কাজী আবদুল ওদুদ : মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রপথিক

কানাই দাশ | শুক্রবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ

পশ্চাদপদ বিশ্বাস ও সংস্কারের নিকষ কালো অন্ধকারে, বিভ্রান্তির কুহেলিকায় মানুষ যখন যুক্তি ও বুদ্ধির কথা ভুলে সর্বনাশা সংকীর্ণতার চোরাবালিতে ডুবে যায়, সংখ্যাধিক্যের জোরে নিজের মত ও বিশ্বাসের কল্পিত শ্রেষ্ঠত্বের দাবী নিয়ে অন্যের মত ও বিশ্বাসকে তুচ্ছ ও ক্ষতিকর মনে করে সমাজে হিংসা, বিভেদ ও ভীতির আবহ তৈরি করে, তখনি প্রাকৃতিক নিয়মেই এই অপশক্তি ও আপদের অচলায়তনের মধ্যে সব সময় বিপরীতমুখী কিন্তু সুস্থ ও কল্যাণকামী চিন্তাভাবনা ও দ্রোহী কিছু নির্ভীক, মুক্ত-হৃদয় ও মনের মানুষ উঠে আসেন যাঁরা যুক্তি ও বুদ্ধির নিরিখে জীবন ও জগতে সতত ঘটে চলা পরিবর্তনকে চরম বৈরী পরিবেশেও সত্য বলে প্রচার করেন, ধর্ম, অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাখ্যা করে প্রচলিত অন্ধ সংস্কার ও জীবনাচারের অসারতাকে অর্থহীন প্রতিপন্ন করে পুরো সমাজকে জাগিয়ে তোলার সংকল্পে জীবনোৎসর্গ করেন। এঁদের মধ্যে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মুসলিম পুনর্জাগরনের অন্যতম অগ্রপথিক বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষক ও “বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের” সংগঠক কাজী আবদুল ওদুদ সর্বাগ্র্যগণ্য ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। এ বছর তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর পূর্ণ হল। কিন্তু যুক্তি বিবর্জিত আজকের আরো পিছনে চলতে থাকা সমাজে তিনি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে রামমোহন যেমন ধর্মান্ধ হিন্দু সমাজের ও অসহনীয় আচার সতীদাহ প্রথা নিবারণ ও পৌত্তলিকতার বিপরীতে নিরাকার ব্রহ্মের বা ঈশ্বরের সাধনায় সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন উপনিষদের আলোয়, তেমনিভাবে কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর আদর্শ, মহানবীর জীবন ও শিক্ষার আলোয় মুসলিম সমাজকে সংস্কারমুক্ত উদার শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন। রামমোহন ছিলেন আরবী ও ফার্সী ভাষায় সুপন্ডিত এবং তিনি ইসলামের তৌহিদ বা একত্বের বাণীতে প্রাণিত হয়ে পৌত্তলিকতা ও সংস্কারমুক্ত আলাদা ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর ভাবশিষ্য ও একজন ব্রাহ্ম। আবদুল ওদুদ তাঁর সাহিত্য ও কর্মজীবনে রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় কাজী আবদুল ওদুদের জীবন ও কর্মসাধনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে যথার্থভাবেই লিখেছেন “কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন জাতিতে ভারতীয়, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে মুসলমান, জীবনদর্শনে মানবিকবাদী, মতবাদে রামমোহন পন্থী, সাহিত্যে গ্যেটে ও রবীন্দ্রপন্থী, রাজনীতিতে গান্ধীপন্থী, অর্থনৈতিক শ্রেণি বিচারে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, সামাজিক ধ্যান-ধারনায় ভিক্টোরিয়ান লিবারেল।” সেই লিবারেলিজমের পথ ধরে পূর্বসূরী বেগম রোকেয়া, কাজী ইমদাদুল হক, লুৎফর রহমানের মত মুক্ত মনের লেখক ও সমাজকর্মীদের পদাংক অনুসরন করে, ১৯২০-২১ সালে নজরুল-মোজাফ্‌ফর আহমদ এর বিপ্লবী সাম্যবাদী ভাবধারায় প্রাণিত হয়ে ১৯২৬ সালে ঢাকায় শুরু করেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, যে আন্দোলনের মূল কথা ছিল- “জ্ঞান যেখানে রুদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সেদিন যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক, তাঁর চাইতেও স্পষ্টবাদী একজন র‌্যাডিক্যাল ব্যক্তি জনাব আবুল হুসেন। একমাত্র বৌদ্ধিক পূনর্জাগরনের মাধ্যমেই যে মুসলিম সমাজের অগ্রগতি সম্ভব তা নানা সভায়, আলোচনায়, শ্রেণিকক্ষে তুলে ধরে সেদিন তাঁরা ঢাকার যুব ও ছাত্র সমাজের এক বিরাট অংশকে এই বুদ্ধি মুক্তির আন্দোলনে যুক্ত করতে পেরেছিলেন ঢাকার নবাব পরিবার এবং তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ও ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ সহ বিশালরক্ষণশীল গোষ্ঠীর তীব্র আক্রমনের মুখে।
কাজী আবদুল ওদুদ ১৮৯৪ সালে ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে এক দরিদ্র কিন্তু সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে মাসিক দশ টাকা বৃত্তি পেয়ে তিনি প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯১৭ সালে প্রেসিডেন্সী থেকে বি.এ এবং ১৯১৯ সালে রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। স্কুলে পড়ার সময় অক্ষয় কুমার দত্তের “বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ” নামক বইটি পড়ে তিনি প্রভাবিত হন এবং জীবন ও জগত নিয়ে একটি বিজ্ঞানমনস্ক বিশ্ববীক্ষা তাঁর মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে। তখন থেকেই তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে বিচার না করে, না ভেবে তিনি কোন ধারনা বা আচারের বশবর্তী হয়ে চলবেন না। তাঁর পিতা ও চাচারা গোঁড়া ছিলেন না বরং শিক্ষিত, উদার ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। পারিবারিক প্রভাবে তিনি স্থির করেন যে গোঁড়ামি বা অন্ধত্ব নয়- তাঁকে প্রকৃত ধার্মিক হতে হবে। তিনি আজীবন তাই ছিলেন।
ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন। ১৯১৫ সালে কলেজে পড়ার সময় সদ্য প্রকাশিত শরৎ চন্দ্রের উপন্যাস “বিরাজ-বৌ” এর উপর একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লেখেন। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৯১৮ সালে তাঁর প্রথম গল্প গ্রন্থ “মীর পরিবার” প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নদীবক্ষে’। পদ্মাপাড়ের বাগমারা গ্রামে বড় হয়ে উঠা ওদুদ এ উপন্যাসে উত্তাল পদ্মার বক্ষে মাঝিদের সংগ্রামমুখর জীবন ও সাধারণ মুসলমান কৃষকদের জীবনের দুঃখ-বেদনার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা গ্রামীন কৃষি জীবনের ছবি এঁকেছেন। এ উপন্যাসের উচ্চ প্রশংসা করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন যে এ উপন্যাসের বিষয়বস্তুর নতুনত্ব, মাধুর্য ও সহজিয়া সুর পাঠককে মুগ্ধ করে।এরপরেই তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ “সাহিত্যিকের সাধনা” তিনি পাঠ করেন তখনকার “মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র” একটি অধিবেশনে। এ প্রবন্ধে তিনি মুসলিম কবি ও সাহিত্যিকদের মানবিক সৌন্দর্য ও মাধূর্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ম্যাথু আর্নল্ডের ভাষায় সাহিত্যে তিনি “যরময ংবৎরড়ঁংহবংংচ এ বিশ্বাস করতেন, মনে করতেন সৃজনশীল সাহিত্য প্রকৃত অর্থে মানুষের জন্য ঐশ্বরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জাগাতে পারে। ১৯২০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলা বিষয়ে একজন প্রভাষকের পদ খালি হলে তিনি আবেদন করেন ও রবীন্দ্রনাথ প্রশংসিত উপরোক্ত সাহিত্যকৃতির জন্যে দীনেশ চন্দ্র সেনের সুপারিশে রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র হয়েও তিনি বাংলার শিক্ষক হিসাবে ঐ কলেজে নিয়োগ পান। সেই থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতার কাজে ঢাকায় অবস্থান করেন। ১৯৪০ সনে তিনি নতুন সরকারি চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯২১ সালে তিনি খিলাফত আন্দোলনের বিরোধিতা করেন ও তুরস্কের নতুন শাসক কামাল আতাতুর্ককে সমর্থন করেন তাঁর আধুনিক সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গী ও উদার রাষ্ট্রীয় নীতির জন্য। এসময় নজরুল ও কামাল আতাতুর্ককে সমর্থন করে একটি বিখ্যাত কবিতা লেখেন।
বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনকে রক্ষনশীল পশ্চাদপদ ভাবধারায় আচ্ছন্ন খেলাফত আন্দোলনে সাথে মিলিয়ে ফেলার জন্য গান্ধী সমর্থক হয়েও তিনি গান্ধীর বিরোধিতা করেন। তিনি এ সময় ফরাসী মনীষী রোমারোঁলার “জাঁ-ক্রিস্তফ” উপন্যাসটি পড়ে গভীরভাবে অনুপ্রানিত হন এবং জীবন ও জগত সম্পর্কে মানবিক ভাবনায় তিনি এতটাই মোহিত হন যে পরবর্তীতে ঐ উপন্যাসের বক্তব্যের আদলে “আজাদ” নামে এক বিরাট উপন্যাস লেখেন যার প্রথম খন্ড ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। এসময়ে রবীন্দ্র প্রতিভার উপর লেখেন “রবীন্দ্র কাব্যপথ” নামে গ্রন্থ। তিনি ও অধ্যাপক আবুল হুসেন মিলে তাঁদের অনুসারী শুভানুধ্যায়ী ও উৎসাহী ছাত্র তরুনদের অনুরোধে ঐ বছর ১৯২৬ সালের জানুয়ারীতে প্রতিষ্ঠা করেন “মুসলিম সাহিত্য সমাজ” নামে বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে ঢাকা তথা বাংলার সাহিত্য-সামাজিক ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক সংগঠন। এর প্রথম অধিবেশনে বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র সভাপতিত্বে। তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল কাদির, আবুল ফজল প্রমুখ। এর বিভিন্ন অধিবেশনে বক্তা ও শ্রোতা হিসাবে শরৎচন্দ্র ও নজরুলের প্রানবন্ত উপস্থিতি ছিল সবার কাছে অনুপ্রেরনামূলক। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ছিলেন এ সংগঠনের আশীর্বাদক। ১৯২৭ সালের এপ্রিলে সংগঠনের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয় “শিখা” নামে একটি বার্ষিক পত্রিকা। এ পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে সংগঠনের আয়োজিত আলোচনা সভার বিষয়বস্তু তথা সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ, ইহজাগতিক ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা সহ নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা থাকত। পত্রিকাটি স্বল্পস্থায়ী হলেও বাংলার সারস্বত সমাজে তা সাড়া ফেলে যে কারণে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সংগঠক ও সমর্থক গোষ্ঠীকে “শিখা গোষ্ঠী” বলা হত। এ সংগঠনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। এর নাম “মুসলিম সাহিত্য সমাজ” রাখার জন্য তিনি দুটো কারণের কথা উল্লেখ করেন। প্রথমত: বাঙালি মুসলিম সমাজের কাছে রেনেসাঁর বাণী তথা মানুষ কেন্দ্রিক ইহ জাগতিক বাস্তবতা ও মুক্ত বুদ্ধির চর্চার কথা তুলে ধরা, দ্বিতীয়ত: সাহিত্যের মাধ্যমে অবহেলিত মুসলমান সমাজের জীবন ভাবনা সঠিকভাবে চিত্রিত করা যা তাঁর মতে মেধাবী হিন্দু সাহিত্যিকরা করতে পারেন নি। এ সময়ে পারস্যের কবি শেখ সাদি, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসী, হাফিজ ও জালাল উদ্দীন রুমী প্রমুখের উদার মানবতাবাদী ও লৌকিক ভাবনা সমৃদ্ধ কাব্য সম্ভার তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে।
১৯২৬ সালে তিনি তাঁর মুক্ত জীবনভাবনা, দর্শন ও ধর্মানুভূতি নিয়ে দুই খন্ডে রচিত “নব পর্যায়” নামক গ্রন্থে প্রথম খন্ড বের করেন। এই খন্ডের বক্ষ্যমান দীর্ঘ প্রবন্ধ “সম্মোহিত মুসলমান” মুসলিম সমাজে আলোড়ন তোলে। এতে তিনি লেখেন “জগতের জন্য ইসলামের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি। বরং ইসলামে আল্লাহর প্রতি একান্ত নির্ভরশীলতা, সাম্য ও মৈত্রীর বীর্যবন্ত সাধনা, জগতের জন্য আজো সেই সমস্তের দারুনতম প্রয়োজন। কিন্তু এই কল্যানময় ইসলামকে বহন করে জগতের আর্ত ক্লিষ্ট নরনারী সেবায় পৌঁছে দেবে কে? নিশ্চয়ই সেটি তার দ্বারা সম্ভব নয় যে “আলেম” বলে নিজের পরিচয় দেয় কিন্তু হৃদয়ের দ্বার যার সাংঘাতিকভাবে বন্ধ।” এই প্রবন্ধে মুসলিম সমাজের জন্য তাঁর বেদনাবোধ, জীবন জিজ্ঞাসা, ইসলামের ইতিহাসের মুক্ত বিচার ও দর্শনোচিত প্রজ্ঞার পরিচয় দেখা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম সমাজের সংষ্কার প্রয়াসের মধ্যে নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, মীর মোশারফ হোসেন, স্যার সৈয়দ আহমদ প্রমুখের মুসলমানদের প্রতি ইংরেজি ভাষা ও যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের তাগিদের তিনি যেমন সমর্থক ছিলেন অন্যদিক সে সময়ে প্রবল এবং অন্ধ শাস্ত্রানুগত্য ভিত্তিক ফরায়েজী বিশেষ করে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতি তিনি সমর্থন জানাতে পারেননি। ‘হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম’ বইতে তিনি নবীজীর মৃত্যুর পরে ইসলাম জগতে ভাবগত, রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে যে সংকট দেখা দেয় তার কারন উল্লেখ করে ব্যক্তিগতভাবে তাতে মুতাজিলাদের যুক্তিবাদী ভাবনার প্রতি তাঁর সমর্থন ও ইমাম গাজ্জালির প্রতি আনুগত্য দেখা যায়। উদার মানবিক জীবনেবোধের তাগিদে যেমন তিনি শাস্ত্রানুশীলন করেছেন তেমনি শাস্ত্র নিরপেক্ষ বিচার পদ্ধতির জন্য প্রথম মুসলিম দার্শনিক আল কিন্দির (৮০১-৭৩) দার্শনিক জিজ্ঞাসা তাঁকে পথের দিশা দেখিয়েছে। শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মনে করতেন পৃথিবীতে কোন ঃবীঃ বা মতবাদ স্বয়ম্ভু নয় বরং তা পূর্বতন ঐতিহাসিক ভাবনা চিন্তার ধারাবাহিকতার নবতর এবং সৃজনশীল সংস্কার মাত্র। প্রফেসর আনিসুজ্জামান এর ভাষায় “মুতাজিলাদের চিন্তা, সাদীর হিতোপদেশ, আতাতুর্কের বিপ্লব, দাদু কবীরের ভক্তি সাধনা, রামমোহনের সংস্কার প্রচেষ্টা ও রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি”-এ সবকিছুই সেদিন ওদুদের মানস ভাবনা ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মর্মবস্তু ছিল। কিন্তু রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রচন্ড চাপে ত্রিশ এর দশকের শেষের দিকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের কর্মতৎপরতায় ভাটা পড়ে এবং তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। ঠিক এই সময়ে ১৯৩৫ সনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তি নিকেতনে “নিজাম বক্তৃতা” প্রদানের আহ্বান জানান। এ ছিল তাঁর কাছে পরম গৌরব ও উৎসাহের বিষয়। তিনি “হিন্দু-মুসলিম বিরোধের উৎস ও পটভূমি” নিয়ে বক্তৃতা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে তিনি কলকাতায় থেকে যান। এসময়ে তিনি রচনা করেন “সমাজ ও সাহিত্য”, “কবিগুরু গ্যাটে”, “বাংলার জাগরণ” প্রভৃতি মননশীল গ্রন্থ।
কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন ধর্মাশ্রয়ী কিন্তু যুক্তিবাদী, স্বাধীনচেতা, সংস্কারমুক্ত একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি। ধর্মান্ধ রক্ষণশীল শক্তির আক্রমণ ও সমস্ত প্রতিকূলতা উজিয়ে তিনি ইসলামের প্রকৃত বাণীর আলোকে সাম্য ও মানবতার কল্যাণে দৃপ্ত পায়ে আপন জ্ঞান ও যুক্তির পথে চলেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হননি। তাঁর অনুপস্থিতিতে ঢাকা তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪০ ও ৫০ এর দশকে গড়ে ওঠে বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের নতুন পর্ব। এই নবতর আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তাঁরই সহযোগী কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, পরবর্তীতে যুক্ত হন সরদার ফজলুল করিম, মুনির চৌধুরী, কবি শামসুর রহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজ, আনিসুজ্জামান প্রমুখ সহ অসংখ্য কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবির এক বিশাল প্রজন্ম যাঁরা ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়ে এদেশে গড়ে তুলেন একটি শক্তিশালী প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার আবহ ও সামাজিক পরিমন্ডল। বাংলা একাডেমী তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশ করেছে। ১৯৭০ সালের ১৯মে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাই
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাসীর স্ত্রী নিয়ে উধাও ব্যবসায়ী