কলকাতায় খুন বাংলাদেশের এমপি আনোয়ারুল আনার

হত্যায় যুক্ত সবাই বাংলাদেশি, তিনজন গ্রেপ্তার : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী । ফ্ল্যাটে গিয়ে লাশ পায়নি কলকাতা পুলিশ

| বৃহস্পতিবার , ২৩ মে, ২০২৪ at ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ

চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে নিখোঁজ বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে কলকাতার একটি বাসায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, ভারতীয় পুলিশের কাছ থেকে এ বিষয়ে তথ্য পাওয়ার পর বাংলাদেশের পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

আনোয়ারুল আজীম আনার ঝিনাইদহ৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন সরকারপ্রধান। গতকাল বুধবার সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আনারের খুন হওয়ার খবর আসে। বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মহাপরিদর্শক (সিআইডি) অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, আনোয়ারুল আজীমের মরদেহ এখনো পায়নি পুলিশ। তবে কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে তারা মনে করছেন যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হাতে নিয়েছে বলে জানান চতুর্বেদী। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে যে ওনাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি জানান, পূর্ব কলকাতার নিউ টাউন অঞ্চলে যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীম উঠেছিলেন, সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরের কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার রায়ের। সন্দীপের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি। আখতারুজ্জামানই ওই ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীমের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কলকাতার নিউ টাউনের অভিজাত আবাসিক এলাকা সঞ্জীবনী গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে গতকাল তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। সেখানে কী ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে বা রক্তের দাগ পাওয়া গেছে কি না, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু জানাননি চতুর্বেদী। তিনি বলেছেন, পুলিশের ফরেনসিক বিভাগ তদন্তের কাজ শুরু করেছে। তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ১৩ মে ফ্ল্যাটে উঠার সময় আনোয়ারুল আজীমের সঙ্গে সে সময় দুই পুরুষ ও এক নারী ছিলেন। তারা চারজনেই ওঠেন আবাসনের বি ইউ ব্লকের ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটে। সেই রাতে তারা একসঙ্গেই ছিলেন।

এদিকে গতকাল দুপুরে ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে আনোয়ারুল আজীমকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ আমাদের যে তথ্য দিয়েছে, সে তথ্য অনুযায়ী আমাদের পুলিশ যারা খুন করেছে বা খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, আমরা যাদের সন্দেহ করছি, তাদের মধ্য থেকে তিনজন অপরাধীকে আমাদের পুলিশ ধরেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তদন্ত চলছে।

এমপি আনার গত ১১ মে দর্শনাগেদে সীমান্ত দিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। কলকাতায় পৌঁছে তিনি ওঠেন তার বন্ধু, বরাহনগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। কিন্তু ১৬ মে থেকে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছিল না তার পরিবার। আনার নিখোঁজ জানিয়ে ১৮ মে বরাহনগর থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। সেখানে বলা হয়, ১৩ মে দুপুরে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি আনার। তবে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে আসা এক বার্তায় বলা হয়, দিল্লি যাচ্ছেন তিনি।

এদিকে আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডোরিন পরে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার বাবার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানান। পরের কয়েক দিনে দুই দেশের পুলিশের মধ্যে যোগাযোগের পর বুধবার সকালে কলকাতার সংবাদমাধ্যমে আনারের খুন হওয়ার খবর আসে। বলা হয়, নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন নামের বিলাসবহুল একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পাওয়া গেছে বাংলাদেশের এ সংসদ সদস্যের লাশ। আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসও বলেন, তিনি যে জিডি করেছিলেন, তার তদন্ত কর্মকর্তা শুভেন্দু গোস্বামী সকালে তাকে ফোন করে আনারের লাশ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, এমপি আনারের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে তাকে যে খুন করা হয়েছে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।

বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য ভারতে গিয়ে খুন হলেন, এ ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরবে কিনাএমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ঘটনার পর থেকে ভারত আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছে। এখানে সম্পর্কে ফাটল ধরার মত কোনো কিছু হয়নি। কারণ হত্যায় যুক্তরা সবাই বাংলাদেশি, এখানে কোনো ভারতীয় নেই।

এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, এমপি আনার সাহেবের হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত দুঃখজনক, মর্মান্তিক, অনভিপ্রেত। এবং কলকাতা পুলিশ যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে ঢুকেছিল, কোনো লাশ সেখানে পায় নাই। তবে, হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাকে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ডিবি গ্রেপ্তার করেছে। এবং কলকাতা পুলিশও দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় কোনো দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই ঘটনাতো অত্যন্ত দুঃখজনক। যেহেতু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ও বলেছেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সুতরাং এটি দুই রাষ্ট্রের বিষয় নয় আসলে।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা হয়েছে। আনারের মেয়ে ডোরিন এ মামলা করেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার রুবাইয়াত জামান জানান। মামলা করার পর ডোরিন সাংবাদিকদের বলেন, মামলায় হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে আসামি হিসাবে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। পুলিশ কর্মকর্তা রুবাইয়াত জামান বলেন, সংসদ সদস্য আনার গত ৯ মে ঢাকার সংসদ ভবন এলাকার এমপি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে যান। এরপর তিনি ভারতে চলে যান। সর্বশেষ শেরেবাংলা নগর থানা এলাকা থেকে বের হওয়ার কারণেই এ থানায় মামলা হয়েছে।

এর আগে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ কলকাতায় বাংলাদেশের কিছু অপরাধী আনোয়ারুল আজীমকে নৃশংসভাবে খুন করেছে বলে জানান। হারুন অর রশীদ বলেন, কালিগঞ্জের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুলের আজিমের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ড পারিবারিক নাকি আর্থিক কারণে হয়েছে নাকি দুর্বৃত্তরা তাকে খুন করেছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। তিনি বলেন, একজন সংসদ সদস্যকে যেভাবে বাংলাদেশের কিছু অপরাধী নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, আমরা তাদের কয়েকজনকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা আটক ব্যক্তিদের নাম বলছি না। বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএমপি আনারের লাশ কেটে লাগেজে ভরে বাইরে নেন তিনজন
পরবর্তী নিবন্ধআমি বাবার খুনের বিচার চাই