কানাডার হ্রদে নিভে গেল বিমান বাংলাদেশের এক নক্ষত্র

টরন্টো থেকে হাসান আকবর | সোমবার , ৯ জুন, ২০২৫ at ১২:১০ অপরাহ্ণ

নীল আকাশে উড়ে চলা যার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল, সেই মানুষটিই যেন এক অনন্ত নীলের আহ্বানে সাড়া দিলেন। প্রকৃতি যার জীবনভরের অভিভাবক, সেই প্রকৃতিই যেন আজ হঠাৎ আবেগভরে তাঁকে টেনে নিলো নিজের কোলে। একটি নির্মল ভ্রমণ পরিণত হলো এক মর্মান্তিক অধ্যায়ে—যার পরিসমাপ্তি ঘটল কানাডার স্টার্জন লেক (Sturgeon Lake)-এর শান্ত জলের গভীরে।

রবিবার (৮ জুন) অন্টারিওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লিনজির একটি কটেজসংলগ্ন হ্রদে ক্যানোইং করতে গিয়ে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৮৭-এর অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন সাইফুজ্জামান গুড্ডু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিজিএমইএ-এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহিল রাকিব পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন।

জানা যায়, সাইফুজ্জামান গুড্ডু তাঁর স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে গতকালই ঢাকা থেকে টরন্টো আসেন। উদ্দেশ্য ছিল বড় মেয়ের সঙ্গে দেখা এবং পারিবারিক অবকাশযাপন। বড় মেয়ে টরন্টোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। রবিবার তাঁরা টরন্টো থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরের লিনজি (Lindsay) শহরে রওয়ানা হন এবং ওখানকার একটি কটেজে ওঠেন। দুপুরের দিকে (বেলা ২টায়) সাইফুজ্জামান তাঁর এক বন্ধু ও বন্ধুর ছেলেসহ একটি ক্যানো নিয়ে হ্রদে নামেন।

ক্যানোটি যখন শান্ত হ্রদের বুকে এগিয়ে চলছিল, তখন তীরে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর স্ত্রী ও ছোট মেয়ে মোবাইলে ভিডিও করছিলেন। হঠাৎ করে ক্যানো উল্টে যায়। বন্ধুর ছেলে সাঁতরে পাড়ে উঠে আসেন, কিন্তু সাইফুজ্জামান ও তাঁর বন্ধু আর ফিরে আসেননি। পরে উদ্ধারকারীরা তাঁদের দু’জনকেই উদ্ধার করে, কিন্তু তখন তাঁরা আর জীবিত ছিলেন না।

মিসিসগায় বসবাসরত তাঁর কাজিন ফাহমিদা টনি জানান, সাইফুজ্জামান ছিলেন অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও চৌকষ এক পাইলট। তাঁর পিতা ছিলেন বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের কর্মকর্তা। বিমানবাহিনীর ঐতিহ্যবাহী পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা গুড্ডু ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শৃঙ্খলাপরায়ণ, দায়িত্বশীল ও আত্মবিশ্বাসী।

লিনজি (Lindsay) অন্টারিওর একটি শান্তিপূর্ণ পর্যটন নগরী, যেখানে বোটিং, কায়াকিং, ক্যানোইং-এর মতো জলক্রীড়া জনপ্রিয়। তবে এমন দুর্ঘটনা সেখানে সচরাচর ঘটে না। হঠাৎ করে দিকভ্রান্ত বাতাস, লাইফ জ্যাকেটের অনুপস্থিতি, কিংবা ক্যানো চালনায় অপ্রশিক্ষিততা—এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণ হতে পারে বলে জানা গেছে।

অন্টারিও প্রাদেশিক পুলিশ (Ontario Provincial Police – OPP) জানিয়েছে, রোববার বিকেলে কাওয়ার্থা লেইকস অঞ্চলের একটি হ্রদে ক্যানো উল্টে যাওয়ার ঘটনায় দুই ব্যক্তি মারা গেছেন।

পুলিশ জানায়, বিকেল ৩টার কিছু পরে স্টার্জন লেক (Sturgeon Lake)-এ একটি বোট দুর্ঘটনার খবর পেয়ে জরুরি সেবাদানকারীরা সেখানে ছুটে যান।

ক্যানোটিতে তিনজন পুরুষ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হন। কিন্তু বাকি দুজন পানিতে ভেসে থাকতে না পেরে প্রাণ হারান।

নৌকায় থাকা তিনজনের কারো শরীরে তখন কোনো লাইফ-জ্যাকেট ছিল না বলে পুলিশ জানিয়েছে।

যে মানুষ প্রতিদিন আকাশে হাজারো যাত্রীকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন, সেই মানুষটি আজ আর নেই। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই করুণ পরিণতি স্মৃতিতে দাগ কেটে যাবে চিরজীবন।

একটি শান্ত দুপুরের হ্রদ যেন আজ বিস্মৃত এক কাব্য লিখে গেল—যেখানে প্রকৃতি ও মানুষ, জল ও জীবন, সবকিছু এক অনাকাঙ্ক্ষিত অশ্রুধারায় মিলিয়ে গেল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজার সৈকতে বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে নিখোঁজ পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার
পরবর্তী নিবন্ধকানাডার হ্রদে নিভে গেল বিমানের বাংলাদেশের এক নক্ষত্র