কাউন্সিলর প্রার্থী ঘিরেই সংঘাত

গাড়ি ভাঙচুর, মোটরসাইকেলে আগুন।। পুলিশসহ আহত ১শ, ভোটার উপস্থিতি কম

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

ভাইয়ের হাতে ভাই খুনসহ দুটি প্রাণহানি এবং প্রায় পুলিশসহ ১শ মানুষের আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে গতকাল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সকালে ভোটগ্রহণের শুরুতে হামলা-পাল্টা হামলাসহ খুনের ঘটনায় উৎসবের পরিবর্তে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে নগরীতে। কেন্দ্র দখলের চেষ্টার পাশাপাশি ভাঙচুর করা হয়েছে ইভিএম। ভেঙে দেয়া হয়েছে গাড়ি। আগুন দেয়া হয়েছে মোটরসাইকেলে। নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে বড় কোনো সংঘাত না হলেও কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের সংঘাত দিনভর উত্তাপ ছড়িয়েছে। নির্বাচনে সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে আটক হয়েছেন আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী ও বিএনপির এক কাউন্সিলর প্রার্থী। নগরীর দুটি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
সরেজমিনে বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে জানা গেছে, চসিক নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। ভোর হতেই বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে কাউন্সিলর এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের বাহিনী অবস্থান নেয়। ভোটারদের কেন্দ্রে আনার জন্যও তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে বিভিন্ন কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয় হামলা-পাল্টা হামলা, ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া। এ সময় কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মীদের তৎপরতায় তপ্ত হয়ে উঠে অনেক ভোট কেন্দ্র। এসব ঘটনায় পুলিশসহ ১শ মানুষ আহত হয়েছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ৫০ জন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন বলে জানিয়েছেন এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার।
নির্বাচনে মেয়র পদ নিয়ে তেমন উত্তাপ দেখা না গেলেও কাউন্সিলর পদে দল মনোনীত প্রার্থী এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের মাঝে ব্যাপক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ১২ নং সরাইপাড়া ও ১৩ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে দুই সমর্থক নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন একজন। নিহত নিজাম উদ্দিন মুন্নাকে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী বলে দাবি করা হয়েছে।
দুই খুন এবং বিভিন্ন কেন্দ্রে থেমে থেমে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে নগরে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে লালখান বাজার, পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজার, শোলকবহর, দক্ষিণ বাকলিয়া, দক্ষিণ পাহাড়তলী, পাঠানটুলি, চান্দগাঁও, মোহরা, দক্ষিণ পাহাড়তলী, জালালাবাদ, উত্তর কাট্টলী ও দক্ষিণ কাট্টলীসহ প্রায় ওয়ার্ডে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘাত এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াসহ সন্ত্রাসী তৎপরতায় বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি একেবারে কমে যায়। পথে পথে ভোটারদের বাধা দেয়া, কেন্দ্রে যেতে না দেয়া, কেন্দ্রে প্রবেশ করলেও নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারার অভিযোগ করেছেন অনেক ভোটার। কেউ কেউ বলেছেন, ভোট দিতে ইভিএম পর্যন্ত গেলেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকই ভোট দিয়ে দিয়েছেন। নিজের পছন্দের প্রার্থীর জন্য সুইচ টিপলেও তা ক্যানসেল করে অন্য প্রার্থীর ভোট নিশ্চিত করা হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্রে বেশ কিছু বুথে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করারও অভিযোগ আছে।
সকাল সাড়ে ৮টায় ফিরিঙ্গিবাজারে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সময় নগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুকের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা তানভিন ফয়সাল ইভানকে বিএনপির সমর্থকরা ঘেরাও করে হামলা চালায়। গুরুতর আহত ইভানকে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হলে ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় বলে জানান শফিকুল ইসলাম ফারুক। তিনি বলেন, বিএনপির ছেলেরা আমার বাড়ির সামনে আমার ছেলেকে আহত করেছে।
এদিকে বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার চট্টগ্রাম মডেল স্কুল কেন্দ্রের সামনে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। ওয়ার্ডটিতে বিদ্রোহী প্রার্থী সাহেদ ইকবাল বাবুর বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগ এনেছেন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী হাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সাহেদ ইকবাল উল্টো তার কর্মীদের মারধরের অভিযোগ করেন।
১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কিল্লাপাড়ায় দুপুরে বিদ্রোহী প্রার্থী তৌফিক আহমদ চৌধুরীর গাড়ি ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আহমদ নুরকে দায়ী করেন। ৪ নং চান্দগাঁওয়ের মৌলভী পুকুর পাড় সানশাইন স্কুল কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থীর দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
বেলা ১১টায় ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের গোসাইলডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায়, কেন্দ্রের ৬০৭ নং কক্ষের ইভিএমে ভোট দিতে ভোটারদের সহায়তা করায় নৌকার ৪ জন এজেন্টকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন জাহাঙ্গীর আলম, সিরাজউদ্দীন, আজাদ ও আলী আহমেদ।
বেলা সাড়ে ১০টায় বারিক মিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কোনো ভোটার নেই। বাইরে বেঞ্চে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা রোদ পোহাচ্ছেন। মোবাইলে ছবি তোলার সময় পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সরে যান।
পৌনে ১১টায় কেবি আবদুল হক দোভাষ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে ভেতরে-বাইরে ভোটারের লাইন দেখা যায়। এ সময় বাইরে দেখা হয় খোরশেদ আলম মানিক নামে এক ভোটারের সাথে। তিনি আজাদীকে জানান, এই কেন্দ্রে ৮টি বুথে প্রায় ১২ হাজারের মতো ভোটার। তবে ভোট কাস্টিং হচ্ছে ধীর গতিতে।
বেলা সাড়ে ১২টায় ৪১ নম্বর পতেঙ্গা বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। এ সময় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল বারেকের সাথে দেখা হয়। ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বেলা ১২টায় ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ভোটারের দীর্ঘ লাইন। ভোট ধীরগতিতে কাস্ট হওয়ায় লাইনে দাঁড়ানো ভোটাররা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
৮ নং শুলকবহর ওয়ার্ডের শুলকবহর, বাদুরতলা, নাসিরাবাদ, প্রবর্তক, ষোলশহর এলাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সরকারদলীয় প্রার্থীর লোকজনের। এ সময় কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি তেমন দেখা যায়নি। ভোটারদের বদলে কেন্দ্রের বাইরে ও প্রবেশমুখ ঘিরে জটলা দেখা যায়। জানা যায়, ইভিএমে ভোট দেয়া নিয়ে একজন ভোটারকে একাধিক কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। ওয়ার্ডটিতে কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন চারজন।
১৭ নং পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই বিভিন্ন কেন্দ্রে বিএনপি এজেন্টদের প্রবেশে বাধা দেয়া, মারধর করাসহ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৯ নং দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডে ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই সকালে ৪ ও ৬ নম্বর ভোট কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভোট শুরুর পর বিভিন্ন কেন্দ্রে বিএনপি এজেন্টদের দেখা মিলেনি। বিএড কলেজসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছ থেকে জানা গেছে, সকাল থেকে বিএনপি এজেন্টরা কেন্দ্রে আসেননি। কেন্দ্রগুলোর প্রবেশমুখে সরকারদলীয় প্রার্থীর লোকের জটলা দেখা গেছে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের বিএড কলেজ একাডেমিক ভবন-১ এ নিজের ভোট দিতে গিয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ভোটের পরিবেশ নিয়ে নানা অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। এমনকি এজেন্টদের মারধর এবং ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ পেয়েছেন।
বাগমনিরাম, চকবাজার, জামালখান, আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে ভোটারদের উপস্থিতি কম দেখা গেছে। বিভিন্ন কেন্দ্রের বাইরে প্রচুর লোক আড্ডা দিচ্ছিল। তবে ভেতরে ভোটার ছিল না। ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হচ্ছিল বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। উক্ত ওয়ার্ডগুলোর অন্তত ১০টি কেন্দ্রে ঘুরে কোথাও বিএনপির কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি। একাধিক প্রিজাইডিং অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিএনপি প্রার্থীর সমর্থনে কোনো এজেন্টই কেন্দ্রে আসেনি। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যেই মূলত ভোট হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ গেল দুজনের
পরবর্তী নিবন্ধএটা ভোট ডাকাতি ছাড়া আর কিছু না : শাহাদাত