছে, অনেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে আছে।’

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপকমিশনার এস এম নাজমুল হক বলেন, ‘হুজি এখন সুপ্ত অবস্থায় আছে। ভেতরে ভেতরে দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের নিয়মিত নজরদারি করছি। আফগান ফেরত অনেক মুজাহিদ এখনও বিভিন্ন ছদ্মবেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। আমরা তাদেরও নজরদারি করছি।’

সিটিটিসি সূত্র জানায়, হুজিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগাযোগ বেশি। এছাড়া সংগঠনটি কয়েক বছর ধরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরেও ব্যাপক দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়েছে। এমনকি তাদের একটি গ্রুপ আরাকানেও তৎপর রয়েছে। এখনো এই জঙ্গি সংগঠনটির ২০৩০ হাজার প্রশিক্ষিত ক্যাডার বড় ধরনের নাশকতা এবং ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে প্রস্তুত রয়েছে।

সংগঠনটির দুই শীর্ষ নেতা আমীর মুফতি আবদুস সালাম ও সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রহমতুল্লাহ ওরফে শেখ ফরিদকে গ্রেপ্তার করা হলেও ভাটা পড়েনি তাদের কার্যক্রমে। গোপনে তারা তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেই যাচ্ছে। হরকাতুল জিহাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে মাঠের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কখনো তারা ইসলামি দাওয়াতি কাফেলা, কখনো ইসলামি গণআন্দোলন নামে গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে তারা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি) নামে চট্টগ্রাম বিভাগ, সিলেট বিভাগ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

প্রসঙ্গত, মাঝখানে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও কয়েক বছর ধরে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীবাংলাদেশ। সংক্ষেপে ডাকা হয় হুজিবি নামে। আরেক জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে মিলিত হয়ে নাশকতার চেষ্টা করছে হুজিবি। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল এই সংগঠনের সদস্যরা। এরপর শীর্ষ নেতাদের কারও কারও ফাঁসি হয়, অনেকেই হয় গ্রেপ্তার। তবে এখনও সংগঠনটি সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন জঙ্গি প্রতিরোধে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়ে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীবাংলাদেশ গঠন করেছিলেন যশোরের মাওলানা আব্দুর রহমান ফারুকী। ওই বছরই তিনি যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান। এরপর আফগানিস্তান ফেরত মুজাহিদদের নিয়ে ১৯৯২ সালে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে হুজিবি। সে সময় এর নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আব্দুস সালাম। প্রথম দিকে সংগঠনটি দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে সদস্য সংগ্রহ করে। নব্বই দশকের শেষের দিকে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে বাংলাদেশে বর্তমানে নিষিদ্ধ হওয়া এই জঙ্গি সংগঠন।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৯ সাল থেকে হুজিবি মূলত নাশকতা চালাতে থাকে। ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি হুজিবির সদস্যরা কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা করে। এরপর একই বছরে ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে, ৮ অক্টোবর খুলনার আহমদীয়া জামে মসজিদে, ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে হামলাসহ নেত্রকোনার একটি গির্জায় হামলা, ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে হামলাসহ একাধিক হামলা ঘটায়। তবে হরকাতুল জিহাদের সদস্যরা সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ চালায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। নারকীয় এই হামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহত হন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিএনপিজামায়াতের চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন পুরোটা সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে মদত পেয়েছে এই জঙ্গি সংগঠন। এমনকি একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালালেও হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করেনি তৎকালীন সরকার। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করে। ২০০৯ সালের পর থেকে সেই অভিযান আরও জোরদার করা হয়। এরপরই কোণঠাসা হয়ে পড়ে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীবাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা বিষয়ে শেখ হাসিনার প্রশংসা, প্রত্যাবাসনে গুরুত্ব
পরবর্তী নিবন্ধসিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত বিকৃত করার অভিযোগ