কাপ্তাই হ্রদে কমছে পানি, বাড়ছে ভোগান্তি

জরুরি ভিত্তিতে পলি অপসারণের দাবি

রাঙামাটি প্রতিনিধি | শনিবার , ১৬ মার্চ, ২০২৪ at ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটি। পাহাড়ি এই জেলার দশ উপজেলার তিনটিই সম্পূর্ণ হ্রদবেষ্ঠিত আর ছয়টি উপজেলার সঙ্গে রয়েছে নৌপথ। জেলা শহর থেকে উপজেলাসমূহে কৃষি পণ্য, মালামাল পরিবহন এবং যাত্রী পরিবহনে ভূমিকা রেখে আসছে কাপ্তাই হ্রদ। জেলার ছয়টি উপজেলার সঙ্গে প্রতিদিন নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা (বোট) যাতায়াত করে। তবে শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গেলে জেগে ওঠে ডুবোচর। একই সময়ে নৌপথে পলি জমার কারণে ব্যাহত হয় নৌযান চলাচল। ফলে শুষ্ক মৌসুমে লঞ্চ চলাচলে সীমাহীন দুর্ভোগ, যাত্রী ও কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণে ভোগান্তি বাড়ে। এদিকে, কাপ্তাই হ্রদে নৌপথে দীর্ঘদিন ধরেই খননের (ড্রেজিং) দাবি জানিয়ে আসলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।

লঞ্চ মালিকরা বলছেন, নৌপথে লঞ্চ ও অন্যান্য নৌযান চলাচল অব্যাহত রাখতে শিগগিরই কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে মারিশ্যা (বাঘাইছড়ি) রুটে লংগদু উপজেলার পর মাইনিমুখ বাজারের পর লঞ্চ যেতে পারছে না। জেলা সদর থেকে প্রায় ৭৮ ঘণ্টার নৌপথের ৩৪ ঘণ্টার বেশি নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবে লংগদু থেকে মারিশ্যাবাজার পর্যন্ত এই নৌপথের দূরত্ব প্রায় ৪৬ কিলোমিটার।

নৌপথের যাত্রীরা জানান, রাঙামাটির লংগদু, বাঘাইছড়ি উপজেলার মানুষ নৌপথ এড়িয়ে বিকল্প পথ হিসেবে জেলা শহরে আসতে চাইলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা হয়ে আসতে হয়। অন্যদিকে সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল হওয়ায় নানিয়ারচরের মানুষ সড়ক পথে যাতায়াত করলেও কৃষি পণ্যসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহন করা হয় বেশিরভাগ নৌপথেই। জেলার জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলার বাসিন্দাদের নৌপথ ছাড়া বিকল্প পথ না থাকায় তাদের এই ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ার কারণে ওইসব এলাকার মানুষকে পানির সংকটে পড়তে হয়। কাপ্তাই হ্রদের পানির লেভেল নিচে নেমে যাওয়ায় পানি তুলতে হয় অনেক নিচ থেকে। এ সময়টাতে বিপাকে পড়েন প্রান্তিক এলাকার মানুষ।

হ্রদের পানি কমে যাওয়ার কারণে যাত্রী পরিবহন ছাড়া সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন পাহাড়ের প্রান্তিক কৃষকরা। তারা বলছেন, পাহাড়ে উৎপাদিত কৃষি পণ্য নৌপথে জেলা শহরে আনেন তারা। কিন্তু হ্র্রদের পানি কমে যাওয়ার ফলে ভোগান্তি বাড়ছে। হ্রদে পর্যাপ্ত পানি থাকার সময়ে নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত বোট যাতায়াত করতে পারলেও এখন অনেক নিচেই বোট রেখে কৃষি পণ্য বহন করে এনে বোটে তুলতে হয়। হ্রদের পানি কমার ফলে ঘুরপথে বোট চলাচলের কারণে বেড়েছে যাতায়াতের সময়ও।

বিমল চাকমা নামের বরকল উপজেলার এক কৃষক জানান, এখন তো কাপ্তাই হ্রদের পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। দীর্ঘসময় ভার বহন করে এনে বোটে তুলতে হয়। আগে তো বোট একেবারে কাছাকাছি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানি কমতে থাকায় তা আর এখন পারা যাচ্ছে না। আমাদের বসতবাড়িতে গৃসস্থালী কাজে ব্যবহারযোগ্য পানি সরবরাহে দুর্ভোগ বেড়েছে। ব্যবহারের পানি অনেক নিচু থেকে কলসি বা ড্রাম দিয়ে উপরে ওঠাতে হয়।

এদিকে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থা রাঙামাটি জোনের চেয়ারম্যান মো. মঈনুদ্দিন সেলিম জানান, শুষ্ক মৌসুম এলে কাপ্তাই হ্রদে নৌযান চলাচল ব্যাহত হয়। এটি দীর্ঘদিন ধরেই লঞ্চ কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠেছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই নৌপথে ড্রেজিংয়ের (খনন) দাবি জানিয়ে আসলেও কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। হ্রদের নৌপথে পলি জমতে জমতে এটি এখন আরও প্রকট হচ্ছে। রাঙামাটির সবচেয়ে বড় বা দীর্ঘ নৌরুট রাঙামাটিমারিশ্যা নৌপথে লঞ্চ চলাচল অলরেডি বন্ধ হয়ে গেছে। লংগদুর মাইনীমুখ বাজারের পর আর এই রুটে লঞ্চ নিয়ে এগুনো যাচ্ছে না। সপ্তাহখানেক পর থেকে লংগদুর মাইনীবাজার পর্যন্তও যাওয়া সম্ভব হবে না।

তিনি আরও বলেন, বরকল উপজেলার সদরেও লঞ্চ নিয়ে যাওয়া যায় না, সদরের আগে বাঙালটিলা পর্যন্ত লঞ্চ যাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য উপজেলারগুলোতেও একই চিত্র। কিছুদিন পর যখন হ্রদের পানি আরও কমতে শুরু করবে তখন এই সংকট আরও প্রকট হবে। নানিয়ারচর আর বিলাইছড়ি ছাড়া বাকী বরকল, জুরাছড়ি, লংগদু, বাঘাইছড়ির লঞ্চ চলাচল করে থাকে সুবলং নৌপথ দিয়েই। বর্তমানে এই নৌপথে অন্যান্য বছরের থেকে বেশি পলি জমে আছে। আমরা ধারণা করছি কিছুদিন পর লঞ্চ চলাচল করা হয়ে যেতে পারে। হ্রদে জরুরি ভিত্তিতে খননের উদ্যোগ নেয়া না হলে ভোগান্তি বাড়বে। আমরা জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে জানিয়েছি। সংবাদ সম্মেলনও করেছি। এখনো কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না।

কাপ্তাই হ্রদের পানি পরিমাপ করে থাকে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে পানি রয়েছে ৮১ দশমিক ৮৯ মিন সি লেভেল (এমএসএল)। তবে মিটার স্কেল অনুযায়ী হ্রদে স্বাভাবিক পানির পরিমাণ থাকার কথা ছিল ৯০ দশমিক ৭৬ এমএসএল। কন্ট্রোল রুমের হিসাবে প্রায় ৯ এমএসএল পানি কম রয়েছে ৭২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কাপ্তাই হ্রদে।

জানতে চাইলে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এবং কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, কাপ্তাই হ্রদে নাব্যতা সংকটের কারণে নৌপথের যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল ব্যাহত ও দুর্ভোগের বিষয়টি জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও আমি উত্থাপন করেছি। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলীকেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বিশেষ করে যেখানেযেখানে লঞ্চ চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে, সেইসব স্থানে খননের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।

আশার কথা জানালেও সহসাই দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণের উপায় জানাতে পারেননি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা। নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, কাপ্তাই হ্রদে নৌ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নৌপথে খননের পরিকল্পনা রয়েছে পাউবোর। আমরা অলরেডি একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আশাকরি আগামী অর্থবছরে একনেক সভায় প্রকল্পটি পাস হবে। প্রকল্পটি পাস হলে ওই প্রকল্পের অধীনে জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি, লংগদু নৌরুটসহ অন্যান্য নৌপথে ৬৫ কিলোমিটার খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এরমধ্যে লংগদুর মাইনিমুখ বাজার থেকে বাঘাইছড়ির মারিশ্যা বাজার পর্যন্ত ৪৬ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে।

জরুরি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিনাজানতে চাইলে তয়ন ত্রিপুরা বলেন, সমতল জেলাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে কিছু উদ্যোগ নেয়া গেলেও রাঙামাটি পার্বত্য জেলার ক্ষেত্রে বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে চাইলে ড্রেজিং মেশিন নামানো যায় না। দীর্ঘমেয়াদি কাজ হলে তখন ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্ঘটনার শিকার চবির ভর্তি পরীক্ষার শিক্ষক
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় বোরো আবাদ বেড়েছে ১২শ হেক্টর