যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বদলা নিতে কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। কাতারের স্থানীয় সময় গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানী দোহা জুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। একইসাথে আকাশে প্রজেক্টাইল উড়তে দেখা গেছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের আকাশ সীমা বন্ধের ঘোষণা দেয়ার কিছুক্ষণ পরই এ ঘটনা ঘটে। কাতারে আল উদেইদ ঘাঁটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় মার্কিন বিমান ঘাঁটি। এখানে প্রায় আট হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করে। ব্রিটিশ সেনা সদস্যরাও এই ঘাঁটিতে অনেক সময় থাকে। এ ঘাঁটি লক্ষ্য করেই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা জানিয়েছে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী। আক্রমণের পর তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘হোয়াইট হাউস ও তাদের মিত্রদের প্রতি ইরানের বার্তা সুস্পষ্ট। ইরানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার উপর কোনো আক্রমণকে খামোখা ছেড়ে দেওয়া হবে না।’ কাতার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের ছোড়া সব ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে প্রতিহত করেছে।
এর আগে ইরানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ইব্রাহিম জুলফাকারি বলেছেন, যা করেছে তার জন্য চড়া মূল্য চুকানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। জুয়াড়ি ট্রাম্প, আপনি হয়তো যুদ্ধ শুরু করতে পারেন, কিন্তু আমরাই সেই যুদ্ধের ইতি টানতে যাচ্ছি।
কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ওই অঞ্চলের অনেকগুলো দেশের বিমান সংস্থাগুলো সাময়িকভাবে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। মিশর এয়ার ও কুয়েত এয়ারওয়েজ জানিয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আপাতত ওই অঞ্চল দিয়ে তাদের কোনও বিমান চলাচল করবে না। এর আগে কাতার, বাহরাইন ও ইরাক তাদের দেশের আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। এদিকে বাহরাইনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সাইরেন বাজানো হয়েছে এবং বাসিন্দাদের ‘নিকটতম নিরাপদ স্থানে’ সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আল উদেইদ ঘাঁটিতে হামলার আগেই কাতারে মার্কিন নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সতর্কতা জারি করেছিল দোহায় মার্কিন দূতাবাস। মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর অঞ্চলের ব্রিটিশ নাগরিকদেরও সরকারের ভ্রমণ নির্দেশিকা অনুসরণ করা উচিত বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যামি।
কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরানের হামলার পরপরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই এঙ পোস্টে লিখেছেন, ‘এ হামলাকে আমরা কাতার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, আকাশসীমা, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের প্রতি স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে ধরে নিচ্ছি।’ তার দাবি, ‘কাতারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে এ হামলা ঠেকিয়েছি, ক্ষেপণাস্ত্রকে ভূপাতিত করেছে। হামলার আগেই ওই ঘাঁটি থেকে সবাইকে সরিয়ে নিয়েছে। মাজেদ আল আনসারি বলেন, আল উদেইদ ঘাঁটির সদস্যসহ কাতারের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আগেই নেওয়া হয়েছে। আমরা নিশ্চিত করছি এ হামলায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। নির্লজ্জ এ আক্রমণের শিকার হওয়ার পর কাতারের এর জবাব দেওয়ার অধিকার রয়েছে।’
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, যদিও ইরান ইরান হামলা চালিয়ে কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি চুরমার করে দিয়েছে, তবে এই হামলা কোনোভাবেই কাতার বা কাতারের জনগণের জন্য কোনো হুমকি সৃষ্টি করে না। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ইরান কাতারের সঙ্গে তার উষ্ণ ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং তা অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে উদ্ধৃত ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই হামলায় যতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রও ঠিক ততগুলো বোমা ব্যবহার করেছিল ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার সময়। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল তারা ১৪টি বোমা দিয়ে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালায়।
এদিকে পেন্টাগন দাবি করেছে আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে ইরানের চালানো হামলায় কেউ হতাহত হয়নি। পেন্টাগন বলছে, ইরান স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে।
আল উদেইদ মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরানের চালানো হামলার কঠোর সমালোচনা করেছে সৌদি আরব। সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এটি আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিবেশী সম্পর্কের নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি আপত্তিকর বিষয়, যা যেকোনো পরিস্থিতিতেই অযৌক্তিক। সৌদি আরব ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্র কাতারের প্রতি সমর্থন ও অবস্থানের প্রতি জোর দিচ্ছে।’ আরব আমিরাত এক বিবৃতিতে বলেছে, কাতারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে ক্ষুন্ন করে এমন যেকোনো আক্রমণকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে আরব আমিরাত।
আরেক খবরে বলা হয়েছে, কাতার ও ইরাকের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলার পরপরই সিরিয়ায় প্রধান মার্কিন ঘাঁটিতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। উত্তর–পূর্ব সিরিয়ায় কাসরাক নামে পরিচিত এ ঘাঁটিতে থাকা মার্কিন সেনারা সম্পূর্ণ সতর্কাবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে সিরিয়ার একটি নিরাপত্তা সূত্র।
গতরাত ১টায় এই রিপোর্ট লেখার সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিচুয়েশন রুমে অবস্থান করছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠক আগেই নির্ধারিত ছিল। হোয়াইট হাউজ বলেছে, সেখান থেকেই তারা কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ইরানের হামলার অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
এই হামলা একেবারে অচিন্ত্যনীয় ছিল না। গত শনিবার রাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর এমন পাল্টা প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা ছিলই। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত সব মার্কিন বাহিনী আগে থেকেই সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় ছিল, এমন হামলার জন্য প্রস্তুতও ছিল।
খবরে বলা হয়েছে, তবে ইরানের এই হামলার প্রকৃত মাত্রা কী, সেটা বুঝতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুটা সময় লাগবে। আর সেই তথ্য পাওয়ার পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কীভাবে এর জবাব দেবেন।
শনিবার ইরানের পরমাণু স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে তেহরান কী করে তার জন্য বিশ্ব যখন অপেক্ষায় তখনও ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত হয়েছে। ইসরায়েলের শহর আশদদের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে হামলা করেছে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। এর ফলে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটতে দেখা গেছে। অপরদিকে ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার ৪৮ ঘণ্টা পর গতকাল সোমবার সেখানে ইসরায়েলও এই হামলা চালায়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তেহরানে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর ৫০ টিরও বেশি যুদ্ধ বিমান তেহরানের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেন, তাদের টার্গেটে বাসিজের সদর দপ্তর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি একটি মিলিশিয়া বাহিনীর সদর দপ্তর। প্রায়শই বিক্ষোভ দমনের জন্য এই মিলিশিয়া বাহিনী ব্যবহার করে ইরানি সরকার। কাৎজ আরও বলেন, এভিন কারাগারকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে যেখানে রাজনৈতিক বন্দি রাখা হয়।
