কোন নির্বাচনে হারেননি। অর্থ প্রচুর্য, বাহুবল, রাজনৈতিক দাপট বা পদ-পদবি না থাকা মানুষ এত দীর্ঘ মেয়াদে জনপ্রিয়তা থাকা বা বারে বারে নির্বাচিত হওয়ার নজির নেই। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জয়ের মালা ছিনিয়ে এনেছেন হাসতে হাসতে। কোন সংঘাত বা বিতর্ক নেই সাইয়্যিদ গোলাম হায়দার মিন্টু’র নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে। তিনি যেন এক যাদুকর। তরুণ বয়সে ১৯৭৭ সালে প্রথম চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। এরশাদ সরকারের স্বৈরশাসন আমলে নির্বাচন বর্জন করেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় বার জয়ী হয়। চট্টগ্রামের নন্দিত মেয়র এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ওঠেন। আর পিছনে ফিরে তাকাননি সাইয়্যিদ গোলাম হায়দার মিন্টু। ২০০০ ও ২০০৫ সালে পর পর দুইবার চকবাজার ওয়ার্ডের বিপুল মানুষের সমর্থন নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার নির্বাচিত হন। সিটি কর্পোরেশনের সাধারণ সভা ও স্ট্যান্ডিং কমিটিতে তাঁর দায়িত্বশীল ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এটা জগত সত্যি বিষয়। কিন্তু সাইয়্যিদ গোলাম হায়দার মিন্টু’র বেলায় তা হয়নি। ২০১০ ও ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আরও দুইটি নির্বাচনে জয়লাভ করে এক সময়ের সহকর্মী নির্বাচিত মেয়র এম.মনজুর আলমের সাথে এবং পরবর্তীতে আওয়ামীলীগনেতা নির্বাচিত মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন সাথে নির্বাচিত কাউন্সিলর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এবার ২০২০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন পান। নির্বাচনের কয়দিন আগে কোভিড-১৯ মহামারী কারণে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। পিছিয়ে পড়া নির্বাচন ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। ৭ম বারের মত নির্বাচিত হয়ে মেয়র রেজাউল করিমের সাথে কাউন্সিলর হিসাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম সভা সম্পন্ন করেন। আরো চার বছর এগারো মাসের ৫৯ সভা বাকী রেখে পরপারে চলে গেলেন প্রিয় কাউন্সিলর মিন্টু । কয়দিন ধরে জটিল রোগে আক্রান্ত হন, ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হলে ৫দিন পর চিরবিদায় নেন। বেশ কিছুদিন আগে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরে রিপোর্ট নেগেটিভ হলেও ফুসফুসের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। পিতা সাইয়িদ মাজহারুল আলম ইন্ডিয়ান একটি সংস্থার কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সুবাদে তার শৈশব ভারত ও করাচিতে কেটেছে। চট্টগ্রাম মহসিন কলেজে আরবী শিক্ষক মিন্টু’র দাদা অবসর নিয়ে(ধর্মীয় গুরু সাইয়িদ সাহেব) ভক্তদের অনুরোধে টাঙ্গাইলে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন কালে দাদার কাছে থেকেই টাঙ্গাইলেই সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রামে অবস্থানরত মা সখিনা বেগম ভাইবোনসহ চকবাজার জয়নগরে পরিবারের কাছে চট্টগ্রাম চলে আসেন। সাইয়িদ গোলাম হায়দার মিন্টু চসিকের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। একজন দক্ষ অভিজ্ঞ কাউন্সিলর ও সমাজ সেবক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ২০০৮/৯ সালে দু’বছর চসিকের একটি সাব কমিটির দায়িত্বে মিন্টু ভাই আর আমি একসাথে কাজ করেছি। অসাধারণ প্রতিভার চিত্র দেখেছি কর্মে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা মিন্টুর বৃহত্তর চট্টগ্রাম বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী সংগঠন ও স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠনের সফল প্রধান উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চকবাজার একজন নির্ভীক বুদ্ধিদীপ্ত জনপ্রতিনিধিকে হারালো। স্বামীকে হারিয়েছে স্ত্রী মেহেরুন্নেসা। পিতা হারিয়েছে সদ্য এসএসসি পাশ করা পুত্র সাইয়িদ সদরুল হায়দার। একজন নিবেদিত জনসেবক হারিয়েছে চকবাজার ওয়ার্ডবাসী। সিটি করপোরেশন হারিয়েছে একজন অভিজ্ঞ কাউন্সিলর। আমরা হারিয়েছি একজন দায়িত্বশীল প্রিয় সহকর্মীকে। অর্ধশত বছর ধরে একই ডিজাইনের পাজামা পাঞ্জাবী, একই নিয়মের খাওয়া-দাওয়া। বিয়ে করেছেন ৪৮ বছর বয়সে। সঙ্গীত ও সাহিত্য প্রিয় মিন্টু ভাই প্রায় গুণ গুণ করে গাইতেন। বাংলাদেশের নাগরিক হলেই জাতীয়তা সনদ, জামিননামায় দিতে কোন দেরী নেই। শালিশী ব্যবস্থা ছিল ন্যায়, আইনত এবং বাস্তবসম্মত। তবে বলতেন বিচার নয় শালিশ। কি বৈচিত্র্যময় কাহিনী। জন্ম : ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ দিল্লী, ভারত, মৃত্যু : ১৯ মার্চ ২০২১ ঢাকার হাসপাতালে, অন্তিম নিদ্রা মোল্লাহ মিসকিন শাহ্(রহ.) দরগা প্রাঙ্গণে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এক্স-কাউন্সিলর ফোরাম