বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঁশ ও কাঠের জন্য বিখ্যাত। এখানে বিভিন্ন রকমের মূল্যবান কাঠ এবং বাঁশ উৎপাদিত হয়। তবে কাপ্তাই জেটিঘাট দিয়ে প্রতি সপ্তাহে কোটি টাকার বাঁশ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। আগে কর্ণফুলী নদী পথে বিশাল বাঁশের চালি বেঁধে চট্টগ্রামে বাঁশ পরিবহন করা হতো। বর্তমানে ট্রাকে করে বাঁশ সরবরাহ করা হয়। কাপ্তাই জেটিঘাট বাঁশের বাজার হিসেবে বিখ্যাত। এখান থেকে বাঁশ নেওয়ার জন্য অনেক ব্যবসায়ী ট্রাক নিয়ে আসেন। বাঁশ পরিবহনের জন্য কাপ্তাই জেটিঘাটে শতাধিক ট্রাক সার্বক্ষণিক দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁশ পরিবহনকে কেন্দ্র করে জেটিঘাটে ট্রাক মালিক সমিতি, ট্রাক শ্রমিক সমিতি নামক বিভিন্ন সংগঠনও গড়ে উঠেছে। এছাড়া ট্রাকে বাঁশ উঠানোর জন্য বিপুল সংখ্যক শ্রমিক জেটিঘাটে রয়েছেন। তারা জেটিঘাটের পানি থেকে বাঁশ তুলে ট্রাকে লোড দেওয়ার কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বাঁশ ব্যবসায়ী আমির হোসেন জানান, রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলার বনাঞ্চলে বাঁশ উৎপন্ন হচ্ছে। বিশেষ করে বিলাইছড়ি, বরকল, নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, রাঙামাটি সদর এবং কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রায় ৫ লক্ষ একর জমিতে বাঁশ উৎপন্ন হচ্ছে। বাঁশ সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। পরিপূর্ণ একটি বাঁশ কাটলে সেখান থেকে আরো কয়েকটি বাঁশের কড়ুল (চারা) জন্ম হয়। পাহাড়ি এলাকায় এভাবে বাঁশের বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে পাহাড়ে জনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাহাড় কেটে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঘরবাড়ি তৈরি করছেন। অনেকে পাহাড়ে আগুন দিয়ে জঙ্গল পুড়িয়ে জুম চাষ করছেন। এসব কারণে বাঁশের প্রাকৃতিক উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়াও পাহাড়ে বসবাসকারী শত শত দরিদ্র নারীরা পাহাড় থেকে বাঁশের কড়ুল (বাঁশের চারা) কেটে এনে বাজারে বিক্রি করছেন। অনেকে বাঁশ কড়ুল সবজি হিসেবে খেয়ে থাকেন। কড়ুল কেটে ফেলায় বাঁশ উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। তারপরও এখনো হাজার হাজার একর জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই বাঁশ উৎপন্ন হচ্ছে। আবার অনেকে নিজেদের পাহাড়ে বাঁশ চাষ করছেন।
বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা লালিয়ান চাকমা বলেন, পাহাড়ে কয়েক প্রকারের বাঁশ উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে মুলি, ওরা, মিতিঙ্গা, ডুলু, বাইজ্জা ইত্যাদি। একসময় কর্ণফুলী পেপার মিল পার্বত্য এলাকার সব বাঁশ কিনে নিয়ে যেত। তখন কেপিএমের বাইরে একটি বাঁশও বিক্রি করার সুযোগ ছিল না। রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা ছিল কেপিএম যদি বাঁশ না নেয় তখন সেই বাঁশ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো যাবে। কিন্তু কর্ণফুলী পেপার মিল ২০১৮ সাল থেকে বাঁশ সংগ্রহ বন্ধ রেখেছে। কেপিএম এখন একটি বাঁশও কিনছে না। যে কারণে বাঁশের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। আর চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় উৎপাদনও কমে গেছে।
ব্যবসায়ী তোফাজ্জল মিয়া বলেন, আগে গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে পাকা ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের সময় ঠেশ হিসেবে বাঁশ ব্যবহার হতো। তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাঁশের চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন বাঁশের পরিবর্তে আধুনিক উপায়ে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করা হচ্ছে। যে কারণে নির্মাণ শিল্পে বাঁশ ব্যবহার কম হচ্ছে। আগে গ্রামগঞ্জের বাঁশের বেড়া দিয়ে টিনের ঘর তৈরি করা হতো। এখন মানুষ পাকা ঘরবাড়ি তৈরি করছে। এই কারণেও বাঁশের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও পূর্বে বাঁশের ঝুড়ি, টুকরিসহ দৈনন্দিন গৃহস্থালী ব্যবহার্য বিভিন্ন তৈজষপত্র বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হতো। এসব জিনিসপত্র বাজারেও ভালো দামে বিক্রি হতো। বর্তমানে প্ল্লাস্টিকের সামগ্রী এসে ওইসব বাঁশের সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে।
বাঁশের ব্যবহার বহুলাংশে সঙ্কুচিত হলেও এখনো বিভিন্ন প্রয়োজনে বাঁশের বিপুল চাহিদা রয়েছে। আর সেই চাহিদার কারণে বাঁশের দামও বেশ চড়া। ৪০ টাকার নিচে বাজারে কোনো বাঁশ পাওয়া যায় না। এছাড়াও একটি বাঁশ প্রকার ভেদে ৩শ থেকে ৪শ টাকাও বিক্রি হচ্ছে।
কাপ্তাই ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৫০টি ট্রাক ভর্তি বাঁশ কাপ্তাই জেটিঘাট থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ঢাকা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হচ্ছে। বর্তমানে বাঁশের সবচেয়ে বড় চাহিদা রয়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি বেশিরভাগই বাঁশের তৈরি।
চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত এশিয়া বিখ্যাত কর্ণফুলী পেপার মিল বাঁশ ও গাছকে কেন্দ্র করেই ১৯৫২ সালে গড়ে উঠেছিল। এখন কেন কর্ণফুলী পেপার মিল বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করছে না জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, কর্ণফুলী পেপার মিলের বয়স ৭৫ বছর পেরিয়ে গেছে। বয়সের কারণে এবং বাস্তবতার নিরিখে কেপিএমের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে। তাই আপাতত বাঁশ কাঠ ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে পাল্প ব্যবহার করে কেপিএমে কাগজ উৎপন্ন করা হচ্ছে।
এদিকে চন্দ্রঘোনায় বড় আকারের নতুন একটি পেপার মিল বসানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। নতুন পেপার মিল প্রতিষ্ঠিত হলে প্রায় এক লক্ষ টন কাগজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মিলের যাত্রা শুরু হবে। তখন কেপিএমে পুনরায় বাঁশ এবং গাছের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। আর সেই প্রক্রিয়া শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশ উৎপাদন আবারও বাড়বে।