(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
গান্ধীজীসহ কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারাও সম্মিলিতভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করলেন। বাংলায় এ আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে। চট্টগ্রামের মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী, কাজেম আলি মাস্টার, মৌলভী আমান আলি, মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ্ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সম্পৃক্ত হলেন। চট্টগ্রামে অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করার পিছনের মূল নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। ১৯২১ সালের ৩১ আগস্ট মোহাম্মদ আলী এবং গান্ধীজী চট্টগ্রাম আসেন। চট্টগ্রামে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার, অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলনের গতি গান্ধীজীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, চট্টগ্রামের ভূমিকায় গান্ধীজী মুগ্ধ হলেন। তিনি গান্ধী ময়দানে (বর্তমানে জেমিসন মেটারনিটি হাসপাতাল) বক্তব্য রাখেন বিশাল জনসভায়। তিনি বললেন, ঈযরঃঃধমড়হম ঃড় ঃযব ভড়ৎব। “চট্টগ্রাম সবার আগে।” তথ্যমতে গান্ধীজী দুবার চট্টগ্রাম এসেছিলেন ১৯২১ এর ৩১ আগস্ট এবং ১৯২৫ এর ১২ সেপ্টেম্বর যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের উদ্যোগে। অবশ্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে গান্ধীজী ইতোপূর্বে শুনেছেন বলে জানিয়েছিলেন। এ কথা ভাবতে ভালো লাগে মহাত্মা গান্ধী আমাদের প্রিয় চট্টগ্রামে এসেছিলেন এবং সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বৃদ্ধির উপর বিশেষ জোর দেন। ১৯৩০ সালে শুরু হোল লবণ আইন অমান্য আন্দোলন। দেশ পরাধীন বলে দেশের মানুষ লবণ তৈরি করতে পারবে না, এ কেমন আইন? লবণ তৈরির আইনসংগত অধিকার আমাদের আদায় করে নিতে হবে ইংরেজদের কাছ থেকে। লবণ–সত্যাগ্রহ ঘোষণা করলেন গান্ধীজী । সবরমতী থেকে পায়ে হেঁটে ৩২৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ডান্ডি পৌঁছলেন। ডান্ডিতে এ পদযাত্রায় সামিল হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। ডান্ডি সমুদ্রতীরে এসে গান্ধীজী একমুঠো লবণ তুলে নিলেন। সাথে সাথে সারা ভারতবর্ষে লবণ আইন অমান্য শুরু হয়ে গেল। এ জনসমুদ্র দেখে ইংরেজরা বুঝতে পারল তাদের সিদ্ধান্ত ভুল। এরপর ১৯৪২ সালে ছঁরঃ ওহফরধ ভারত ছাড় আন্দোলন। কংগ্রেসের দাবী ছিল “ভারত ছাড়” কিন্তু জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ দাবি করলেন, উরারফব ধহফ ছঁরঃ, ভাগ করে, ভারত ছাড়ো”। এ সময় কলকাতায় ভীষণ সামপ্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। কলকাতা থেকে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ল নোয়াখালী। আজীবন অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী গান্ধীজী স্থির থাকতে পারলেন না। ৭৭ বছর বয়সে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ছুটে এলেন নোয়াখালীতে ১৯৪৬ সালের ৭ নভেম্বর। ১৯৪৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৭ এর মার্চ চার মাসেরও বেশি সময় এক নাগাড়ে তিনি নোয়াখালীতে অবস্থান করে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সমপ্রীতি স্থাপনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি গান্ধীজী নোয়াখালীর জোয়াগ গ্রামে আসেন। সেদিন নোয়াখালীর কৃতী সন্তান নোয়াখালী জেলার প্রথম ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ গান্ধীজীর সম্মানার্থে তাঁর জমিদারীর স্থাবর–অস্থাবর সব সম্পদ জনকল্যাণ খাতে ব্যয় করার জন্য মহাত্মা গান্ধীর নামে উৎসর্গ করেন। হেমন্ত কুমার ঘোষের মা বাবার নাম অনুসারে “অম্বিকা –কালিগঙ্গা’’ নামে একটি দাতব্য ট্রাস্ট গঠন করে “গান্ধী আশ্রম” করার সিদ্ধান্ত হয় যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার “গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট” নামকরণ করেন। ইতোমধ্যে নোয়াখালী ঘটনার জের ধরে বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। নোয়াখালী মিশন অসমাপ্ত রেখে গান্ধীজী বিহারে চলে এলেন। ২০১৫ এবং ২০১৮–তে গান্ধীজীর স্মৃতিবিজড়িত স্থান অনুভবে আনার জন্য গান্ধী আশ্রমে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ঢুকতেই চোখে পড়ল : চবধপব হড়ঃ ারড়ষবহপব এ লেখাটি। তখন ঝর্ণাধারা চৌধুরী আশ্রমের সম্পাদক। দেখলাম গান্ধীজীর বিরাট আবক্ষমূর্তি, দেখলাম চারদিক গাছপালায় ঘেরা নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য, আশ্রমে চরকা শিল্প, কুটিরশিল্প, নারীর কর্মসংস্থান, শিক্ষা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে ঝর্ণাদি’র অক্লান্ত শ্রম এবং অদম্য আগ্রহ। সেখানে গান্ধীজীর নামে একটি যাদুঘরও আছে। ঝর্ণাদি’র এই কর্মদক্ষতার জন্য ভারত সরকার ২০১৩ তে তাঁকে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার “পদ্মশ্রী” এ পদক ভূষিত করেন।
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গান্ধীজী ফিরে এলেন কোলকাতায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তিনি জানলেন, পাকিস্তানের জন্মের কথা। পরের দিন ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হোল। কিন্তু স্বাধীন ভারতে হিংসা বিদ্বেষ চলছে। মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। এসব দেখে গান্ধীজী ভীষণ কষ্ট পেলেন। তিনি অনশন শুরু করলেন এবং বললেন, দাঙ্গা বন্ধ না হলে তিনি অনশনে প্রাণত্যাগ করবেন। এবার ফল হল, দাঙ্গা বন্ধ হল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এ মহাত্মা ১৯৪৮ এর ৩০ জানুয়ারি প্রার্থনারত অবস্থায় নাথুরাম গডসের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন। অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তার জীবন অবসান হল কুখ্যাত একজনের সহিংসতায়। কিন্তু এ মৃত্যু তাঁর দেহের মৃত্যু, চিন্তাধারার মৃত্যু নয়। গান্ধীজী বেঁেচ থাকবেন শুভবোধ সম্পন্ন মানুষের অন্তরে, অন্ধকারে আলো দেখাবেন।
১৯৯৫ সালে মহাত্মা গান্ধীর ১২৫তম জন্মদিনে গান্ধীজীর মতাদর্শের প্রতি সম্মান জানাতে ভারত সরকার আন্তর্জাতিক গান্ধী শান্তি পুরস্কার চালু করনে। অহিংসা এবং অন্যান্য গান্ধীবাদী পদ্ধতিতে আর্থ–সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। আমার জানা মতে বাংলাদেশ থেকে ২০১৯ সালে বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দ্র মজুমদার এবং ২০২০ সালে মাদারীপুরের বিশিষ্ট সমাজসেবী, আইনজীবী মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান এই পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। গান্ধীজীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি “সহিংসতা ও হানাহানির এই পৃথিবীতে গান্ধীর শান্তি ও অহিংসার বাণীই একবিংশ শতাব্দীতে মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার চাবিকাঠি। তিনি যৌক্তিকভাবেই হিংস শক্তির বিপক্ষে সত্যাগ্রহের কার্যকারিতায় বিশ্বাস করতেন।” বর্তমানে আমরা এক ভয়াবহ দুঃসময় পার করছি। একদিকে মহামারী করোনায় বিশ্ব বিপর্যস্ত অন্যদিকে কিছু মানুষের অতিরিক্ত অর্থলিপ্সুতা, স্বার্থপরতা, অনৈতিক কর্মকান্ডে আমরা স্তম্ভিত। এই সময় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণ এবং তরুণ প্রজন্মকে গান্ধীর মতাদর্শে সচেতন করার প্রচেষ্টা আমাদের করতে হবে। গত বছর ২০১৯ গান্ধীজীর সার্ধশত জন্মজয়ন্তী উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম ২৫ ও ২৬ অক্টোবর দুদিনব্যাপী মননশীল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তুর উপর ঋদ্ধজনেরা বক্তব্য রেখেছিলেন। এই উপলক্ষে একটি সমৃদ্ধ স্মারক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল। এই ধরনের প্রয়াস যত বেশি হবে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। লেখক : প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ,
চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ