বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র বাসযোগ্য ‘পৃথিবী’ নামের গ্রহটাকে আমরা নানান নামে ডাকি। ধরণী, ধরিত্রী, বসুমতি, বসুধা, বসুন্ধরা… যখন যে নামেই ডাকি না কেন, প্রতিটি শব্দই স্ত্রী বাচক। শুধু স্ত্রী বাচকই নয়, প্রতিটি শব্দ মায়ের রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। একই কথা সত্য ‘প্রকৃতি’ শব্দটির বেলায়। কেবল বাংলা ভাষায় এভাবে শব্দায়ন হয়েছে, তা কিন্তু নয়; ইংরেজিতেও তাই। ‘মাদার আর্থ’, ‘মাদার নেচার’ নামে বহুল ব্যবহৃত শব্দযুগল পৃথিবী ও প্রকৃতির মাতৃরূপের সাক্ষ্য দেয়। অন্যান্য ভাষাভাষীরাও পৃথিবী ও প্রকৃতিকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে। করবে নাই বা কেন! মায়ের মতো করেই পৃথিবী তার সন্তানদের লালন পালন করে, আগলে রাখে। বায়ু, পানি, বৃক্ষরাজির মাধ্যমে তার সন্তানেরা শ্বাস নেয়, খাদ্য গ্রহণ করেন, দিনে দিনে বেড়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে। কিন্তু পৃথিবী মায়ের সন্তান হিসেবে আমরা সকলেই কি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছি ? মায়ের প্রতি দায় দায়িত্বই বা আমরা কতটুকু পালন করছি? আমরা কি মায়ের যত্ন নিচ্ছি? না কি মায়ের রূপ, রঙ, রস নিংড়ে মাকে মুমূর্ষু বানিয়ে নিজেদের লালসা চরিতার্থ করছি?
পৃথিবীর বয়স সাড়ে চার মিলিয়ন বছর, মানব বসতির বয়স দুই লক্ষ বছর। সভ্যতার বয়স মাত্র ছয় হাজার বছর। আর শিল্পায়নের হাত ধরে আধুনিকতার যাত্রা শুরু ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে, দুশো বছর পার হলো মাত্র। এতো স্বল্প সময়ে এতো অর্জন মানব জাতির! মাত্র দুই শতাব্দীতে চার বিলিয়ন বছরের বেশী বয়সী পৃথিবীর খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে মানুষ। কিন্তু তাই বলে যে পৃথিবীর আলো হাওয়ায় দু’লক্ষ বছরের পথ পরিক্রমা, সেই পৃথিবীর আলো হাওয়া থামিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র আধিকার মানব জাতিকে দেওয়া হয়নি। মানুষ ছাড়া এই পৃথিবীতে লক্ষ কোটি প্রজাতির প্রাণী আছে। তারা তো পৃথিবীর চুল পরিমাণ ক্ষতিও করে না। জীবন ধারণের জন্য, বিশেষত প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তারা প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করে। আর আমরা মানবকুল প্রকৃতিকে হরণ করে করে নিঃশেষ করে দিতে উদ্যত। অথচ কি আশ্চর্য! আমরা প্রকৃতিকে জয় করে সভ্যতা বিনির্মাণ করছি বলে দম্ভ প্রকাশ করে চলেছি শত শত বছর ধরে।
প্রকৃতিকে হরণ করার মহোৎসবের পরিণতি বা ফলাফল হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, যা একুশ শতকের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কখনও তীব্র দাবদাহ, খরা, অজন্মা, কখনও অতি বৃষ্টি, বন্যা, নদী ভাঙন, আবার কখনওবা অতি মাত্রায় ঠাণ্ডা, শৈত্যপ্রবাহ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। দেশে দেশে উঁচু নিচু সকল স্তরের মানুষকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটা দুর্বিপাকের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে আর্থ–সামাজিক মইয়ের ওপরের দিকে যাদের অবস্থান তাদের হাতে তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিকূলতা এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে। বলাবাহুল্য নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের জন্য ঘরে বাইরে যত যন্ত্রপাতি তারা ব্যবহার করেন, তার সবগুলোই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। তাই ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ কে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলার সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির দীর্ঘদিনের লালসার ফল জলবায়ু পরিবর্তন। অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে একের পর এক যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে মানব সভ্যতা একদিকে রাতারাতি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যায়, অন্যদিকে বিস্তার লাভ করে বৈষম্য, দূষণ আর অপরাধপ্রবণতার। ভোগবাদ হয়ে ওঠে মানুষের চরম ও পরম মোক্ষ। তার জন্য দুর্বৃত্তপনায় নামতেও বাঁধে না অনেকের। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি ও আপন লালসা চরিতার্থ করার জন্য পরিবেশ, প্রতিবেশের ক্ষতি সাধন করতে কুণ্ঠিত হয়না তারা। তাইতো বন, পাহাড় উজাড় করে একের পর এক স্থাপনা নির্মিত হয় দেশে দেশে। উন্নত দেশগুলোতে আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা সীমিত বলে প্রকৃতির ওপর ছুরি কাঁচি চালানোর বিরূপ প্রভাব তাদের ওপর ততোটা অনুধাবন করা না গেলেও, আমাদের মতো দরিদ্র দেশে জন ঘনত্ব অনেক বেশী বলে আমাদেরকেই যত নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করতে হয়।
তাই বলে আমরা কি কেবল পরিণতিই ভোগ করছি? প্রকৃতি ধ্বংসের বীভৎস আয়োজনে আমরাও কি সমানভাবে পাপী নই? আমাদের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশের শিরায় শিরায় বয়ে যাওয়া শতশত নদী মরে গিয়েছে, অনেক মৃতপ্রায়। নদীর স্বাভাবিক ধর্মই বয়ে চলা। বাঁধ দিয়ে নদীর পথ চলা থামিয়ে দিলে কিংবা আমাদেরই অর্থগৃধ্নুতার জন্য নদী শুকিয়ে গেলে বা মরে গেলে তার প্রভাব পুরো সমাজ ও জাতির ওপর পড়ে, আর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় মারাত্মকভাবে। শুধু কি নদী? খাল–বিল–ডোবা, পুকুর, দীঘি সহ সকল জলাশয়কে আমরা নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যত। পাহাড় পর্বত, বনভূমি, বৃক্ষরাজি সবকিছুই আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা মেতে উঠেছি ধ্বংসলীলায়। বাংলাদেশের অক্সিজেনের আধার সুন্দরবনে দুই দশকে পঁচিশবার আগুন লাগা নিছক দুর্ঘটনা নয়। ‘সবুজ বনের বুকে দগদগে ক্ষতের’ দিকে চেয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন আমুরবুনিয়া গ্রামের সত্তরোর্ধ বাশার হাওলাদার গভীর বেদনায় বলে ওঠেন– ‘জঙ্গল আমাগো মায়ের মতোন, আমাগো বাঁচায়। জঙ্গল না থাকলি হবে? এক ঝড়েই তো সব উড়ায় নিয়া যাবে’ (প্রথম আলো অনলাইন ১২ মে, ২০২৪)। কেবল পৃথিবী আর প্রকৃতিতো নয়, নদী, বন, মাটি, পাহাড়– সকলেই মায়ের মমতায় আগলে রাখে আমাদের। আমরা বুঝেও বুঝিনা।
আমরা যারা এই মুহূর্তে তুলনামূলকভাবে একটা সম্মানজনক ও আরামদায়ক বিত্তের মাঝে জীবনধারণ করছি, তারা যদি মনে করি যে আমি ও আমার পরিবার বেঁচে গেলাম, এই দুর্যোগ আমাদের স্পর্শ করবে না, ক্ষতি যা হওয়ার নদী তীরবর্তী বা বনভূমির কাছের প্রান্তিক মানুষদের হবে, তবে আমরা নিতান্তই এক ভুলের স্বর্গে বাস করছি। আজ না হয় কাল– নদী হত্যা, পাহাড় নিধন, বনভূমি ধ্বংসের ফল আমাকে আপনাকে ভোগ করতেই হবে। আমার আপনার সন্তান ও তাদের উত্তরাধিকারীরা বাস্তুচ্যুতও হতে পারে। সেই দুর্দিন আমাদের চোখে দেখতে না–ও হতে পারে। তবে তারা আমাদের অভিসম্পাত দেবে– এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। আমার সন্তানের জন্য রাশি রাশি সম্পদ বানাতে গিয়ে যদি অন্যের সন্তানের ভাগ কেড়ে নেই, অন্যের জীবন থেকে স্বস্তি কেড়ে নিই, তবে তার মাশুল আমাকে দিতেই হবে।
আমাদের মন রাখতে হবে পৃথিবী কিন্তু একটাই। মানবজাতির বসবাসের উপযোগী এই একটিমাত্র গ্রহ আছে সৌরজগতে। মানব দেহের একটি অঙ্গে পচন ধরলে যেমন করে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, পৃথিবীর এক কোনের সংকটও ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বময়। একে একে সকলেই আক্রান্ত হবে বৈশ্বিক উষ্ণতার জালে, ফেটে চৌচির হয়ে যাবে সকল আনন্দ সরবোর। কোভিড–১৯ এসেছিল বৈশ্বিক মহামারী হয়ে আমাদের শিক্ষা দিতে, সচেতন করতে। আমরা শিক্ষা গ্রহণ করিনি, সচেতন হইনি, নিজেদের বদলাইনি। এখনও যে যার আপন সুখের বলয়ে আবদ্ধ থেকে পরিতৃপ্তি লাভ করছি।
এক পৃথিবীর সন্তান হিসেবে মুমূর্ষু ‘মা’ কে বাঁচাতে হলে সবাইকে এক ছাতার নিচে আসতে হবে। কিন্তু মায়ের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত সন্তানটি যেমন করে ওপরে উঠতে উঠতে নিচের দিকে তাকাতে ভুলে যায়, পৃথিবীর বেলায়ও তাই হয়েছে। আমাদের বিশ্বমোড়লদের ভাণ্ডারে যত অস্ত্র মজুদ আছে, তা দিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে কয়েকবার ধ্বংস করা যাবে। বিধ্বংসী মারণাস্ত্র নির্মাণে আরও অর্থ বরাদ্দ দিতে তৈরি তারা। কিন্তু পৃথিবী বাঁচাতে অর্থ ব্যয়ে সম্মত নয়, তাই কার্বন নিঃসরণে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে ইচ্ছুকও নয় বিশ্বনেতারা। যে কারণে অমীমাংসিতভাবেই শেষ হয়ে যায় বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আয়োজিত একের পর এক জলবায়ু সম্মেলন।
সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গ পৃথিবীকে রক্ষার সংগ্রাম করতে গিয়ে বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে তরুণী হলো। বিশ্বনেতাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কে শোনে কার কথা! বরং গ্রেটা’র হাতেই হাতকড়া পড়ে। গ্রেফতার হয় গ্রেটা, অর্থ দণ্ড দেওয়া হয় আপোসহীন সংগ্রামী এই নারীকে। এমন অবস্থায় ‘মা’ পৃথিবীর অস্তিত্ব নিয়ে শংকিত না হয়ে থাকা যায়না।