কারাগারের ছাদ ফুটো করে ৪ ফাঁসির আসামির পলায়ন, ১৫ মিনিটেই ধরা

বালতির হাতল দিয়ে এক মাস ধরে ছাদ ফুটো করেন তারা এদের একজন কাহালু পৌর মেয়রের ছেলে | বৃহস্পতিবার , ২৭ জুন, ২০২৪ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

বগুড়া জেলা কারাগার থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি ছাদ ফুটো করে পালিয়েছিলেন। পরে তাদের আবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, বুধবার ভোররাত ৩টা ৫৫ মিনিটে কারাগারের জাফলং ভবনের কনডেম সেলের চার আসামি কারাগার থেকে পালিয়ে গেলেও মাত্র ১৫ মিনিটের মাথায় পুলিশ তাদের আটক করতে সক্ষম হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি হলেনকুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানার আজিজুল হকের ছেলে মো. নজরুল ইসলাম মঞ্জুর (৬০), বগুড়া জেলার সদর থানার মো. ইসমাইল শেখের ছেলে মো. ফরিদ শেখ (২৮), কাহালু থানার মো. আব্দুল মান্নানের ছেলে মো. জাকারিয়া (৩১) ও নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার ইসরাফিল খার ছেলে আমির হামজা (৩৮)। খবর বিডিনিউজের।

পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার বলেন, বগুড়া জেলা কারাগারের কনডেম সেলের ছাদ ফুটো করে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত চার আসামি পালিয়ে গেছে বলে ভোর ৩টা ৫ মিনিটে তারা খবর পান। তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্বে থাকা সব পুলিশ সদস্যকে তাদের গ্রেপ্তারের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে ভোর আনুমানিক ৪টা ১০ মিনিটে সদর ফাঁড়ির এসআই খোরশেদ আলম শহরের কারাগারের পাশের এলাকা চেলোপাড়া চাষি বাজার থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে জেলা কারাগারের সুপার আনোয়ার হোসেন ও জেলার কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে জানিয়ে রাজশাহীর ডিআইজি (প্রিজন) কামাল হোসেন বলেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি।

বালতির হাতল দিয়ে এক মাস ধরে চলে ছাদ ফুটোর কাজ : প্রায় এক মাসের চেষ্টায় বালতির হাতল দিয়ে চুনসুরকির ছাদ ফুটো করে চার আসামি। এ ব্যাপারে জেলা পুলিশের প্রধান বলেন, আসামিরা অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছে। ভবনটি বেশ পুরানো। তারা প্রায় এক মাস ধরে এই পরিকল্পনা করেছে। তারা বালতির হাতল লোহা বা স্টিল নির্মিত সেটি সোজা করে ছাদের অংশ ফুটো করেছে। ধারাবাহিকভাবে তারা এটি করেছে। ভবনটিতে কোনো রড ছিল না। ইটসুরকির অনেক পুরনো ভবন। ফুটোটি তারা ধীরে ধীরে বড় করেছে। এ ছাড়া পুরনো চাদর, গামছা ও কাপড় পর্যায়ক্রমে বেঁধে ছাদ পর্যন্ত একটি রশির মতো তৈরি করে। একটি পাটাতন তৈরি করে। মূলত পাটাতনে পাড়া দিয়ে রশি বেয়ে ছাদের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর ছাদ নেমে প্রিজন সেলের সামনে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ আছে। সেটি লোহার খাঁচা দিয়ে বদ্ধ। সেই লোহার খাঁচার উপর দিয়ে ক্রলিং করে কারাগারের প্রাচীরের কাছে যায়। এবং একইভাবে কাপড় জোড়া দিয়ে রশি তৈরি করে প্রাচীর টপকে যায়। তারপর পাশের করতোয়া নদীর উপর যে ব্রিজ ছিল, সেটি দিয়ে পাশের চাষিবাজারে পৌঁছে যায় বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার। তিনি বলেন, তারা চারজনই সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজটি করেছে।

এই ভবনে পাশাপাশি চারটি ফাঁসির আসামিদের প্রকোষ্ঠ রয়েছে। এর একটিতে এই চারজন ছিলেন। প্রতিটি প্রকোষ্ঠ আলাদা। জেলা পুলিশ সুপার বলেন, আসামিরা ছাদের যে জায়গাটি ফুটো করার জন্য বেছে নিয়েছে সেটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। কারারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিতে তারা ওই কর্নারের অংশটি বেছে নিয়েছিল। ঘটনার পর পরই জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বগুড়া কারাগার ব্রিটিশ আমলে তৈরি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা গেছে ভবনের অনেক স্থান খারাপ।

আসামি জাকারিয়া কাহালুর মেয়রের ছেলে : বগুড়া জেলা কারাগারের ছাদ ফুটো করে পালানো ফাঁসির চার আসামির মধ্যে একজন মো. জাকারিয়া; তিনি কাহালু পৌর মেয়র আব্দুল মান্নানের ছেলে।

কাহালু থানার ওসি সেলিম রেজা বলেন, ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল কাহালুর রোস্তম চাপড় গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্কুলপড়ুয়া ছেলে নাঈমুল ইসলাম নাঈম (১৩) হত্যাকাণ্ডের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন জাকারিয়া। নাঈম হত্যা মামলার বরাতে পুলিশ জানায়, নাঈমকে আসামি জাকারিয়া ও তার সহযোগীরা মিলে অপহরণ করেন। পরে তার মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা হয় পরিবারের কাছে। টাকা না পেয়ে শিশুটিকে ইটভাটায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় মামলার পর ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি বগুড়ার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক হাফিজুর রহমান রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জাকারিয়া ও তার সহযোগী ডালিমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে জাকারিয়ার বাবা কাহালু পৌর সভার মেয়র ও উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল মান্নানের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

যেভাবে গ্রেপ্তার : আসামিদের গ্রেপ্তারে বগুড়া পুলিশের যে কটি দল কাজ শুরু করে তাদের একটি নেতৃত্বে ছিলেন এসআই খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, চার আসামি পালানোর পরই পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী স্যারের নির্দেশনা পেয়ে আমার ফোর্স নিয়ে আসামিদের খুঁজতে থাকি। সাধারণভাবে চিন্তা করে দেখলাম, পালিয়ে যাওয়া আসামিরা কখনও সদর সড়ক ব্যবহার করবে না। জেলখানা যেহেতু করতোয়া নদীর ধারে এবং এখন করতোয়া নদীও খনন হয়েছে। তাই নদীর দুই পাড় দিয়ে যাতায়াতের একটা সুযোগ হয়েছে। আসামিরা নদীর নিচু পাড় ব্যবহার করতে পারে। জেলখানা থেকে আমরা প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে ফতেহ আলী বাজারের পাশে করতোয়া নদীর ধারে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি চারজন এক সঙ্গে নদীর পাশ থেকে চেলোপাড়া চাষিবাজারে হেঁটে উঠছেন। তখনই আমার সন্দেহ হয়। কারণ, আমাদের জানানো হয়েছে চারজন পালিয়েছে। এরাও তো চারজন। তখন আমি ও টিমের অন্যরা দ্রুত সেখানে গিয়ে তাদের ঘিরে ফেলি। তাদেরকে নানা প্রশ্ন করি কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

এসআই বলেন, তখন তাদের দেহ তল্লাশি করে জেলখানার একটি কাগজ পাই। এতে আমরা নিশ্চিত হই এরাই সেই আসামি, যারা জেল থেকে পালিয়েছে। তখন বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই এবং তাদের সবাইকে থানায় নিয়ে আসি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিশোর গ্যাং লিডার ছাত্রলীগ নেতাসহ দুইজন কারাগারে
পরবর্তী নিবন্ধ৫১ কোটি টাকা লোপাট করেছেন ডাক বিভাগের কর্মীরা : পলক