কল্পলোকের মেরিন ড্রাইভ : কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে ওঠা নতুন পর্যটন কেন্দ্র

নেজাম উদ্দীন আবির | বুধবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১:৩৮ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে সমপ্রতি গড়ে ওঠা একটি নীরব সৌন্দর্য এখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে শহরবাসীর জন্য নতুন এক অবকাশ যাপনস্থল। কল্পলোক আবাসিক এলাকার পেছনে নির্মিত নতুন মেরিন ড্রাইভ সড়কটি ইতোমধ্যেই স্থানীয়দের আড্ডা, হাঁটাহাঁটি এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের প্রিয় জায়গায় পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রামের মতো ব্যস্ত বাণিজ্যিক শহরে এমন উন্মুক্ত ও প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব একটা দেখা যায় না। এই সড়কটি ধরে হাঁটলে একপাশে দেখা যায় কর্ণফুলীর শান্ত জলের বুকে নৌকা ভেসে চলা, অন্য পাশে কল্পলোক আবাসিকের সাজানোগোছানো ভবন। বিশেষ করে বিকেলের সূর্যাস্তের সময় পুরো জায়গাটি যেন এক নিখুঁত ছবির মতো মনে হয় লালচে আকাশ, নদীর জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব, আর হালকা বাতাসে দোল খাওয়া বৃক্ষরাজি।

প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে এখানে ভিড় করেন নানা বয়সী মানুষ। কেউ আসেন পরিবার নিয়ে, কেউ বন্ধুবান্ধব নিয়ে আবার কেউবা একান্ত সময় কাটাতে ভালোবাসেন প্রিয়জনের সঙ্গে। অনেকে হাঁটেন, কেউ কেউ বসে নদীর দিকে চেয়ে থাকেন। স্ট্রিট ফুডের গন্ধ, চায়ের হকারদের হাঁক, আর মৃদু নৌযান চলাচলের শব্দসব মিলিয়ে জায়গাটি হয়ে ওঠে এক প্রাণবন্ত মিলনমেলা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দর্শনীয় ভিড় বহুগুণ বেড়ে যায়।

এই মেরিন ড্রাইভ এলাকাটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকায় এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, যদি এখানে পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট এবং বসার জায়গা তৈরি করা হয়, তাহলে এটি চট্টগ্রামের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে।

বায়েজিদ লিংক রোড : চট্টগ্রামের বুকে এক নতুন পর্যটন ঠিকানা

চট্টগ্রামের ব্যস্ত ও কোলাহলময় নগরজীবন থেকে একটু দূরে, পাহাড় আর সবুজ প্রকৃতির মাঝে গড়ে উঠেছে এক মনোমুগ্ধকর পথবায়েজিদ লিংক রোড। এটি কেবল একটি সড়ক নয়, বরং হয়ে উঠেছে শহরবাসীর কাছে এক নতুন পর্যটন গন্তব্য। প্রকৃতি, আধুনিক সড়ক প্রকৌশল ও জীবনের রোমাঞ্চ মিশে এই রাস্তাটি তৈরি করেছে অনন্য এক অভিজ্ঞতা।

বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত বিস্তৃত এই রোডের দুই পাশে খাড়া কেটে তৈরি করা পাহাড়, ঘন সবুজ বনানী এবং পথের প্রতিটি বাঁকে বদলে যাওয়া দৃশ্যপট যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম। ভোরের কুয়াশা কিংবা সন্ধ্যার লাল আলোয় পাহাড়ের রঙ বদলে যায়। সব কিছু মিলিয়ে এটি প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক দারুণ গন্তব্য।

এই সড়কের বিশেষত্ব হলো এর ওঠানামার গতি ও বাঁক, যা চালকদের জন্য রোলারকোস্টারের মতো এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি তৈরি করে। বিশেষ করে মোটরবাইক চালকদের কাছে এটি হয়ে উঠেছে একটি জনপ্রিয় রাইডিং স্পট।

সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট চায়ের দোকান ও ক্যাফে, যেখানে বিকেল বেলা মানুষজন ভিড় করে আড্ডা দিতে ও পাহাড়ি বাতাসে সময় কাটাতে। ফটোগ্রাফি ও সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য আকর্ষণীয় ব্যাকগ্রাউন্ড হওয়ায় অনেকেই এখানে ছবি তুলতে আসেন।

বায়েজিদ লিংক রোড এখন আর শুধুই একটি সড়ক নয়, এটি চট্টগ্রামের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে ভালো লাগার এক ঠিকানা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আধুনিক পথনির্মাণের নিপুণ সংমিশ্রণে এটি যেন এক পাহাড়ি স্বর্গ। তবে এই সৌন্দর্য ও জনপ্রিয়তার সাথে নিরাপত্তা এবং সচেতন ব্যবস্থাপনাও জরুরি, যাতে এটি হয়ে উঠতে পারে এক স্থায়ী, নিরাপদ ও পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র।

কর্ণফুলী নদীর ভাসমান রেস্টুরেন্ট ওয়াটার বাস টার্মিনাল এখন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট

চট্টগ্রাম নগরীর কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে একটি ব্যতিক্রমী ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র ওয়াটার বাস টার্মিনাল। এক সময় এটি ছিল শুধু জলযান যাতায়াতের কেন্দ্রবিন্দু, তবে সময়ের সাথে সাথে তা রূপ নিয়েছে এক প্রাণবন্ত বিনোদন কেন্দ্রে। বর্তমানে এটি শহরের মানুষদের অবকাশ যাপন এবং দূরদূরান্ত থেকে আগত পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে।

টার্মিনালের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে নদীর বুকে দোল খাওয়া ভাসমান রেস্টুরেন্টটি, যা একটি জাহাজের ওপর নির্মিত। কর্ণফুলীর শান্ত জলের ওপর ভাসমান অবস্থায় বসে খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা এক কথায় অনন্য। সন্ধ্যার পর জাহাজটি যখন রঙিন আলোয় ঝলমল করে ওঠে, তখন তা যেন পরিণত হয় এক স্বপ্নপুরীতে। বাতাসে হালকা সুরেলা সংগীত, নদীর ঠান্ডা হাওয়া এবং চারপাশের আলোকছটা পরিবেশটিকে করে তোলে আরও মোহময় ও মনোমুগ্ধকর।

জাহাজের অভ্যন্তরে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বাড়তি আকর্ষণ। নাবিকদের ব্যবহৃত চাকা, নেভিগেশন বোর্ড, ইঞ্জিন রুম, ছাদের রাডারসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দর্শকদের কৌতূহল মেটায়। অনেকেই মনোযোগ দিয়ে এসব উপকরণ পর্যবেক্ষণ করেন, যেন বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার জগৎ মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

টার্মিনালের বাইরের অংশেও রয়েছে দোলনা, সুইমিং পুলসহ নানা বিনোদনের আয়োজন, যা শিশুকিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী দর্শনার্থীর জন্য আনন্দদায়ক। গোটা এলাকা পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন, সুন্দরভাবে সাজানো ও নান্দনিকভাবে নকশা করা, যা যে কাউকে মুগ্ধ করবে।

এই ভাসমান বিনোদন কেন্দ্র পরিদর্শনের জন্য প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা। এ টিকিটের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা জাহাজে প্রবেশ করে রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন, রোমান্টিক ডিনার উপভোগ করতে পারেন কিংবা পরিবারপরিজনের সঙ্গে ছোটখাটো উদযাপনও করতে পারেন।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের এই যৌথ উদ্যোগ শহরের নাগরিকদের জন্য একটি নতুন অবকাশ যাপনের স্থান সৃষ্টি করেছে। শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, নদীর পাড়ের এই শান্ত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত পরিবেশ চট্টগ্রামের পর্যটন মানচিত্রে যুক্ত করেছে এক নতুন মাত্রা।

অভয়মিত্র ঘাট : কর্ণফুলীর কোল ঘেঁষে চট্টগ্রামের এক নীরব সৌন্দর্য

চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত অভয়মিত্র ঘাট বা নেভাল ২একসময় যা ছিল কেবল নৌযান চলাচলের একটি সাধারণ স্থান, এখন তা হয়ে উঠেছে নগরবাসীর কাছে এক নীরব আরাম আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ মিলনস্থল।

নদীর বিশালতা, হিমেল বাতাস, আর নৌকার ধীর লয়ে চলাচলসবকিছু মিলিয়ে অভয়মিত্র ঘাটের পরিবেশ যেন এক জীবন্ত ছবির মতো। এখানে এসে কর্ণফুলীর শান্ত ঢেউ আর পাড় ঘেঁষে থাকা নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সময় গড়িয়ে যায়, বোঝাই যায় না। বিকেলবেলা অনেকেই পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে এখানে আসেন একটু প্রশান্তি খুঁজতে। কেউ বসে থাকেন নদীর পাড়ে, হাতে ধরা এক কাপ চা; কেউবা চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া নৌযানগুলোর পানে।

বিশেষ করে সূর্যাস্তের মুহূর্তে অভয়মিত্র ঘাটের সৌন্দর্য যেন আরও হাজার গুণ বেড়ে যায়। কমলা আভায় রঙিন হয়ে ওঠে নদীর জলরাশি, আর দূরের পাহাড়রেখা তখন হয়ে ওঠে এক স্বপ্নীল পটভূমি। এই সময়টা ফ্রেমে বন্দি করতে ভিড় করেন অনেকে।

তবে সৌন্দর্যের এই জায়গাটিতে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। পর্যটকদের উপস্থিতি বাড়লেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো তেমন গড়ে ওঠেনি। নেই পর্যাপ্ত বসার জায়গা, আর পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রেও রয়েছে ঘাটতির ছাপ।

অভয়মিত্র ঘাট এখন আর কেবল একটি নদীঘাট নয়, এটি হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের মানুষের ভালোবাসার একটি জায়গা্তযেখানে প্রকৃতি ও প্রশান্তি হাতে রেখে পথ হাঁটে একসঙ্গে। সঠিক পরিকল্পনা, নিরাপত্তা এবং পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে এটি হতে পারে চট্টগ্রামের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

লেখক : রিপোর্টার, আজাদী অনলাইন

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৎস্য খনি: আমাদের ‘হালদা’
পরবর্তী নিবন্ধবড়উঠানের দেয়াঙ পাহাড় ও কর্ণফুলীর মরিয়ম আশ্রমের হাতছানি