জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের পক্ষ থেকে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা অত্যাসন্ন। সরকারের ধারাবাহিকতায় বাজেটের আকার বৃদ্ধি ছিল প্রশংসনীয়। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনায় অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া দেশে এ ধরনের বাজেটই কাম্য। বিগত বছরগুলোর বাজেট পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে বাজেট ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। সামাজিক খাতসমূহে নানামুখী জনকল্যাণমূলক বাজেট বরাদ্দ ছিল ইতিবাচক। হতদরিদ্র প্রান্তিক কৃষক–শ্রমিক–দিনমজুরদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বাজেট ধারণা ছিল প্রাসঙ্গিক। শিক্ষা–স্বাস্থ্য–শিল্প–কৃষি–আবকাঠামো উন্নয়নসহ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণেই বাজেট সমূহের প্রভাব পরিলক্ষিত। ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা এক প্রকার কঠিন নাজুক অবস্থায় নিপতিত। বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী দেশসমূহের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় চলমান যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ভূ–রাজনীতি–ক্ষমতার পালাবদলের সাথে নরপশুতুল্য দানবরূপী মানুষদের অর্থলিপ্সুতা সীমাহীন পর্যায়ে পৌছেছে। মানবিকতা প্রায় শূন্যের কোটায়। উন্নত বা দাতা দেশসমূহের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রচণ্ড সীমিত হয়ে পড়েছে।
নানামুখী সংকটাপন্ন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতা–মানবিকতায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ছিল একটি বিরল ঘটনা। মানবাধিকারের সবক নিয়ে কথিত উন্নত দেশসমূহ অনুন্নত দেশগুলোকে করায়ত্ত করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত। বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান–প্রত্যাবর্তনে বিশেষ আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ অনুমিত নয়। পক্ষান্তরে মিয়ানমারের জান্তা সরকার বৈশ্বিক অপশক্তির সমর্থনে হিংস্র কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছে। ইসরায়েল নামক জঘন্য দেশ ফিলিস্তিনের গাজা–রাফাহ–পশ্চিমতীরসহ শরণার্থী শিবিরেও বোমা বর্ষণ করে চলছে। নারী–শিশু–কিশোরসহ প্রায় ৩৬ হাজারের অধিক প্রাণ সংহারেও এদের বিবেক ন্যূনতম মানবিক নয়। বরং সভ্যতার নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত স্থাপনে কাউকেও পরোয়া না করে তাদের কদর্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অতিশয় সজাগ। অতিসম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কর্তৃক গাজা যুদ্ধ নিয়ে ঘোষিত ঐতিহাসিক রায়ে অবিলম্বে ফিলিস্তিনের রাফাহতে হামলা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসরায়লের প্রধানমন্ত্রী এই রায়কে অগ্রহণযোগ্য–জঘন্য–বিরক্তিকর বলে মন্তব্য করে হামলা আরও জোরদার করেছে।
উদ্ভূত বৈশ্বিক এবং দেশীয় নানামাত্রিক সমস্যায় দেশের অর্থনীতি কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জনশ্রুতি মতে, কতিপয় সিন্ডিকেটের কারসাজি ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়–সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের দুর্নীতি–অদক্ষতা–অযোগ্যতা দেশে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিকে স্ফীত করে চলছে। অধিকাংশ জনগণের জীবনপ্রবাহে প্রতিনিয়তই নাভিশ্বাস দীর্ঘায়িত হচ্ছে। স্বল্প সংখ্যক অবৈধ–অনৈতিক কথিত ব্যবসায়ী–চোরাকারবারি ছাড়া সততার সাথে ব্যবসা পরিচালনায় বড় বড় শিল্পপতিরাও হিমশিম খাচ্ছে। ঋণখেলাপি–অর্থপাচার–মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং ঘুষ বাণিজ্যে অকন্ঠ নিমজ্জিত ব্যক্তি ব্যতীত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিদারুণ আয় বৈষম্য তৈরি করছে। উল্লেখ্য বিষয়সমূহ আমলে নিয়ে জনকল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়ন হবে ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সকলেই অবগত আছেন, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মহান জাতীয় সংসদে আগামী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। এবারের বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বিগত বছরেরর মতো এবারও রাজস্ব আয়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। তন্মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আদায় হবে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাড়তি রাজস্ব আয় দিয়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার। যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। বাজেট ঘাটতি রোধেও জোর দেওয়া হবে। অগ্রাধিকার প্রকল্পে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে যেন সঠিক সময়–ব্যয়ে দ্রুত প্রকল্প শেষ করা যায়। আসন্ন বাজেট নিয়ে এক নীতিনির্ধারণী আলোচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সংকট উত্তরণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেটকে সংকোচনমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়াও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিলাসদ্রব্যসহ অপ্রয়োজনীয় পণ্যের যথাযথভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতার সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া, রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, বৈধ পথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বাজেট প্রণয়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের উপদেশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে আরও জানা যায়, নতুন করে আর কর অব্যাহতি না দিয়ে কিছু পণ্যে নতুন করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। সংসদ সদস্য, ইকোনমিক জোন–এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন ও হাইটেক পার্কের গাড়িতে ২৫ শতাংশ কর আরোপের সংবাদও পরিবেশিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এনবিআরের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ যাচ্ছে ভোক্তার উপর। কারণ রাজস্বের ৮০ শতাংশই আসে পরোক্ষ কর বা ভ্যাট থেকে। ফলশ্রুতিতে বেশি রাজস্ব আদায় হলে এর চাপ ভোক্তার ওপর পড়ছে। যাদের আয় নেই বা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ পড়ছে। এমনিতেই পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। এর সাথে আমদানিতে বিভিন্ন ধরনের কর এবং স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট যোগ হয়ে এই ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার ছাড়া সাধারণ মানুষের উপর এই চাপ কমানো সম্ভব হবে না। প্রাসঙ্গিকতায় কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি গণমাধ্যমে বলেন, ‘যে বাড়তি পরোক্ষ কর নেওয়া হচ্ছে, তা ব্যবসায়ী তার পকেট থেকে দেবেন না। ঘুরে ফিরে তা ভোক্তার ওপরেই পড়ছে। এজন্য আমাদের দাবি প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে পরোক্ষ কর কমানোর জন্য। কিন্তু এনবিআর তা কর্তপাত করছে না।’ এটিও সত্য যে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ খুবই কম। বর্তমানে কর–জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। যা সোমালিয়া বা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কাছাকাছি। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ কর–জিডিপির অনুপাত থাকা বাঞ্চনীয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের কর–জিডিপির অনুপাত নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষ হওয়ার মাত্র এক বছরের কিছুটা বেশি সময় বাকি থাকলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। তাই কর–জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হলে রাজস্ব খাত সংস্কার করতে হবে। অর্থনীতির যেখানেই সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, তাকেই করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এনবিআর আয়োজিত প্রাক–বাজেট আলোচনায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির উপস্থাপিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ দেশে কর দেয় ১৮ লাখ মানুষ। তার মধ্যে ১০ লাখ সরকারি চাকরিজীবী এবং অন্যান্য চাকরিতে নিয়োজিত। দেশে ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা হবে ৯–১০ লাখ। এই সংখ্যা হওয়ার কথা ছিল ৭৮ লাখ ৩২ হাজার। এই হিসাবে ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের ৮৭ শতাংশ কোনো ধরনের আয়কর দেন না যা খুবই অগ্রহণযোগ্য। এই অবস্থার নিরসন করতে হবে বলে জানায় সংস্থাটি। মার্চ মাসের ২১ তারিখ সম্মানিত অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অপর আলোচনায় বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতিগণ জানান, দেশের বড় বড় শহরের বাইরেও নতুন ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে যাদের অনেকেই করের আওতার বাইরে। আগামী বাজেটে এ ধনিক শ্রেণি থেকে কর আদায়ে বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এনবিআরকে অধিকতর কার্যকর করার এবং করজাল সম্প্রসারণেরও তাগিদ দিয়েছেন। কর আহরণ বাড়াতে হলে কর ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন এনে কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কর আহরণে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করে এ খাতের দুর্নীতি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ আবশ্যক। বিদ্যমান ব্রিটিশ পদ্ধতিতে কর আদায় অব্যাহত থাকলে কর আহরণে সুফল পাওয়া যাবে না। ১৯ মে অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটালাইজেশন অব দ্য ট্যাক্সেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ : দ্য নেক্সট ফ্রন্টিয়ার ফর হায়ার রিসোর্স মবিলাইজেশন’ শীর্ষক সংলাপে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ যদি ২০২৮ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশন করতে পারে, তাহলে ২০২২–২৩ অর্থবছরের ৪৫ বিলিয়ন ডলারকে ছাড়িয়ে ২০৩০ সালে রাজস্ব আয় ১৬৭ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। তবে রাজস্ব আহরণের বিদ্যমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ঐ সময়ে তা মাত্র ৯০ বিলিয়ন ডলার হবে।’ দুর্যোগপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থায় বিরূপ কোন কিছু সংঘটিত হলে দেশ কোন পর্যায়ে পৌছুবে তা ভাবার সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের বাজেট প্রণয়নে অর্থের মূল যোগানদাতা হচ্ছে দেশীয় রাজস্ব আদায়। কর–ভ্যাট ইত্যাদির মাধ্যমে আদায়কৃত অর্থের ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের বাজেট বাস্তবায়ন কতটুকু সফল হবে। দেশবাসী সম্যক উপলব্ধি করছেন রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে ক্ষুদ্র–মাঝারি ব্যবসায়ীসহ সৎ শিল্পপতিরাই বেশি বিড়ম্বনার শিকার হন। নির্দিষ্ট আয়ের নানাশ্রেণির পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে যাতে হয়রানিমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় তার প্রতি লক্ষ্য রাখা একান্ত জরুরি। নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারের ওপর বর্তমানের চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তৃত করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কুচক্রি মহলও কম নয়। সামগ্রিক বিষয়সমূহ ব্যাপক আলাপ–আলোচনা–চিন্তা–চেতনা ও যাচাই বাছাই করে বাজেটে নিম্ন আয়ের উপকারভোগীর স্বার্থরক্ষা আবশ্যক। অন্যথায় চলমান পরিস্থিতিতে অন্ধকারের শক্তিরা জনগণের আবেগকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে পারে। উস্কানিমূলক কূটপন্থা অবলম্বনে তারা গণরোষ সৃষ্টিতে পিছ পা না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়