আমরা গাজা আমরা কারবালা। আমরা ইমাম হুসাইনের উত্তরসূরি। নবী করিম (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-আশুরার দিনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইয়াজিদ সৈন্য বাহিনীর হাতে কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। এ মর্মান্তিক ঘটনাটি এতই লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক যে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান আজও তা ভুলতে পারেনি–পারবেও না। কিন্তু মাতম করলেই এ দিনের কর্তব্য শেষ হওয়ার নয় বরং আমাদের অন্যায়, জুলুম, অনাচার এবং পাপাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে এগিয়ে যেতে হবে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে। ইতিহাস কখনো নিছক অতীত নয়। সময়ের নিরবধি স্রোতে কিছুক্ষণ এমন আসে যা যুগজয়ী হয়ে ওঠে–ঘটনা নয় চেতনার আখ্যান হয়ে যায়। কারবালা তেমনই এক অধ্যায় আর গাজা সেই অধ্যায়ের চলমান পৃষ্ঠা। একদিকে সপ্তম শতকের মরুপথে রক্তস্নাত আত্মত্যাগ, অন্যদিকে আধুনিক যুগের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এক অবিরাম আত্মমর্যাদার লড়াই। সময়ের ব্যবধান যতই হোক অন্তরের ধ্বনি এক। ইমাম হুসাইন যখন বলেছিলেন অবিচারের কাছে মাথা নত করব না, তখন তা শুধু কুফার প্রান্তরের উচ্চারণ ছিল না তা ছিল এক ভবিষ্যদ্বাণী যা গাজার ধ্বংসস্তূপেও প্রতিধ্বনি তুলেছে। সবদিক থেকে ঘিরে রাখা বিমান, স্থল, সাগর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে ইসরায়েল। মানুষ কোথাও যেতে পারে না। কারবালায়ও ইমাম হোসেন (রা.)-এর তাঁবু ছিল চতুর্দিকে ঘেরা। পালাবার বা পানি আনার সুযোগও ছিল না। কারবালার প্রান্তরের সেই আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস আজকের গাজার বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। গাজার নিরীহ বাসিন্দারা কারবালার মতোই ইসরায়েলের আগ্রাসনে কঠোর নির্যাতন ও যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন। কারবালা থেকে গাজা একই বেদনা, নৃশংসতা আর একই সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
কারবালা ইতিহাসের বুকে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা : ৬১ হিজরি ১০ মহররম ইরাকের কারবালা। উমাইয়া খেলাফতের শাসক ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য স্বীকারে অস্বীকৃতি জানান নবীজির দৌহিত্র ইমাম হুসাইন। অন্যায়ের হাতে ইসলামকে সমর্পণ না করে পরিবারসহ রওনা হন কুফার উদ্দেশে। পথেই তাকে অবরুদ্ধ করে ইয়াজিদের বাহিনী। অত:পর নীরব মরুভূমিতে রক্তে লেখা হয় ইতিহাস ৭২ জন শহীদের আত্মত্যাগ রচনা করে সত্য ও অন্যায়ের সংঘর্ষের চিরন্তন প্রতীক। এই সংঘর্ষ কেবল রাজনৈতিক নয় বরং নৈতিক, আদর্শিক ও ধর্মীয় চেতনার এক অমোঘ কণ্ঠস্বর। হুসাইন তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেন সংখ্যার বিজয় নয়–মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠাই চূড়ান্ত সফলতা।
গাজা সমকালীন বিশ্বে এক নিরব কারবালা: প্রায় চৌদ্দশ বছর পর ভূমধ্যসাগরের উপকূলে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলছে অন্য এক কারবালা। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি শুরু হয়। এরপর ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে গাজা পশ্চিম তীরসহ বৃহৎ এলাকা দখল করে নেয় ইহুদি রাষ্ট্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাজার জনপদ পরিণত হয় এক খোলা কারাগারে–বাইরের দিকে অবরুদ্ধ ভেতরে ধ্বংসের আতঙ্ক। বছরের পর বছর ধরে চলা দখল অবরোধ এবং অস্ত্রসজ্জিত আগ্রাসনের মাঝেও গাজার মানুষ মাথা নত করেনি। শহীদ আহত নি:স্ব–তবুও অবিচল। এই গাজাই আজ মানবতা ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এখানে প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ প্রতিটি রক্তাক্ত শিশুর মুখ যেন পুনর্জাগরিত করে কারবালার প্রতিচ্ছবি। কারবালার আরেকটি চিরন্তন দিক হলো শোক। দেখা যায় ফিলিস্তিনে শিশুরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে, রক্তে ভেজা বাবা–মায়ের নিথর দেহ আঁকড়ে ধরে। তারা বোঝে না কেন তাদের পরিবার হারিয়ে যায় কেন তাদের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই শিশুরা যেন কারবালার সেই এতিম শিশুদের প্রতিচ্ছবি যারা বাবা–মা হারিয়ে নি:সঙ্গ হয়েছিল।
মুসলিম উম্মাহর প্রতিক্রিয়া ও নিষ্ক্রিয়তা : ইয়াজিদি চেতনার পুনর্জাগরণ–কারবালার সময় কুফার মানুষ প্রতিশ্রুতি দিয়েও পাশে দাঁড়ায়নি। একইভাবে আজ ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো দ্বিধাগ্রস্ত। কেউ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে, কেউ কৌশলী নীরবতা অবলম্বন করে। এই নীরবতা কি তবে ইয়াজিদি চেতনার আধুনিক রূপ নয়? গাজার জন্য জেগে উঠে একদল মানুষ–তরুণ, শিশু, মা। তাদের হাতে নেই পরমাণু অস্ত্র, নেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আসন। কিন্তু আছে অন্তর জাগরিত ঈমান, আছে শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। যারা জীবনের পরিবর্তে শহীদি মর্যাদা চায় তাদের দমন করা যায় না।
গাজায় প্রতিরোধের ভাষা কলম, ক্যামেরা ও কোরবানি : গাজার মানুষ যুদ্ধ করে শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়। তারা লড়ে সাংবাদিকতায়, কবিতায়, চিত্রকর্মে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, এমনকি এক টুকরো রুটি আর একটি গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে। শিশুদের স্কুলভবন ধ্বংস হয় তারা খোলা আকাশের নিচে ক্লাস নেয়। কন্যাশিশু রাহাফ বা হানাদি যখন নিজের ভাইয়ের শহীদ হওয়ার ভিডিও ধরে কাঁদে না–তখন তা এক নতুন প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়ায়। কারবালায় জয়নাব ছিলেন হুসাইনের বোন কিন্তু প্রতিরোধের ভাষ্যকারও। গাজার প্রতিটি মেয়ে প্রতিটি মা যেন সেই জয়নাবের আত্মাধারণ করে আছেন। তারা কাঁদেন না প্রতিজ্ঞা করেন আমার সন্তান শহীদ হয়েছে, আমি আরও সন্তান জন্ম দেব এই পথেই।
সত্য ও মিথ্যার সংঘর্ষ ইতিহাসের চিরন্তন সূত্র : ইতিহাসের যে সূত্র বারবার সত্য হয়ে ধরা দেয়–তা হলো অত্যাচার দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ফেরাউন ডুবেছে, নমরূদ নি:শেষ হয়েছে, ইয়াজিদের নাম ইতিহাস ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করে। কিন্তু হুসাইন, মূসা, ইব্রাহিম–এই নামগুলো যুগ যুগ ধরে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। গাজা হেরে যাবে—এই কথা বলে যারা ঘুমায় তারা জানে না আত্মমর্যাদা কখনো হারে না। প্রতিরোধী জাতি কখনো পরাজিত হয় না, তাদের বিজয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। তারা ইতিহাসের গর্ভে বপন করে সেই বীজ যা একদিন নতুন সূর্য হয়ে উদিত হয়। কারবালা আমাদের শিখিয়েছে–রাজনীতি যদি নৈতিকতাবিহীন হয় তা শয়তানের সেবক হয়ে ওঠে। ইয়াজিদের রাজনীতি ছিল ইসলামকে ঢাল বানিয়ে স্বৈরশাসন কায়েম করার। গাজার ক্ষেত্রেও দেখা যায় আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে মানবাধিকারের মুখোশ পরে গণহত্যার অনুমোদন দেয়। পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত সভ্যতা গাজার কান্না দেখে না কিন্তু একটি ক্ষুদ্র হামলায় নিন্দার ঝড় তোলে। এই দ্বৈতনীতি আজকের ইয়াজিদি মুখোশ। ইমাম হোসেন (রা.)এর পক্ষের মানুষদের ভয় দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে সমর্থন থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। আজও ইসরায়েল এবং পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বললে লোকজনকে চাকরি হারাতে হয় সন্ত্রাসী তকমা দেওয়া হয় চরিত্র হনন করা হয়।
কারবালা থেকে গাজা : সত্যের পক্ষে যারা দাঁড়ায় তাদের পরাজয় বলে কিছু নেই। সময়ের পরতে পরতে সেই সত্যই বিজয়ী হয়। আর ইতিহাস বারবার বলে দেয় কে প্রকৃত বিজয়ী আর কে আসলে চিরন্তন পরাজিত। মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন আমি হুসাইন (রা.)এর কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে নির্যাতিত হয়েও বিজয়ী হতে হয় কীভাবে পরাজিত হয়েও জয় ছিনিয়ে নিতে হয়। এই লেখা কোনো উপসংহার চায় না কারণ গাজার কান্না থামেনি কারবালার রক্ত শুকায়নি। এ এক চলমান ইতিহাস যার প্রতিটি শব্দ জেগে ওঠে নতুন করে। আমরা গাজা আমরা কারবালা। আমরা হুসাইনের উত্তরসূরি। গাজায় যে গণহত্যা চলছে তা মানবতার ইতিহাসে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন। রোজা লুক্সেমবার্গের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করা যাক–আমাদের উচিত সাহসের সঙ্গে সত্য বলার মাধ্যমেই পরিবর্তনের অগ্রদূত হয়ে ওঠা। কারবালা কেবল একটি ধর্মীয় ঘটনা নয় এটি বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের জন্য এক শক্তিশালী বিপ্লবের অনুপ্রেরণা।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।