কানুনগোপাড়া বসন্ত নাট্য উৎসব ও একজন বন চৌধুরী

মুস্তফা নঈম | শুক্রবার , ১০ মার্চ, ২০২৩ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

সত্তর দশকে দেশের কোথাও ঘটা করে বসন্ত উৎসব হতো বা এমন একটা উৎসবের আয়োজনের কথা আমার ঠিক জানা নেই। তখন যে ক’টি সংবাদ পত্র ছিলো তার প্রায় সব কটি আমার পড়বার সুযোগ হতো। তখন সংবাদ পত্র বলতে চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদী ঢাকার ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক বাংলা। অবজারভার, টাইমস এসব বাবার পাঠ্য। সাপ্তাহিক বিচিত্রা পরবর্তীতে রোববার। তখন ইত্তেফাকে ছোটদের পাতা কচিকাঁচা, সংবাদে খেলাঘর ছিলো আমাদের পাঠের অন্যতম পাতা। তারপর দৈনিক বাংলার খেলার পাতা। কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে বাবার শিক্ষকতার সুবাধে প্রায় সবকটা পত্রিকা রাখা হতো বাসায়। পত্রিকা দিত রাজা মিয়া আমাদের রাজা দা। আমাদের সংবাদ পত্র পাঠের হাতেখড়ি সেই কিশোর বেলা থেকেই। সেই সময় পত্রিকা পড়েই আমাদের সময়ের কিশোর তরুণদের দেশ ও বিশ্বকে জানা। আমরা যখন এমন একটি উৎসবের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করি তখন সময় ১৯৭৬৭৭। কানুনগোপাড়া গ্রামে। বহু আগে থেকেই কানুনগোপাড়া ছিলো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অগ্রসরমান ঐতিহ্য মণ্ডিত গ্রাম। সেই গ্রামেই রয়েছে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্যার আশুতোষ কলেজ। যা কানুনগোপাড়া কলেজ নামেই খ্যাত ছিলো। বর্তমান সময়ের চলমান বসন্ত উৎসব আয়োজনের আগেও আমাদের ছোট্ট বেলায় আমরা বসন্ত আয়োজন দেখেছি। তখন দেখেছি কানুনগোপাড়া কলেজের দিদিরা এই বিশেষ একটা দিনে হলদে বরন বা বাসন্তী রঙের শাড়ি ফুলেল খোঁপাসহ সেজেগুজে কলেজে আসতেন। হয়তো সেই বয়সে এমন বিশেষ কিছু বুঝতাম না। তারপরও দেখতাম আমার দুই ফুফুর দুই মেয়ে আমাদের এই আপাদের বান্ধবীরা বাসায় আসতেন। অসাধারণ সাজ। এসব দৃশ্য যুদ্ধদিনের আগের ঘটনা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই উৎসবে রঙ লাগে। কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গান বাজনা হতো।

শিরোনামে যে কথা বলছিলাম, আমাদের বসন্ত উৎসব দেখা ও বুঝবার মধ্যে একটু তফাৎ রয়েছে। ছোট্ট বেলায় কলেজের দিদিদের বিশেষ রঙের শাড়ি পরবার দিন, এটা একদিনের নয়। এইযে দিদিদের শাড়ি পরা এটা মা ঠাকুমা দিদিমা নানী দাদীর কাছ থেকে শেখা। এটা চিরায়ত ঐতিহ্য। এসব ছিলো অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রম।

আমাদের বেড়ে উঠবার প্রিয় প্রাঙ্গণে যখন আমরা বসন্ত উৎসব আয়োজন দেখতে শুরু করি তখন উৎসবের মূল ছিলো সপ্তাহব্যাপি নাটক। পরবর্তীতে এই নাট্য উৎসবের ব্যাপ্তী দিয়ে ঠেকে পক্ষকাল। উৎসব আয়োজনের কারিগর যিনি তাঁর নাম বন চৌধুরী। ভালো নাম প্রবীর কুমার চৌধুরী। বন চৌধুরী নামেই তাঁর খ্যাতি।

বন চৌধুরী বা প্রবীর কুমার চৌধুরী যেমন সুদর্শন ছিলেন তেমনি একজন অসাধারণ শিক্ষকও ছিলেন। সীতাকুণ্ড এলাকার প্রাক্তন ছাত্ররা এখন শ্রদ্ধাভরে তাঁর নাম উচ্চারণ করেন। আমি তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে। আমার নানা মামাদের পড়া ঐতিহ্যবাহি এই স্কুলে আমার ও বড় ভাইয়ের কিছুদিন পড়বার সুযোগ হয়েছিল। সময়টা ১৯৭০ সাল।

স্কুলে পড়তে গিয়ে উনাকে দেখে আমিতো অবাক। এই মানুষটা এখানে কীভাবে? উনিতো কানুনগোপাড়ার মানুষ। একদিন আমাদের ক্লাস নিতে আসলেন। ক্লাসের কয়েকজন বন্ধু আমার কৌতূহলের কথা স্যারকে বলে দিয়েছে। উনিও জানালেন আমাকে। আমি উনার স্যারের ছেলে। জানালেন ক্লাসে। বন চৌধুরী মূলত উপরের শ্রেণির ক্লাস নিতেন। কতোদিন থেকে উনি এই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন জানি না। ছাত্ররা ভীষণ সমিহ করতো। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ের সীতাকুণ্ড স্কুলের ছাত্রদের কাছে তিনি এখনও স্মরণীয়। বিকম স্যার নামে খ্যাত। একজন ভালো ফুটবল রেফারি হিসাবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিলো।

সেই স্কুল বেলায় যে ক’টা ক্লাস করার সুযোগ হয়েছিল একজন মাঝারি মানের ছাত্র হিসাবে আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছিলো তাঁর পাঠদান পদ্ধতি। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আর শিক্ষকতায় ফিরে যাননি। কেন সেটা তার বিষয়। পরে এসে হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আমাদের সেই সময়ের সমাজ বাস্তবতায় এবং রাষ্ট্রীয় তৃণমূল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এমন মানুষদের মূল্যায়ন বেশি একটা হয় না। কারণ তাঁরা ওদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। বন চৌধুরীও পারেন নি।

আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর (৪৬ বছর) আগে সেই প্রবীর চৌধুরী বা বন চৌধুরী প্রকাশ বিকম স্যারের হাত ধরেই কানুনগোপাড়ায় শুরু হয় বসন্ত উৎসবের। তাঁর সঙ্গে ছিলেন গোপাল দে, পরিতোষ কানুনগো, রবি ঘোষ, মাস্টার অরূপ চ্যাটার্জি, বিজয় চক্রবর্তী, শিবু মহাজন, মাস্টার অনিল শীলসহ আরো অনেকই। কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক পার্থ প্রতিম চৌধুরী, অধ্যাপক বাদল বরন বড়ুয়া, অধ্যাপক সুকুমার দে, কানুনগোপাড়া ড. বিভূতি ভূষণ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুকুমার শীল, সুশীল কুমার দে উনার ছিলেন পরামর্শক। এর বাইরে আরো অনেকেই ছিলেন। মূল উদ্যোক্তা বন চৌধুরী। কানুনগোপাড়া ড. বিভূতি ভুষণ হাইস্কুলে সামনে হরি মন্দিরের মাঠে বসতো এই নাটকের উৎসব। নাট্য সপ্তাহ পৌঁছেছে নাট্য পক্ষে। পনর দিনব্যাপী মঞ্চ নাটক হতো। দূর দূরান্ত থেকে নারী পুরুষ আসতেন নাটক দেখতে। তখন সবে কলেজে প্রবেশ করেছি। বসন্ত উৎসবের সেই সব নাটক দেখতে বোয়ালখালীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও দূরবর্তী এলাকা পটিয়ার ধলঘাট, ভুর্ষি, রতন পুর কেলি শহর, কর্ণফুলী নদীর ওপাড়ের রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী, লাম্বুরহাট এলাকা এবং চট্টগ্রাম শহর থেকেও বহু নাটক প্রেমি মানুষ কানুনগোপাড়া আসতেন। তখন কানুনগোপাড়ার সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের বাস যোগাযোগ ছিলো। রাতের বাসে শহর থেকে কানুনগোপাড়া এসে নাটক দেখে ভোরে প্রথম বাসে আবার শহরে চলে যেতো অনেক দর্শক। এই গ্রামীণ জনপদের অনেক দূর থেকে মহিলার দল বেঁধে হারিকেন জ্বালিয়ে এইসব নাটক দেখতে আসতেন। সেই সময়ের সামাজিক পরিবেশ এমন ছিলো যে রাতে নাটক দেখতে আসা কোন নারীকে বিব্রতকর কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। দুষ্টু মানুষ যে এক্কেবারে ছিলো না তা নয়। কিন্ত তারপরও রাতে গৃহকর্ম সম্পন্ন করে নারীরা নির্ভয়ে নাটক দেখতে আসতেন। বসন্ত উৎসব সময়ে কানুনগোপাড়া ও তার আশপাশের গ্রামের বিবাহিত কন্যারা শ্বশুর বাড়ি থেকে ননদজা এদের নিয়ে বাবার বাড়ি নাইয়র আসার মতো ঘটনাও ঘটতো।

এক সময় এই দেশে গ্রামে গঞ্জে যাত্রাপালা হতো। এক সময় এই দেশের গ্রামে গঞ্জের স্কুল কলেজে বার্ষিক নাটক হতো। গ্রামের তরুণরা তাদের ক্লাবের উদ্যোগে নাটক করতো। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলো না। নাটক কিন্ত হয়েছে। নাটক বন্ধ থাকেনি। বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা পেট্রোমাক্স বা হ্যাজাক লাইট চিনে কিনা জানি না। সেই পেট্রোমাঙ জ্বালিয়ে কী কৌশলে তারা নাটক করতো। পেট্রোমাঙ জ্বালিয়ে নাটক করা বা যারা এই হ্যাজাক লাইটের আলোকে নাটকের প্রয়োজনে আলোআঁধারি বা বর্ণিল করতেন তারা দারুন শিল্পী। আলোর শিল্পী। কানুনগোপাড়ার কথা ভিন্ন। কানুনগোপাড়া কলেজে ও বোয়ালখালীর বহু গ্রামে বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে বহু আগে। স্বাধীনতারও আগে। কানুনগোপাড়ার বসন্ত উৎসবে চট্টগ্রামের সেই সময়ের সেরা অভিনেতা অভিনেত্রীরা নাটক করেছেন। অনেকে পরবর্তীতে সিনেমার নায়ক নায়িকা হয়েছেন। পঙ্কজ বৈদ্য, অঞ্জু ঘোষ এমন অনেক নাম অনায়াশে চলে আসে। উনার পরবর্তী সময়ে সিনেমায় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন।

বর্তমানে দেশ জুড়ে বর্ণিল আয়োজনে বসন্ত উৎসব হয় । একদা গ্রামীণ সংস্কৃতিতে অনুষ্ঠানিক ভাবে পালিত হওয়া পহেলা ফাল্গুন বসন্ত দিন আজ কর্পোরেট ছোঁয়ায় নগর সংস্কৃতির বড় একটি উপলক্ষ । তরুণতরুণী বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস ।

সেই কবে আজ থেকে ৪৬ বছর আগে কানুনগোপাড়া নামে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে একজন বন চৌধুরী তাঁর কিছু শুভানুধ্যায়িদের নিয়ে শুরু করেছিলেন বসন্তের আনুষ্ঠানিক উৎসব। সত্তর আশির দশকের কানুনগোপাড়ার বসন্ত উৎসবের স্মৃতি সেই অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবে। নতুন প্রজন্ম হয়তো শুনবে জানবে এক সময় এই কানুনগোপাড়ায় বসন্ত উৎসব হতো। পক্ষকাল ব্যাপী রাতভর নাটক দেখতো মানুষেরা । সেই বসন্ত উৎসবের আনন্দ উল্লাস আজ দেশময়। বসন্ত উৎসব আজ আলোয় উদ্ভাসিত। কিন্ত সেই বন চৌধুরী ও তার সেদিনের কুশিলবগন আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। আসলে কি বন চৌধুরীরা কখনো হারিয়ে যায়!

লেখক: সাংবাদিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধশিশুসাহিত্যিক ও গীতিকার ফারুক হাসানের ইন্তেকাল